ছবিঃ সংগৃহীত।
"মা, হানির তিরাসে বুকডা এক্কার হাডি যাইতেছে। আর হারি না। রোজাডা বাইঙ্গা হালাই।"
-"নারে
বাবা। হারা দিন কষ্ট কইরা রোজা রাখছত। তোর লাইগ্যা বালা কইরা ইস্তার বানাইতেছি। একটু গুইরা আয়। একটু হরেই আযান দিব।"
-"আইচ্ছা
মা, আঁই একটু খেইল্যা আই।"
-"হ,
যা।"
এভাবেই
ছোট্ট ছেলেটাকে বুঝ দিল রহিমা বেগম। গ্রাম-শহর নির্বিশেষে সব শিশু-কিশোরের
কাছেই রোজার আবেগ-উচ্ছ্বাস -অনুভূতি-মর্যাদা-কষ্ট প্রায় একই রকম। তবুও রোজাকেন্দ্রিক গ্রামীণ সংস্কৃতি শহুরে সংস্কৃতি থেকে ভিন্নতর। প্রিয় পাঠক, আপনিও ইচ্ছা করলে স্মৃতির ডালা খুলে নিজেকে ফেলে আসা শৈশবে নিয়ে যেতে পারেন। আর শৈশব মানে
গত শতাব্দীর সত্তর-আশির দশক।
আরবি
বার মাসের নাম অনেকেরই অজানা। তবে, শবেবরাতের কল্যাণে শাবান ও রমজান মাসের
নাম অনেকেরই জানা। শাবান মাস থেকেই বেশ জোরসে রোজার মাসের প্রস্তুতিপর্ব আরম্ভ হতো। রোজা, নামাজ, পবিত্র কোরআন শরিফ পাঠ, ইফতারি, তারাবি, সেহরি রমজানের বিশেষ অনুষঙ্গ।
ইফতারকে
আঞ্চলিক ভাষায় বলা ইস্তার। মুড়ি (উরুম) ইফতারের একান্ত অপরিহার্য উপকরণ। রোজার আগেই ধুম পড়তো মুড়ি ভাজতে। সব ধানে মুড়ি
হয় না। মুড়ির জন্য বেশ হৃষ্টপুষ্ট ও সুগন্ধি হওয়ায়
দেশীয় 'গিগজ' ধানের অনেক কদর। 'কনকতারা', 'বটেশ্বর' জাতীয় দেশীয় প্রজাতির ধান দিয়েও ভাজা হতো মুড়ি। এর পিছনে থাকতো
অনেক কসরত-শ্রম। মাটির বড় মটকা/নাইন্দাতে
ধান ভিজিয়ে রাখা হয়। প্রখর রোদে শুকিয়ে টনটনে করা হয়। ঘরে ঘরে ঢেঁকি। ধান থেকে চাল তৈরির জন্য ঢেঁকির কোন বিকল্প ছিল না। রোজার আরেকটা অপরিহার্য অঙ্গ চিড়া। একটু ভেজা ধান আবার পানিতে ভিজিয়ে পরদিন ঢেঁকিতে ছেটে চিড়া বানানো হয়। দেশীয় ধান। তাই চিড়ার রং লালচে। শতভাগ
নির্ভেজাল। ঢেঁকিতে বারার ধূমধাম আওয়াজ যেন কামান দাগায়। চারিদিকে ঢেঁকির গ-ড়-ড়-ড়, গ-ড়-ড়-ড় শব্দে
রীতিমতো ভূমিকম্প! বহুদূর থেকে আসা আওয়াজে কান হয় ঝালাপালা। কাছে
থাকলে মাইকের শব্দে কথা না বললে মানুষ
বলে কাউকে বেঙ্গায়।
মুড়ি ভাজতে
হয় আগুনের ঘনঘনে লেলিহান শিখায়। কি যে কষ্টের
