ছবিঃ সংগৃহীত।
বাংলা নববর্ষ—বাঙালি জাতির সর্বজনীন ও ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব। এ উৎসব যেমন আনন্দের, তেমনি এটি ইতিহাস ও সংস্কৃতির গভীর শেকড়েও প্রোথিত। তবে আজ যে বাংলা সন আমরা পালন করি, তার শুরুটা হয়েছিল রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনেই, আর এই পথচলার সূচনায় নেতৃত্ব দেন মোগল সম্রাট জলালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর। ইতিহাসের পাতা খুললেই দেখা যায়, বাংলা সনের জন্ম হয়েছে প্রশাসনিক কার্যক্রম ও কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার বাস্তবতা মেনেই।
সমস্যার শুরু:আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬–১৬০৫) সমগ্র ভারতবর্ষে রাজস্ব আদায়ের সময় গণনার জন্য ব্যবহৃত হতো হিজরি সন, যা চাঁদের চলন অনুযায়ী হিসাব করা হয়। কিন্তু চাঁদের বছর সৌর বছরের তুলনায় ছোট হওয়ায় কৃষিভিত্তিক উৎপাদনের সাথে হিজরি সন মেলানো যেত না। এর ফলে কৃষকরা ফসল তোলার আগেই কর পরিশোধে বাধ্য হতেন। এই সমস্যায় রাজস্ব ব্যবস্থা ও সাধারণ মানুষের জীবনে দেখা দেয় অসঙ্গতি।
আকবরের উদ্যোগ: নতুন ক্যালেন্ডারের প্রবর্তন
সম্রাট আকবর এই সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হন এবং তার দরবারের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতদের সহায়তায় হিজরি ও সৌর বছরের সমন্বয়ে একটি নতুন ক্যালেন্ডার তৈরির নির্দেশ দেন। ইতিহাসবিদ আবুল ফজলের রচনায় পাওয়া যায়, এই নতুন সনকে প্রথমে বলা হতো “তারিখ-ই-ইলাহী”। পরে এর নাম হয় “ফসলি সন” এবং এই হিসাব ধরেই বাংলা সালের প্রবর্তন হয়।
নতুন এই ক্যালেন্ডার প্রবর্তিত হয় ১৫৮৪ সালে, কিন্তু গণনা শুরু হয় আকবরের সিংহাসনে আরোহণের বছর ১৫৫৬ সাল থেকেই। অর্থাৎ, বাংলা সনের গণনা সেই সময় থেকেই চলমান।
'ফসলি সন' থেকে ‘বাংলা সন’ : বাঙালির আপন বর্ষপঞ্জি
‘ফসলি সন’ প্রথমে ছিল মূলত প্রশাসনিক ও কর ব্যবস্থার উপযোগী। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার অংশ হয়ে ওঠে। ব্যবসায়ীরা বর্ষবরণে হালখাতা খুলতে শুরু করেন, কৃষকরা ফসল ওঠার পর খাজনা পরিশোধ করেন, এবং বছরের প্রথম দিনটিকে ঘিরে গড়ে ওঠে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা আয়োজন। ফসলের সঙ্গে সম্পর্কিত এই সন পরিণত হয় বাঙালির নিজস্ব বর্ষপঞ্জিতে, যাকে আজ আমরা ‘বাংলা সন’ বা ‘বাংলা সাল’ নামে চিনি।
পঞ্জিকার রূপান্তর: সৌর বর্ষপঞ্জির সঙ্গে সমন্বয়
১৯৬৬ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন বিজ্ঞানীরা বাংলা সনের আরও গণনাগত সংশোধন আনেন। বাংলা একাডেমির নেতৃত্বে বাংলা বর্ষপঞ্জি আরও নিয়মিত এবং আন্তর্জাতিক সৌর পঞ্জিকার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে গড়ে তোলা হয়। আজ আমরা যে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করি, তা মূলত এই সংশোধিত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী নির্ধারিত।
বাংলা সনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
সম্রাট আকবর প্রশাসনিক প্রয়োজনেই বাংলা সনের সূচনা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু কালের বিবর্তনে এটি হয়ে উঠেছে জাতির আত্মপরিচয়ের প্রতীক। আজ এই দিনটি বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐক্য, ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ, এবং অন্তর্নিহিত মানবিকতা প্রকাশের এক অনন্য উপলক্ষ।
বর্তমানে পহেলা বৈশাখ কেবল একটি দিন নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির উৎসব, যা মেলে ধরে হাজার বছরের লোকজ ঐতিহ্য, শিল্প, সংগীত এবং সংস্কার।
বাংলা সনের সূচনা হয়েছিল এক শাসকের প্রশাসনিক বুদ্ধিমত্তা ও বাস্তববোধ থেকে। কিন্তু সেই সন আজ একটি জাতির জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইতিহাসের সেই প্রয়োজনীয় সংস্কার আজ রূপ নিয়েছে বাঙালির চেতনার উৎসবে। আকবরের হাত ধরে যে বাংলা সনের যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা আজ পেরিয়ে এসেছে শত শত বছর, বদলে দিয়েছে আমাদের কালের হিসাব, তৈরি করেছে নতুন সময়চেতনা। শুভ নববর্ষ ১৪৩২।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh