ছবিঃ সংগৃহীত।
সূর্যাস্তের আগেই খেলাধূলা শেষ। ঘর ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করা, হারিকেন-কুপি জ্বালানো, ইফতার প্রস্তুত করা ইত্যাদিতে ছোটদের একচেটিয়া আধিপত্য। মুখে রোজা। হাসি নাই। কাজও করছে। বড়রা প্রশংসা করলে তাদের সহ্য হয় না। তিতা লাগে। বিরক্ত হয়। বড়রাও হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেছে। জীবন ওষ্ঠাগত। অপেক্ষা কেবল আযানের। খরগোশের মতো কান খাড়া। ইফতারিতে বারবার হাত চালাচালি। হুজুর "আল্লাহু আকবর" বলতে বলতেই যার যার মতো করে ইফতারের দ্রুত দোয়া পড়া শেষ। আর পুড়ুৎ-পাড়ুৎ করে তিন-চার মিনিটেই ইফতার কাবার। রোজায় দেহ উত্তপ্ত-হাহাকার মরুভূমি। সামান্য ইফতার ক'ফোটা বৃষ্টির ছোঁয়ার মতো অবস্থা। এতে কি চলে? কি আর করা। বিকল্প নাই, জানাও নাই। তাই মুখে একটু দানাপানি দিয়ে মসজিদ -মক্তব-কাচারিতে মাগরিবের জন্য দৌড়। এদিকে আযানও আরম্ভ। সুমধুর কন্ঠ শুনে কুকুর- শিয়ালের সকরুণ আর্তনাদের কোরাস। আজও এর রহস্য বুঝি নাই।
নাবালক শিশু। রোজার মর্যাদা, মাহাত্ম্য বুঝার বয়স হয়নি। বেশি রোজা রেখেছে তা গলা ফাটিয়ে বলা-বড়াই করা-গর্ববোধ করাই ছিল শিশু-কিশোরদের বাহাদুরি। বড়রা দুষ্টামি করে গল্প করতো-শুকনা মুরি খেলে, পুকুরে ডুব দিয়ে পানি খেলে রোজা ভাঙ্গে না। কিছু ভাঙ্গলেতো আওয়াজ হয়। তাতো ঘটেনি। আরও বলতো- ছোট মানুষ। তাই ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত এক রোজা, দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবধি এক রোজা- মানি এক দিনে দুই রোজা। সংখ্যা বাড়ানোর চাপাবাজিতে কেউ কম যায় না। আরও বলতো -"ভুলে যত ইচ্ছ তত খা। আর কেউ জিজ্ঞাসা কইল্লে বলবি-ভুলে খাইছি। রোজার কিচ্ছু অইবো না।"
সারাদিন মেঘলা আকাশ। অথবা গভীর রাত। তাই ইফতার বা সেহরির সময় হয়েছে কি-না নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নাই। তাই বড়রা বলতো, "সূরুয ডুইব্যা গেছে। দরজা আটকাইয়া খা, ইস্তার কইরা ফেল্।" অথবা ভোরে সেহেরিতে টের পাওয়া গেলো না। "কতা কইচ্ছা। শরীরের পশম না দেখা পর্যন্ত খাইতে থাক্। সব জায়েজ। " তারা মোসলাও দিত, "ওজরের কোন আপত্তি নাই।" মাঝে মাঝে ঘণঘোর বরিষা। "ধবলিরে আনো গোয়ালে" অবস্থা। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি খোঁয়াড়মুখি। সময় হয়েছে ভেবে ইফতার করে দোয়া-দুরুদ পড়ছে। হঠাৎ করে আগুনের ফাগ ছড়িয়ে পশ্চিমাকাশে সূর্য মামা উঁকি দিল। সে কি হাসাহাসি। মহাসর্বনাশ! বুড়োদের মাথায় হাত! "হায় হায়, কি অইলো রে, রোজা গেল রে!" মুরুব্বি কিসিমের দুই একজন বলতেন-"আরে আংগো নিয়ত বালা, ভুলে খাইছি। আল্লায় মাফ কইরা দিব।" ঘড়ির কোন কারবার নাই। দেহ -ঘড়ির আন্দাজ অনেকটা নির্ভুল হতো। সাধারণত হাঁস-মুরগি খোঁয়াড়ে গেলো। ঘরের কোণে, গাছের ডালে দোয়েল পাখির কিচির মিচির ডাক। পশ্চিমাকাশে লালচে উজ্জ্বল আভা সূর্যাস্তের ইঙ্গিত দিত।
মুরুব্বিগণ বলতেন-"শুক্কুর বার গরীবের হজ্জ। অনেক সোয়াবের দিন।" একটু আগেই মসজিদের দিকে মিছিল সহকারে যাত্রা। বেশি সওয়াবের আশায় মাঝে মাঝে মিলাদ পড়ানো হয়। বিশেষ আকর্ষণ-বাবুল বিস্কুট/বাতাসা বিতরণ। ঐদিন সামনের খালি মাঠেও তিল ধারনের ঠাঁই নাই। কেউ কেউ বলতে-"এতে মুসুল্লি কহনও দেহি নাই। ফেরেশতা আইছে।" হোগলা পাতার দাড়ি বিছিয়ে নামাজ আদায় করা হয়। শিশুদেরকে মাছি খবর দিয়েছে কিনা কে জানে। তবরক বিতরণের সময় ডান হাত আবার বা হাত দিয়ে একাধিকবার না নিলে বেশি সওয়াব কামাবে কিভাবে? অনেকেই পায় না। শেষে খাপাইয়া নিয়ে পালায়। না পেয়ে গাল-মন্দ, চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ঘরে ফিরে। শিশুরা হাতে নিয়ে গফগফ করে মুখে দেয়। পরে মনে পড়ে-"আঁই না রোজা?" অন্যরা বলে-"মুখে আঙ্গুল দিয়া বুমি কইরা ফেলা। কিচ্ছু অইব না।" সান্ত্বনা দিত মুরুব্বিরা। তারা সত্য কথাই বলেন। কিছু মানুষ মৌসুমি নামাজি-রোজাদার। নামায-রোজা ঠিক মত করে না। লুকিয়ে খাবার-বিড়ি খায়। কিন্তু শিশুদের দূরবীন-চোখকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব না। বলে-"মারে কইয়া দিয়াম।" শিশুটিকে আইসক্রিম বা লেবেনছুসের আশ্বাস দিয়ে মুখ বন্ধ করা হয়।
চৈত্র-বৈশাখ মাসে কাঠফাটা রোদ। দিন আর শেষ হয় না। কোন মাসে আবার ১৪/১৫ ঘন্টার রোজা। গ্রামের অনেকে নিজের গৃহস্থালি কাজ করে। অনেকে বদলা দেয়। দুপুরে প্রানবায়ু যায় যায় অবস্থা। সবুজ গাছপালার অভাব নাই। গাছ তলে গামছা বিছিয়ে বা ঘাসের উপর বসে একটু বিশ্রাম (জিরায়) নেয়। বাতাসের গন্ধও নাই। পাতাটি পর্যন্ত নড়ে না। গরমে হাসফাস। এদিকে গৃহস্থের চিৎকার-চেচামেচি। "হারাদিনই হাকিজুকি কইরা কাঠাইলি। রোজা আছত। একটু হালাল কইরা খা।" হ্যাঁ, ঠিকই। অগত্যা ঘণঘণে রোদে আবার কাজে লেগে যায়। পাশেই কুকুরটা পর্যন্ত গরমে জিহবা বের করে হাসপাস করে। শেষে পুকুর-কুয়া-খালের পানিতে লাফিয়ে পড়ে জীবনকে একটু সতেজ করে। সঙ্গে সতেজ করতে শিশুরা বলে-"চল, হুগিরে লুবি খেলি।" লাফালাফি-দাপাদাপিতে পুকুরের পানি ডাঙায় উঠে। ফাঁকে কিছু মাছও ধরে বাড়িতে নিয়ে যায়। ঐ পুকুরই পানির একমাত্র ভরসা। তাতে গরু- ছাগলের গোসল করানো হয়। এই পানি আর পানি থাকে না। বিদ্ঘুটে-দুর্গন্ধযুক্ত-বিশ্রী রং ধারণ করে। মানুষ বাধ্য হয়ে এ পানি পান করে। এক পুকুরের পানি আর কতোমুখি ব্যবহার হতে পারে? এতে রোগ- বালাই-অসুস্থতার কারখানা হয়ে থাকে।
রমজানের প্রতি সহজ-সরল মানুষের শ্রদ্ধা- ভালোবাসা সর্বোচ্চ পর্যায়ের। এখানে নো খাতিল, নো কম্প্রোমাইজ। কেউ যদি বলেন-"রোজার কাল আইতেছে।" তাহলে খাইছে, সর্বনাশ! মারামারি, খুনাখুনির উপক্রম। "রোজা কি কখনো কাল হয়? কাল সাপ না-কি।" কাল মানি খারাপ-নেতিবাচক শব্দ। তাই তাজিমের সঙ্গে বলতে হবে-পবিত্র রোজার মাস বা সময়।
জুমার মসজিদে কালেভদ্রে খতম তারাবি হতো। কিছু বাড়িতে পাকা এবং কিছু বাড়িতে টিনের মসজিদ ছিল। বাড়ির কাচারি ঘরই ওয়াক্তিয়া মসজিদ। এসবের অধিকাংশের দরজা-জানালা -বেড়া ভাঙ্গা। একসঙ্গে কাচারির হুজুরের আবাস, শিশুদের পড়াশোনা, কারও লাকড়ির বোঝা, আর কুকুরের নিরাপদ আশ্রয়। হারিকেন বা কুপির টিমটিমে আলোতে নামায পড়া হয়। মাঝে মাঝে দমকা বাতাসে চিৎপটাং। কি আর করা! তাই অন্ধকারেই পূর্ণ হাসিল করা। রমজানে মসজিদে জামাতে নামাজ পড়লে সত্তর গুণ সওয়াব। তাই ইফতার করেই দৌড়ে মসজিদে গমন। নামাজ শেষ। আবার সদলবলে ঘরে গমন। কিছু বিঁড়ি খোর আছে। বিঁড়িখোরদের সারাদিন বিঁড়ি-সিগারেট পান করতে না পারায় একবারে জীবনটাই শেষ। তারা বলে-"আল্লায় বাঁচাইছে। না খাইয়া রোজা রাহা যায়। বিঁড়ি-সিগেরেট না খাইলে সব খালি খালি লাগে। তাড়াতাড়ি ধরা।" মুরুব্বিদের থেকে একটু দূরে, আড়ালে গিয়ে 'বোম্বা' টানাটানি। ধুয়ার কুন্ডুলি আকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত। আহারে, কী সুখ, কী শান্তি! পাছে ধরা খেতে পারে-এই ভয়ে লেবুর পাতা দিয়ে দাঁত মেজে এক্কেবারে পুত-পবিত্র। এর থেকে ভালো মানুষটি আর হয় না। সামান্য একটু ইফতারে ক্ষুন্নিবিত্তি নিবারন করা হয়েছে। তাই মাগরিবের নামাজের পরপরই সব ঘরমুখো। মা-বোনদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। দ্রুত নামাজ পড়ে তারা পাটি-ছিউনি-পিড়া বিছিয়ে রাখেন। কাঠের 'দেড়উয়ার' উপর টিমটিম করে লাল কেরোসিনের কুপি বাতি জ্বলে। এ সন্ধ্যাবাতি জ্বালানো অবস্থায় রাতের "ডিনার" শেষ।
অধিকাংশ মানুষই গরীব। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। ত্রিশংঙ্কু অবস্থা। মাছ-মাংস কেনার তৌফিক নাই। তাই আগের থেকেই প্রস্তুতি নিতে হয়। বিশেষ বিশেষ সময়ে অনেক মাছ ধরা হয়। এর থেকে কিছু মাছ শুটকি দিয়ে রাখা হয়। ঘরের এক কোণে দঁড়ির মিহি শিক্কা ঝুলিয়ে রাখা আছে । সৌন্দর্যের জন্য একটু রং করা হয়। শুটকি-চোর বিড়ালের থাবা হতে রক্ষাকল্পে শুটকি শিকায় তুলে রাখা হয়। লোভাতুর বিড়াল নীচে লাফালাফি করে। পান না, তাই খান না-মিউ মিউ করে চলে যায়। সেই শুটকি দিয়ে সন্ধ্যা বেলায় ভক্তা, ভাজি, শাকসবজি, ডাল ইত্যাদি দিয়ে চালিয়ে দেয়া হয়। অবুঝ শিশু রোজা রেখে মাকে বলতো, "মা, মাছ-তরকারি কতো কিছু রাইনছেন, আঁরে এট্টো দেন না।" এমনতেই নিষ্পাপ শিশু, রোজা রেখে বেহাল দশা। মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মায়ের হৃদয় বিগলিত হয়ে যায়। "হ রে মা/বাবা, তুই একটু খা। বড়রা চাইছ না। বেহেন রাইতে খাইছ। হরের দিন অনেক বড়। কষ্ট কইরা রোজা রাখতে অইবো।" দুই একজন চাইলে আর যায় কোথায়? মিষ্টিমধুর বকুনি। "দুই হইসা আয় কইত্তে হারস না। জিব্বা লম্বা অই গেছে। হাপের লাহান লিকলিক করে।" লা-জবাব। বেকার-বেআক্কেল ছেলে অগত্যা মায়ের বাক্য শিরোধার্য মেনে নিয়ে সামনে যা পেয়েছে তা দিয়ে গিলে সেরে উঠতো। (চলবে)
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh