× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা জামায়াত বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

১৮৬৫ টাকার কবর (শেষ পর্ব)

মাকসুদুর রহমান পাটোয়ারী

০৬ মার্চ ২০২৫, ১৯:০৭ পিএম

ছবিঃ সংগৃহীত।

পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে কোটি কোটি মানুষ এসেছে এই ধরনীতলে। তন্মধ্যে হাজার হাজার মহামানব, রাজা-বাদশা, লাট সাহেব-প্রজা, প্রভাবশালী-সাধারণ মানুষ, বীরবাহাদুর-শীর্ণকায় ব্যক্তি, বিশাল সম্পদশালী-ভিক্ষুক, বিশ্ব সুন্দরী-কুৎসিত, কালো-ধলাও ইত্যাদি ধর্ম-বর্ণ-চেহারা-অবয়বের বিচিত্র মানুষ পৃথিবীতে এসেছে। কতজন কত দম্ভ-অহংকার করেছে, কারও পদভারে ধরনীতে ধুলির ঝড় বইতো। ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করায় ভয়ে হৃদকম্প হতো। মানুষকে চিরশান্তির অমোঘ বাণী শুনাতো। আজ তারা কোথায়? সামান্য কিছু ছাড়া অধিকাংশের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই। মাটিতে মিশে একাকার হয়ে গেছে। এমনকি তিন পুরুষের আগের বংশধরের নাম পর্যন্ত অনেকে জানে না। এটি অনস্বীকার্য বাস্তবতা।

এই পরিণতি আমাদের ভোগ করতেই হবে। কোনো বিকল্প নেই। তাহলে কীসের নেশায় আমরা মত্ত? কেন আমরা এত অন্যায়-অত্যাচার-অবিচার, হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার-আত্মগরিমা, লোভ-লালসা, নাম-যশ-খ্যাতি, শৌর্য্য-বীর্য, শক্তি-সামর্থ্য, শান-শওকত, পোশাক-পরিচ্ছদ, ধন-দৌলত, ক্ষমতা-বাদশাহী প্রদর্শন করি? সবকিছুই মাটিতে মিশে যায়। মাটি থেকে সৃষ্ট, মাটিতেই কবর দেয়, বা শশ্মানে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেয়। অবশেষে মাটিতে মিশে গিয়ে শেষ হয় চূড়ান্তরূপে।

তাহলে কেন চল-চাতুরী, দাপট, কলাকৌশল করে, হারাম পথে অজস্র সম্পদ রেখে যাওয়া? কয়দিন পরে মৃত ব্যক্তি স্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। শুরু হয় বংশধরদের নতুন জীবন। কালেভদ্রে মনে হয় পূর্ব-পুরুষকে। কবি জসীমউদ্দিনের "তিরিশ বছর ভিজিয়ে রেখেছি দুই নয়নের জ্বলে"-এমন আবেগময় পংক্তি কেবল কবিতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, বাস্তবে দেখা খুবই কঠিন।

মৃত্যুর কি কোনো গ্যারান্টি আছে? অবশ্যই না। সুবিদিত যে, আজরাইল (আ.) জান কবচের জন্য প্রতিটি মুহূর্তে প্রস্তুত। প্রতিটি মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে শতশত মানুষের জান কবচ করেই চলছেন। যেমনটি ফিরোজ সাঁই গেয়েছেন-
"এক সেকেন্ডের নাই ভরসা
বন্ধ হবে রঙ তামাসা
চক্ষু মুদিলে
হায়রে দম ফুরাইলে।"

তবুও মানুষ আশা করে- অনেক অনেক দিন বাঁচবে, অমরত্ব পাবে। পৃথিবীটা আমার চাই, আরো চাই-এমনই লোভে মত্ত। এ দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২.৩ বছর। জনসংখ্যার প্রায় ৬% মানুষের বয়স ৬৫-এর উপরে। একটি একেবারে বেহুদা, মূল্যহীন এবং শতভাগ অনিশ্চিত যুক্তি দেয়া যাক। ধরা যাক- ৬৫ বছর বয়সী প্রায় এক কোটি মানুষকে অনুমান ৮০ বছর পর্যন্ত মহান আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখতে পারেন। এভাবে ২০৩৭ সালের মধ্যে এদের পৃথিবী শেষ! সময় শেষ হচ্ছে বিদ্যুতের গতিতে। সেদিকে খেয়াল নেই। কেবল চাই এবং চাই। চাওয়ার কোনো শেষ নেই। যেমন বলেছেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-
"এ জগতে হায়
সেই বেশি চায়
আছে যার ভুরি ভুরি।
রাজার হস্ত করে সমস্ত
কাঙালের ধন চুরি।"

সুরা আল ইমরান, আয়াত-২৬-এ বর্ণিত, "বলুন, হে আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করো এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করো আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পতিত করো। তোমারই হাতে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাশালী।"

এক সময়ের আসমুদ্রহিমাচলের মালিক ছিলেন প্রবলপ্রতিসম্পন্ন মোঘল সম্রাটগণ। তাঁদের শেষ বংশধর, ইয়াঙ্গুনে নির্বাসিত সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের কবরের জন্য ভারতবর্ষে দুই গজ মাটিও কপালে জুটেনি। এজন্য তিনি আক্ষেপ করে লিখেছেন-
"কিতনা বদনসীব জাফর দাফন কি লিয়ে,
দো গজ জমিন ভি মিল না সাকে কুওয়ে ইয়ার মে।"
(জাফর, তুমি কতই দুর্ভাগা যে দাফনের জন্য নিজের প্রিয় জন্মভূমিতে দুই গজ মাটিও মিললো না)।

প্রখ্যাত শিল্পী আবদুল আলিম গেয়েছেন-
"পরের জায়গা পরের জমিন, ঘর বানাইয়া আমি রই
আমি তো সেই ঘরের মালিক নই।"

Alexander Selkirk জনমানবশূন্য নির্বাসিত দ্বীপে একা। সকল সম্পত্তির মালিক। আক্ষেপ করে বলেন-
"I am monarch of all I survey." কিন্তু তার কোনো সম্পদই কাজে লাগেনি। প্রায় অর্ধ-পৃথিবীর মালিক ছিলেন Alexander the Great। মৃত্যুর পূর্বে সকল সেরা চিকিৎসকও তাঁর প্রাণ রক্ষা করতে পারেনি। দুনিয়া জোড়া সম্পদ কোনো কাজে আসবে না- এটা জেনে তার সহচরদের নির্দেশ দিলেন। মৃত্যুর পর যেন তার দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে রাখা হয়। অর্থাৎ পৃথিবী জয় করে ধন-রত্নে পূর্ণ হলেও তিনি শূন্য হাতে বিদায় নিচ্ছেন। আসলে 'জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা রবে।'

নিজের রক্ত সম্পর্কের আত্মীয় আর দূর সম্পর্কের আত্মীয় বা অপরিচিত জনের লাশ দাফনের মধ্যেও গভীর পার্থক্য আছে। মৃত মানুষের দেহ স্পর্শ করা, একাকী রাতে পাশে থেকে পাহারা দেয়া, গোসল করানো, সমাহিত করা, কবরের পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা ইত্যাদির অনুভূতি হৃদয়ঙ্গম করলে মৃত্যুর কিছুটা অনুভূতি পাওয়া যেতে পারে। যাহোক, জীবন আর মৃত্যুর পার্থক্য আকাশ পাতালের থেকেও হাজারো গুণ বেশি। কোনোভাবেই পরিমাপযোগ্য নয়।

এজন্য জনমুখী রাষ্ট্রনায়ক হওয়া, সঠিকভাবে দেশ পরিচালনা করা, নাগরিকদের রাষ্ট্রের আইন-কানুন যথাযথভাবে পালন করা, স্ব-স্ব ধর্ম অনুযায়ী নির্ধারিত বিধিবিধান অনুসরণ করা, সৎ থাকা, সদাচরণ করা, প্রত্যেক মানুষকে গুরুত্ব দেয়া, হক-হালাল পথে চলা, অন্যায়-অবিচার-অত্যাচার-জোর-জবরদস্তি না করা, সুনাগরিক হওয়া আবশ্যক। এটি রাষ্ট্র, সমাজ এবং ব্যক্তি-সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

পৃথিবীর সকল মানুষ কখনই সমান হবে না, হতে পারে না। সৎ কর্ম, মেধা, মননশীলতা, দক্ষতা, যোগ্যতা, কঠোর পরিশ্রম ইত্যাদি গুণে সামাজিক স্তরবিন্যাস থাকবেই। অন্যের আছে বলে জোর-জবরদস্তি করে, যে কোনো উপায়ে আমারও থাকতে হবে-এমন মানসিকতা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। বরং অনেকের তুলনায় আমি বেশ ভালো আছি-এমন মানসিক দৃঢ়তা থাকলে বহু সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে। নিচের দিকে তাকালে অনেক উত্তর পাওয়া যাবে। নিজ আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষা জীবনের দিকে তাকালে দেখা যায়-অনেকের তুলনায় যথেষ্ট ভালো। শারীরিকভাবে পঙ্গু, বিকলাঙ্গ, কঠিন অসুস্থতায় হাসপাতালে কাতরানো মানুষের তুলনায় কত সুখ! যার ঘরে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন একজন আছে সেই পরিবার বুঝে জীবন কত অসহনীয়, দুর্বিসহ। না পারে ত্যাগ করতে, না পারে সুস্থ করতে। অথচ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অশেষ অনুগ্রহে আমি-আপনি, আমার-আপনার পরিবার কত সুখী! চোখের সামনে কত উত্তর। Alexander Pope এর ভাষায়-
"Happy the man, whose wish and care
A few paternal acres bound,
Content to breathe his native air,
In his ground."

পরকাল অনন্তকাল। এর শুরু আছে, শেষ নেই। কবরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোট-বড় সকল সম্পদের হিসাব-নিকাশ দিতে হয়। ভালো বা মন্দ আমলের ভিত্তিতে মহান আল্লাহ নিখুঁত, নিপুণ নিক্তিতে সুক্ষ্ম বিচার করবেন। এরপর শুরু হবে অনন্ত জীবন, কঠিন বাস্তবতা। এর কোনো বিকল্প নেই। পৃথিবীতে কেউ কখনো ফিরে আসেনি, ফিরে আসার কোনো পথও নেই। তখন আফসোসের সীমা থাকবে না। তাই এখনও সময় আছে। মহান আল্লাহ মহাক্ষমতাশালী, সকল দয়ার উৎস। তিনি আমাদের অতীতকে ক্ষমা করে দিন। ভবিষ্যতে যথাযথভাবে বাঁচার, চলার তৌফিক দিন।

সুরা ফাতিহার মতো করে করজোড়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অনুগ্রহ প্রার্থনা করি-
"আমাদেরকে সহজ-সরল পথে পরিচালিত করো। সেই সকল লোকের পথে, যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছো। তাদের পথে নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট হয়েছে।"

Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.