তা ভাষায় প্রকাশের অতীত। সাধারণ্যের তেমন জ্বালানি ছিল না। কুড়ানো পাতা-লতা, নারিকেল-সুপারির খোল, ধানের নাড়া, পাটখড়ি (হরমুল) ইত্যাদি ছিল জ্বালানি। কিন্তু ফৎফৎ করে জ্বলে যাওয়া এসব খড়কুটা দিয়ে মুরি ভাজা যায় না। গাছ কেটে লাকড়ি করা হয়। এ দিয়ে উনুন
লালে লাল করা হয়। এক পাতিলে চাল
অন্য পাতিলে বালি (বালু) দীর্ঘক্ষণ ধরে নারিকেলের ছোট সাইজের সলা দিয়ে নাড়তে নাড়তে জীবন সারা। প্রচন্ড উত্তপ্ত বালুর পাত্রে একজন চাল ঢেলে দেন, অন্যজন চোখ-মুখ বন্ধ করে দ্রুতগতিতে সলা দিয়ে নাড়তে থাকেন। অল্প সময়েই সরু চাল রূপান্তরিত হয় হৃষ্টপুষ্ট ধবধবে
সাদা মুড়িতে। প্রচন্ড গরমে-ঘামে মা-বোনদের জীবন
দুর্বিসহ হয়ে উঠে। এভাবে সারাদিন চলে মুড়িভাজা। আর আমরা কী
মজা করে উপাদেয় মুড়ি খাই। এর পিছনে মা-বোনদের অমানুষিক পরিশ্রমের কথা খুব একটা মনে থাকে না। দীর্ঘদিন মুড়ি রাখার জন্য আলকাতরার প্রলেপযুক্ত বড় বড় টিন
ছিল। ঘরের কাড়ে বহু টিনে ঠাসা। এজন্য আলাদা করে চুন/রং দিয়ে কাড়
ভর্তি হতো মুড়িসহ অন্যান্য জিনিসের টিনে।
ঢেঁকিছাটা
চাল দিয়ে প্রস্তুত রঙিন চিড়া। মানুষের নারিকেলের অভাব নাই। কেনা কেবল বাজারের গুড় (মিডাই)। আর কী
চাই? আর সারাদিনের তপ্ত-তৃষিত হৃদয় শীতল করার মহৌষধ হল কলের ঠান্ডা
পানি। ঢগঢগ করে দুই-চার মগ-গ্লাস-বাটি
খেলে কলিজা ঠান্ডা। ইফতারির আয়োজন সীমাবদ্ধ থাকতো চিড়া, মুড়ি, নারিকেল, গুড় ইত্যাদিতে। আসরের নামাজের পরেই ছোটরা চাপাকলের পানি দিয়ে জগ-বালতি পূর্ণ
করে রাখে। তবে, অধিকাংশ বাড়িতে চাপাকল ছিল না। পানি সিদ্ধ করার অভ্যাসও নাই। তাই চোখের আন্দাজে বিশুদ্ধ মনে করে নদী-খাল-বিল-পুকুরের পানি দিয়েই তৃষ্ণা নিবারণ করা হতো। বলাবাহুল্য, এমন দূষিত পানি পান করে হাজারো রোগের সূতিকাগার ছিল এক একটা মানুষের
দেহ। বল/গামলা/পাতিল/ডেকচিতে পানি রেখে চিড়া, মুড়ি, কোরানো নারিকেল, গুড় মিশিয়ে হাত দিয়ে ডলে মিহি করা হতো। ডলতে ডলতে হাত প্রায় অবশ। ছোট্ট শিশুটি বলে উঠে-"মা, আঁর আতের আঙ্গুল বিঁআ অই যাইতেছে।" সংসারের
ঘানি টানতে মায়ের জীবন শেষ। অযথা কুপিবাতি বা হারিকেনের তেলের
খরচ কিভাবে জুটাবে? তাই দিনেই পারলে চার হাতে কাজ শেষ করতে গলদঘর্ম। হাত-পা চলে বিদ্যুৎ
গতিতে। এর মাঝে রোজাদার
শিশুর এমন করুণ আর্তিতে মমতাময়ী মা বিগলিত। স্নেহের
পরশ দিয়ে শিশুটিকে একটু আদর করে বলেন-"মা-সোনা, তুই
অনেক লক্ষ্মী। আল্লায় তোরে আঁর চুলের চেয়েও বেশি হায়াত দেক। রাইখ্যা দে। আঁই কইরাম।" এই ফাঁকে শিশুটি
একটু খেলা করতে যায়। তার সাথী মুখ নাড়তে দেখে বলে-"হায়, হায়! তুই না রোজা। বাইঙ্গা
হালাইছত?" ও কানের কাছে
মুখ নিয়ে চুপিচুপি বলে-"ইস্তারির একচাক মিডাই খাইতেছি। কারোরে কইচ্ছা। তুইও একটু খা।" দুইজনে ভাগ করে খায়। হেসেখেলে সন্ধ্যা সমাগত। আবার এক দৌড়ে মায়ের
কোলে।
ইফতার
তৈরিতে যুগালদারের অভাব হতো না। কম-বেশি সকলে
হাত দিত। পাঁচমিশালির মিশ্রণে রং-স্বাদ হতো
ভিন্ন রকমের। খুব কম মানুষের কাগজি-লেবু ছিল। এমন মানুষেরা অতি ভাগ্যবান। কাগজি-লেবুর মৌ মৌ গন্ধে
আপ্লূত হয়ে যেতো রোজাদার। এমন ঘরের শিশুর ফুটানিতে টেকা বড় দায়। গর্ব
করে বলে-"আইজ আমরা ইসপিশিয়াল ইস্তারি খাইছি।"
রোজার
মাস সব স্কুল বন্ধ।
খাওয়া-দাওয়া -ফুর্তি করা, বেড়ানো ছাড়া আর কোন কাজ
নাই। অধিকাংশ অভিভাবক নিরক্ষর। কোন ভ্রক্ষেপ নাই। তাই শিশুর পড়াশোনা শিকেয় উঠে। তবে, প্রায় সব বাড়িতে ছিল
কাচারি। লজিং অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রথা। স্কুল-মাদ্রাসার ছাত্র বা শিক্ষক ছিলেন
লজিং মাস্টার। কাচারিঘর ছিল তার আবাস। অনেকে বলেন- গাডারাগের হুজুর বা তালেবালিম। আযান
দেয়া, নামাজ পড়ানো, বাংলা ও আরবি পড়ানো
ইত্যাদি তার কাজ। বয়স কম। কিন্তু কদর বেশি। সকলের নিকট অত্যন্ত সম্মানিত। ডিগ্রি পাস না করলে ঘড়ি
পরা যাবে না-এমন কথা
শুনা যেতো। প্রবচনটি "পান না তাই খান
না" ধারণা থেকে উৎসারিত কি-না অনুসন্ধিৎসু
সুলুকসন্ধানে বের হোক। আযানের আগেই থালায়-মগে বেড়ে দেয়া হতো পাঁচমিশালির ইফতার। সারাদিনের রোজা। সময় আর শেষ হয়
না। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে প্রায় খানখান। ছোট্ট শিশুটির বারবার প্রশ্ন-"মা আর কতক্ষণ?
সূর্য কহন ডুইব্যা গেছে। হুজুরে আযান দেয় না কেন? খালি
খালি দেরি কইত্তেছে? আঁই ইস্তার খাইয়া হালাই। ইস্তারের সময় হইলেও হুদাহুদি দেরি করে। আবার বেহেন রাইতের সময় শেষ না অইলেও অনেক
আগে শেষ-শেষ কইয়া চিল্লায়।" এমন কতো অভিযোগ বেচারা হুজুরের বিরুদ্ধে। (চলবে)
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh