ছবিঃ সংগৃহীত।
কবর খনন মাত্র ১৯ টাকা, বাঁশ কেনা ৬৯০ টাকা, ছাটাই ১৫৬ টাকা, রেজিষ্ট্রেশন ১,০০০ টাকা সর্বমোট ১,৮৬৫ টাকা। চিরস্থায়ী জায়গার খরচ। মাঝারি কবর ৩৬২ টাকা এবং ছোট কবর ১৬১ টাকা মাত্র। দেশের সর্ববৃহৎ এবং অন্যতম প্রাচীন আজিমপুর কবরস্থানের অনুমোদিত খরচ। সঙ্গে অল্প দামের কিছু সাদা কাফনের কাপড়। সামর্থ্য অনুযায়ী আগরবাতি, গোলাপজল ইত্যাদি। এমন কঠিন ও নির্মম সত্যের দৃশ্যমান বাস্তবতা প্রত্যহ দেখতে হচ্ছে এই কবরস্থানে। একদিন যার দম্ভ-অহংকার-হুঙ্কার -অবৈধ প্রভাবে থরথরি কম্প হতো, তিনিই কবরদেশে একবারে একাকী। মিশে গেছেন মাটির সঙ্গে। পৃথিবীতে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু মার্কসীয় মতবাদের চূড়ান্ত ও অকাট্য প্রমাণ এখানে বিণা বাক্যব্যয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। স্হায়ীভাবে বাঁধাইকৃত, নামফলক পাথরে খোদাইকৃত মরিচাধরা, অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। এসব দূরাবস্থা দেখে প্রতীয়মান হচ্ছে তাদের অনেকেই ছিলেন এক সময়ের মহাদো দন্ড ক্ষমতাশালী। সাম্যবাদের দৃশ্যমান স্থানটিও টাকার পাহাড়ওয়ালাদের দখলে থাকবে-তা কি করে হয়? তাছাড়া, সমাজে কোটিপতির সংখ্যাও দিন দিন দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। কোটি কোটিও না-কি অতি সামান্য! টাকা দিয়ে চিরস্থায়ী ঠিকানা কিনে নিলে বিপুল জনসংখ্যার দেশটিও "অর্থশালীদের কবরস্থান"-এ পরিনত হয়ে যেতে পারে। কবরের জন্য কোন বৈষম্য নাই, স্থানও নাই। তাই এখন কবরের জায়গা বেচা বন্ধ।
অঢেল
অর্থ রেখে যাওয়ায় পায়ের উপর পা তুলে মনের
সুখে খাচ্ছে-দাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যা ইচ্ছা তা
করছে-এমন মহাসুখীদের উত্তরাধিকারীরা কিভাবে অকৃতজ্ঞ হয়? কৃতজ্ঞতা-শ্রদ্ধার জাজ্বল্যমান প্রমাণ রাখা চাই। পাতলা টিনের উপর মৃতের/পূর্ব-পুরুষের সংক্ষিপ্ত নাম-ঠিকানা লিখে কবরের শিয়রে গেঁথে রাখা হয়। নেট খরচ কতো হবে-সর্বোচ্চ ২০০ টাকা। কতো অপকর্ম-অপকৌশল করে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে রেখে এসেছেন। বাস্তববাদী ও বুদ্ধিমান উত্তরাধিকারী
ফকিরের ভিক্ষার মতো খরচ করেছেন মাত্র কয়েক টাকা। এসবও
একসময়ে দেখার কেউ নাই। কিছু দিন পরে হেলে পড়ে চিৎপটাং। আহা! কৃতজ্ঞতা- ভক্তি-শ্রদ্ধার অপূর্ব নিদর্শন!
সারা
পৃথিবীর মালিক ছিলেন। পাহাড় সমান টাকা। "দুনিয়াটা মস্ত বড়ো, খাও-দাও-স্ফুর্তি করো"-এই ফর্মুলায় চলতেন।
সেই বাহাদুরি- বড়াই-দোদন্ড প্রতাপ নিশ্বাসের সঙ্গে শেষ। এখন সব বরবাদ। "নো
খাতির, নো কম্প্রোমাইজ।" বলা হয়
দেহের আকারানুযায়ী লম্বায় সাড়ে তিন হাত। বাস্তবে একটু বেশি। লম্বায় সাড়ে চার হাত আর পাশে দুই
হাত থেকে অবস্থাভেদে একটু কম- বেশি। আজিমপুর গোরস্থানে কবর আর কবর। হাজার
নয়, লাখ-লাখ। গুণে শেষ করার উপায় নাই। গোরখোদকরা মহা ব্যস্ত। প্রতিদিন গড়ে ৩০/৪০ জন।
করোনার মতো মহামারীর মৌসুম হলে তো কথাই নাই।
লাশের মিছিল। তাহলে বছরে কতো হাজার-হিসাব করলে কিতাব মিছা।
গোরস্হানেরও
সীমাবদ্ধতা আছে। বিকল্পও নাই। তাই কয়েক বছর পরে একই কবরের উপর আরেক কবর। আগের কবর আর পরের কবরবাসীর
মান-মর্যাদা, গৌরব-কৌলীন্য, ওয়ারেন্ট অর প্রেসেডেন্স খোঁজার
সময় নাই। চেষ্টাও নাই। কোন ফাঁকে সামান্য একটু জায়গা পাওয়া গেছে। এতেই বংশধরগণ ধন্য। এভাবে হাজার হাজার কবরের মাঝে কোটি কোটি টাকার মালিক ইহজগতেও হারিয়ে গেছেন। কবরের রাজ্যে বিলীন হয়ে গেছেন। কেউ কেউ বলেন-এক কবরের উপর
চল্লিশ কবর দেয়া হয়ে গেলে কিয়ামত আসবে। দেশের সকল মানুষ ঢাকামুখি। গ্রামবিমুখ। সেকারণে কিয়ামত আসন্ন কিনা মহান আল্লাহ ভালো জানেন। তবে, আমাদের আচরণ-লক্ষণ কিন্তু ভালো না। গাঁও-গ্রামেও শতবর্ষী কবরস্থানে কার কবর কোথায় খবরও রাখে না। খুঁজেও পাওয়া যায় না। এটাই নিষ্ঠুর বাস্তবতা।
পৃথিবীটা
ঘুরছে তো ঘুরছে। সকলেই
কিছু না কিছুর পিছনে/নেশায় মত্ত হয়ে ঘুরছে আর দৌঁড়াচ্ছে। কেউ
পেটের ক্ষুধা নিবারনে ভিক্ষার জন্য এক বেলা পেলেই
খুশি। কেউ পরের বেলা, কেউ আগামী কাল, কেউ আগামী সপ্তাহ, কেউ বছর, কেউ আজীবন দৌঁড়াচ্ছে ধন-সম্পদের পিছনে
দৌঁড়াচ্ছে। এমন গোগ্রাসে গেলা, পরের
সম্পদ আত্মসাৎ, প্রতারণা, হম্বিতম্বি, শঠতা, ঘুষ, দুর্নীতি-এসব কার জন্য? মারা গেলে স্বামী-স্ত্রী -পুত্র-কন্যার শোক দুই-তিন দিন। এর পরে ধীরে
ধীরে সব হারিয়ে যায়
কালের করাল গহ্বরে। মনে হয় কিছুই ঘটেনি।
আল্লার মাল আল্লায় নিয়া গেছে। জীবনতো থেমে থাকে না। তাই কর্মব্যস্ত জীবনে অনেক সময় কবর জিয়ারত করার সময় হয় না। "চিনস্
আমারে/দেখে নিব/মাডির সঙ্গে মিশাইয়া দিব/চৌদ্দ গোষ্ঠীর নাম ভুলাইয়া দিব" বলে যে বাজার গরম
করা হুংকার দিতেন, তিনি আজ কবর দেশে
একবারে একাকী। মাটির সঙ্গে নিজেই মিশে গেছেন। তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে কিছু দান-খয়রাত করার মানসিকতাও উত্তরাধিকারীদের থাকে না।
বলা
হয়-দাফন করার ২৪ ঘন্টা পরে
মৃতদেহের ভিতরে পোকা সৃষ্টি হয়। পায়ুপথ দিয়ে বের হতে থাকে। সৃষ্টি হয় দুঃসহ দুর্গন্ধ।
শতশত পোকামাকড় দ্রুত সবেগে এসে শরীরের মাংস নিঃশেষ করে দেয়। ছয় দিন পরে নখ, নয় দিন পরে চুল খসে পড়া শুরু হয়। পরে সমস্ত লোম ঝরে পড়ে। ৬০ দিন পরে
পুরো শরীর একটা কঙ্কালে রূপ নেয়। ৯০ দিন পরে
হাড়গুলি খসে পড়ে যায়। প্রায় এক বছর পরে
হাড়গোড় মাটির সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়।
মাটি
হতে মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কে দয়াময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, "স্মরণ করো, তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বলেছিলেন, আমি (আল্লাহ) মানুষ সৃষ্টি করছি কাদামাটি থেকে। যখন আমি তাকে সুষম করব এবং তাতে আমার রুহ সঞ্চার করব, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হয়ো।" (সুরা: সাদ, আয়াত: ৭২-৭৩) মুসলমানদের
আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) এঁর সৃষ্টি সম্পর্কে মহান আল্লাহর এমনই বির্নিদেশ। আদম (আঃ) থেকে শুরু করে বংশ পরম্পরায় মানুষ সৃষ্টি হয়েছে, হচ্ছে। মহান আল্লাহ আরও বলেন, "আর অবশ্যই আমি
মানুষকে মাটির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করেছি।" (সুরা ২৩: মুমিনুন, আয়াত: ১২)
"মিনহা
খালাকনাকুম ওয়া ফিহা নুয়্যিদুকুম ওয়ামিনহা নুখরিজুকুম তা রাতান উখরা।"
[আমি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি, আর মাটিতেই তোমাদেরকে
ফিরিয়ে আনবো। পুনরায় তোমাদেরকে মাটি থেকে বের করবো। (সুরা ত্বহা: আয়াত-৫৫)]
পানি,
মাটি, আগুন, বায়ু-এসব সৌরজগতসহ পৃথিবী সৃষ্টির মূল উপাদান। মানুষের শরীরে এসব উপাদানসহ বহু বিচিত্র উপাদান রয়েছে। মূল কথা-মানুষ মাটির তৈরি। উহা প্রত্যক্ষভাবে আদি পিতা আদম (আ.) এবং পরোক্ষভাবে আদম সন্তানদের ব্যাপারে প্রযোজ্য।
পৃথিবী
সৃষ্টির পর থেকে কোটি
কোটি মানুষ এসেছে এই ধরণীতলে। তন্মধ্যে
হাজার হাজার মহামানব, রাজা-বাদশা, লাট সাহেব-প্রজা, প্রভাবশালী-সাধারন মানুষ, বীর-বাহাদুর -শীর্ণকায় ব্যক্তি, বিশাল সম্পদশালী-ভিক্ষুক, বিশ্ব সুন্দরী-কুৎসিত, কালো-ধলো ইত্যাদি ধর্ম- বর্ণ-চেহারা-অবয়বের বিচিত্র মানুষ পৃথিবীতে এসেছে। কতোজন কতো দম্ভ-অহংকার করেছে, কারও পদভারে ধরনীতে ধুলির ঝড় বইতো। ত্রাসের
রাজত্ব কায়েম করতো। ভয়ে মানুষের হৃদকম্প হতো। আবার কেউ মানুষকে চিরশান্তির অমোঘ বাণী শুনাতো। আজ তারা কোথায়?
সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশের কোন চিহ্ন পর্যন্ত নাই। মাটিতে মিশে একাকার হয়ে গেছে। এমনকি তিন পুরুষের আগের বংশধরের নাম পর্যন্ত অনেকে জানে না। ইহা অনস্বীকার্য, কঠিন বাস্তবতা।
এই পরিণতি আমাদের ভোগ করতেই হবে। কোন বিকল্প নাই। তাহলে কীসের নেশায় আমরা মত্ত? কেন আমরা এতো অন্যায়-অত্যাচার- অবিচার, হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার-আত্মগরিমা, লোভ-লালসা, নাম-যশ-খ্যাতি, শৌর্য্য-বীর্য, শক্তি-সামর্থ্য, শান-শওকত, পোশাক-পরিচ্ছদ, ধন-দৌলত, ক্ষমতা-বাদশাহী প্রদর্শন করি ? সবকিছুই মাটিতে মিশে যায়। মাটি থেকে সৃষ্ট, মাটিতেই কবর দেয়, বা শশ্মানে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেয়। অবশেষে মাটিতে মিশে গিয়ে শেষ হয় চূড়ান্তরূপে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh