ছবিঃ সংগৃহীত
মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া রাজনীতির আড়ালে সন্ত্রাসের গডফাদার। তিনি একজন ঠান্ডা মাথার খুনিও বটে। দুর্নীতির মানসপুত্র এই মায়া’র পরিচয় রয়েছে বিভিন্ন ভাবে। কখনও তিনি জনপ্রতিনিধি আবার কখনও তিনি গনশত্রু। আর এই গণশত্রু পদবীটি তার অপরাধমূলক কর্মকান্ডের স্বাক্ষী। যার শিকার হয়েছেন তারই এলাকার সাধারণ মানুষ। কি সন্ত্রাসে আর কী দুর্নীতিতে তার অবাধ বিচরনের বিষয়টি এখন এলাকার লোকজনের মুখে মুখে। যদিও মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনি সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করেছেন। দেশ প্রেমের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। নামের শেষে পদবী বীর বিক্রম। কিন্তু দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বদলে ফেলেছেন হয়ে উঠেছেন মাফিয়া ডন আর সন্ত্রাসের গড ফাদার। নিজেকে যেমন ডন বানিয়েছেন তেমনি সন্তানদেরও সেভাবেই গড়ে তুলেছেন। রাজনৈতিক অর্জনের সবটুকুই ম্লান হয়ে গেছে তার সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে। এলাকায় তিনি কুড়িয়েছেন ঘৃণা আর ছড়িয়েছেন আতঙ্ক।
১৯৭৫ সালের জেলহত্যা দিবসে মায়াকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল। তিনি ১৯৯২ সাল থেকে ঢাকা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্বে ছিলেন। এরপর ঢাকা মহানগরকে দুভাগে বিভক্ত করা হয়। তখন তিনি দায়িত্ব থেকে অব্যাহিত পান। এরপর ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর মায়াকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়।
মায়া ৭ম সংসদ (১৯৯৬-২০০১) এবং দশম সংসদ (২০১৪-২০১৮) চাঁদপুর-২ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । তিনি ১৯৯৭-১৯৯৮ সালে স্থানীয় সরকার এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী এবং ১৯৯৮-২০০১ সময় নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তিনি ২০০৩ এবং ২০০৪ সালে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০৪ সালে ঢাকায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত সমাবেশে গ্রেনেড হামলার সময় মায়া মানবঢাল তৈরি করে তাদের নেত্রীকে রক্ষা করেন। আর এই কাজের জন্য শেখ হাসিনা দুর্নীতি করার অবাধ স্বাধীনতা পট্রদান করে। শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ সমর্থনে তিনি এলাকায় ডন হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেন। শেখ হাসিনার সময়ে তার বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই মহাবিপদ ডেকে আনা।
দুর্নীতির অভিযোগ এবং দোষী সাব্যস্ত
৫ অক্টোবর ২০০৭-এ, মায়া এবং তার পরিবারের চার সদস্য - স্ত্রী, দুই ছেলে এবং এক পুত্রবধূর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। তিনি যখন নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তখন টাকা নেওয়া এবং ঘোষণা না করার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনা হয়। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে মায়ার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমানিত হলে তাকে ১৩ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। একই সঙ্গে ৫৯ মিলিয়ন টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় আর ৫০ মিলিয়ন টাকা জরিমানাও হয়। তবে তার পরিবারের সদস্যদের বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। মায়া বিচারের সময় দেশের বাইরে ছিলেন এবং তার দল ক্ষমতায় ফিরে না আসা পর্যন্ত তিনি দেশে ফেরেননি। অবশেষে তিনি দেশে ফেরেন যখন তার দল ক্ষমতাসীন হয়। দেশে ফিরে গত ২০ মে ২০০৯ তিনি ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন এবং তাকে কারাগারে নেওয়া হয়। তবে তার মুক্তির বিষয়ে সরকারে সর্বোচ্চ মহল থেকে সবুজ সঙ্কেত থাকায় প্রহসনের মাধ্যমে ২৭ অক্টোবর ২০১০-এ মামলার আপিল জিতে তিনি মুক্তি পান। এসময় আইনের ব্যতয় ঘটিয়ে শেখ হাসিনার আর্শীবাদে বিচারকরা তাকে অভিযোগ থেকে খালাস দেন। দুর্নীতি দমন কমিশন ( দুদক) ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টে মামলাটির একটি আপিল দায়ের করে, যা ১৪ জুন ২০১৫ তারিখে আপিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়। রহস্যজনক বিষয় হচ্ছে মায়ার একটি আপিলের পরেও ২০১৬ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট অভিযোগগুলি বহাল রাখে। কিন্তু অক্টোবর ২০১৮ এ, হাইকোর্ট আবার সেই মামলায় মায়াকে খালাস দেন। যা বিচারবিভাগের উপর নগ্ন হস্তক্ষেপ বলেই মনে করা হয়।
তার অপকর্মের ফিরিস্তি
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের টিকিট পান। এসময় নির্বাচনকে অধিক গ্রহণযোগ্য করতে তৎকালীন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা নির্বাচনে বিশেষ কৌশল নেন। সেই সময় নির্বাচন সকলের জন্য অবাধ করে দিলে অনেকেই স্বতন্ত্রপপ্রার্থী হিসেবে মাঠে নামেন। মায়ার নির্বাচনি এলাকা চাঁদপুর -২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন ইশফাক আহসান। তার ক্লিন ইমেজের কারণে দলটির একটি বড় অংশ মায়ার পরিবর্তে ইশফাক আহসানকে সমর্থন করেন। আর এই সমর্থন কাল হয় আওয়ামী লীগের ত্যাগি নেতাদের জন্য। এরপর শেখ হাসিনার আর্শীবাদ, প্রশাসনের সহযোগিতা আর বিভিন্ন সন্ত্রাসী কায়দায় ভোট চুরি করে মায়া চৌধুরী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আর নির্বাচিত হয়েই তিনি হামলে পড়েন দলের তাগি নেতা কর্মীদের উপর। তার জিঘাংসার শিকার হন মোহনপুর পর্যটন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মিজানুর রহমান। কাজী মিজানুর রহমান এলাকার একজন জনপ্রিয় ব্যক্তি। মায়া চৌধুরীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তিনি বিপুল ভোটে মোহনপুর ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পরপরই মায়া চৌধূরী এবং তার সমর্থকরা কোন ধরনের যৌক্তিক কারণ ছাড়াই কাজী মিজানের বিরোধিতায় নামে। যখন কোনভাবেই কাজী মিজানের চরম জনপ্রিয়তাকে ম্লান করা যায়নি, ঠিক তখনই মায়া চৌধুরী দাবার গুটি ভিন্নভাবে চালতে থাকেন। এরই মধ্যে নিজে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় একচ্ছত্র ক্ষমতা মালিক বনে যান। তখন আইন আদালত প্রশাসন সবই নিজের দখলে নেন। ন্যায় বিচার পাবার পরিবর্তে মায়া চৌধুরীর নির্ধারিত বিচার এলাকায় একমাত্র নিয়ামক হয়ে ওঠে। যেহেতু ক্ষমতায় অবৈধ হাসিনা সরকার আর তার প্রিয়পাত্র এই মায়া চৌধুরী সেই হিসেবে পুরো মতলব উত্তর এবং দক্ষিণ তথা চাঁদপুর ২ আসনের পাট্টা লাভ করেন। এসময় মায়ার বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই নিশ্চিতভাবে নিজের বিপদ ডেকে আনা। সেই বিপদ এতোটাই মর্মান্তিক ছিল যে কোন সময়ে কোন অপরাধ ছাড়াই খুন করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এই সুযোগে কাজী মিজানকে দমাতে তিনি মোহনপুর পর্যটন কেন্দ্রটিতে হামলা চালান। নিজের লোকজন দিয়ে দেশের একমাত্র মিঠাপানির বিজকে কুক্ষিগত করেন। তিনি অবাধে লুটপাট চালিয়ে মোহনপুরকে শশ্মানে পরিণত করেন। এসময় কয়েক কোটি টাকার সম্পদ লুট করে তা আত্মসাৎ করেন। ঘটনার এখানেই শেষ নয় তিনি মোহনপুর পর্যটন কর্র্তপক্ষকে এলাকা ছাড়া করেন। এখানে কর্মরত কয়েকশ মানুষের রুটি রুজি কেড়ে নেন। জীবনের নিরাপত্তার ভয়ে এসব কর্মচারী আর কর্মকর্তারা পর্যটন কেন্দ্র ছাড়তে বাধ্য হন। মায়ার অপকর্ম জাতীর সামনে তুলে ধরতে ঢাকা থেকে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটন কেন্দ্রের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে মোহনপুর যান।
এই খবর জানাজানি হয়ে গেলে মায়া তার সন্ত্রাসী বাহিনী সাংবাদিকদের পিছনে লেলিয়ে দেন। তখনকার প্রত্যক্ষদর্শী দুজন স্থানীয় সাংবাদিক তুহিন ফয়েজ ও ফটো সাংবাদিক ফরিদ উদ্দিন এভাবেই তখনকার ঘটনা তুলে ধরেন। দু সাংবাদিক জানান, ‘ঢাকার সাংবাদিকরা মতলব প্রবেশ করা মাত্রই খবর পৌছে যায় মায়ার কাছে। তিনি তার সন্ত্রাসী বাহিনীকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন। অবস্থা এতোটাই খারাপ হয়ে পড়ে যে সাংবাদিকরা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে থানার সহযোগিতা চান। এমনকি তখন তারা থানাতে যেয়ে নিজেদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চান। কিন্তু মায়ার হাত এতেটাই লম্বা যে থানা প্রশাসন তাদের নিরাপত্তা দিতে অসমর্থ হয়। তখন মায়ার সন্ত্রাসী বাহিনী থানার ভিতর থেকে সাংবাদিকদের অপহরণ করার চেষ্টা চালায়।’ ঘটনার বর্ননা দিতে যেয়ে সাংবাদিক তুহিন ফয়েজ বলেন, এসময় পুলিশের অসহায়ত্ব তিনি কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে বিভিন্ন ধরনের বাধার সম্মুখীন হন। যদিও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পুলিশের কিন্তু তারা সেদিন সে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হননি। যার কারণ, মায়া চৌধুরীর সন্ত্রাস আর শেখ হাসিনা সরকারের আর্শীবাদ।
মি. তুহিন জানান, পুলিশ প্রশাসন অনেকটাই বাধ্য হয়ে মায়ার সহযোগিতা চায়। এসময় মায়াকে বোঝানো হয় ঢাকার সাংবাদিকের উপর হামলা চালালে সেটি রাজনীতিতে খারাপ দৃষ্টান্ত হবে। এমনকি বিষয়টি অনেকদুর গড়াবে। আগত সাংবাদিকরা সকলেই ডিইউজে বা বিএফইউজে অথবা জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য। এদের বেশ কয়েকজন ডিআরইউ’র সদস্য। সুতরাং বিষয়টি খুবই খারাপ হবে এমনকি তা সামাল দিতে বেগ পেতে হবে হাসিনা সরকারের। তাই প্রশাসন থেকে পরামর্শ দেওয়া হয় তাদেরকে স্বসম্মানে ঢাকাতে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এটিই হবে এই মূহুর্তে সবচেয়ে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। সেদিন এমন কথার কারণে মায়া চৌধুরী তার পেটুয়া বাহিনীকে নির্দেশ দেন যেন সাংবাদিকরা ঢাকায় নিরাপদে ফিরতে পারেন। তবে শর্ত জুড়ে দেন কোনভাবেই তার অপকর্মের বয়ান সাংবাদিকরা লিখতে বা বলতে পারবেন না। মি. তুহিন বলেন এটিতো সামান্য একটি উদাহরণ মাত্র। তার অপকর্মের ফিরিস্তি এতোটাই বিস্তৃত যা সিনেমার কাহিনীকেও হার মানাবে।
এভাবেই আইন কাঠামোকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন মায়া চৌধূরী।এদিকে গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারে পতন আর তার দেশত্যাগের পর থেকে প্রচন্ড দাপুটে এই মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার কোন খোঁজ মিলছে না। তবে অনেকেই বলছেন তিনি দেশেই আছেন কোন বিএনপি নেতার ছত্রছায়ায় রয়েছেন। যদিও বিষয়টির স্বপক্ষে কোন দালিলিক প্রমান নেই। তবে তিনি যে বিদেশে পালাতে পারেননি সে বিষয়ে অখন্ড যুক্তি রয়েছে। বর্তমান সরকারের দায়িত্ব রাজনীতির নামে এই মাফিয়া ডনকে আইনের আওতায় আনা।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh