জাতীয় সংসদে গত বৃহস্পতিবার (৬ জুন) দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠন, নেটওয়ার্ক, জোট, বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন, ব্যবসায়িক সমিতি এবং পেশাজীবী সংগঠন ইতোমধ্যে তাদের দাবি-দাওয়া উপস্থাপন করেছে।
সরকারের বাজেট প্রণয়ণের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি ২০২৪ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বেসরকারী পর্যায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ নানা স্তরের জনগণের সাথে প্রাক-বাজেট আলোচনা শুরু হয়। অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন উন্নয়ন সংগঠনের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনায় অংশ নেন এবং তাদের চাহিদা ও বাজেট সম্পর্কিত মতামত শোনেন।
অন্তর্ভুক্তিমূলক বাজেট প্রণয়নের উপর সম্প্রতি জোর দেওয়া হচ্ছে, যা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত যৌক্তিক। যেমন, গত ২৪ মে ২০২৪ তারিখে একটি টকশোতে "প্রাক-বাজেট ২০২৪-২৫ আলোচনাঃ জলবায়ু এবং পানি ও স্যানিটেশন প্রেক্ষিত" শিরোনামে বিস্তারিত আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি ও স্যানিটেশন খাতে ন্যায্য বরাদ্দের দাবী জানান। গ্রাম ও শহরের বৈষম্য দূরীকরণেও গুরুত্বারোপ করা হয়।
কিন্তু আশঙ্কার কথা হচ্ছে এবারের বাজেট বড় ঘাটতির বাজেট। মূল্যস্ফীতির কারণে কাঙ্খিত উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাধাগ্রস্ত হতে পারে, সেবামূলক খাতসমূহতেও এর প্রভাব পড়বে। নানামুখী আভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বৃদ্ধি এবং করজাল যদি বিস্তৃত না করা হয় তাহলে বাজেট ঘাটতি মোকাবেলা করা মুশকিল হতে পারে।
যেহেতু পানি ও স্যানিটেশন সংক্রান্ত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো জনগণের মৌলিক সেবা যেমন স্বাস্থ্য খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট তাই এ খাতটিতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ একান্তভাবে জরুরি। বাজেটে মৌলিক সেবা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও তার যথাযথ ব্যবস্থাপনা না হলে অন্যান্য উন্নয়ন খাতগুলোতেও এর প্রভাব পড়বে। তাই ন্যায্যতা, প্রয়োজনীয়তা এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
বাজেট ঘাটতি মোকাবেলায় বেশ কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেন। এগুলো হল, ভোগ ব্যয় কমিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাজেট বরাদ্দ করা; আভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বৃদ্ধি করা; করজাল বিস্তৃত করা; আমদানীনির্ভরতা কমিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং প্রয়োজনীয় ব্যয় সংকোচন নীতিমালা গ্রহণ করা। ২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ৬ অর্জন করতে হলে বর্তমান বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। উল্লেখ্য যে, পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক প্রণীত ফাইন্যান্স স্ট্র্যাটেজি অন এসডিজি ২০১৭ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন করতে প্রতিবছর অতিরিক্ত ব্যয় ১০ হাজার কোটি টাকা হারে বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। এবারের বাজেটে এই বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হলে আগামী বছরগুলোতেও এর প্রতিফলন দেখা যাবে। উল্লেখ্য ওয়াশ এর জন্য এডিপির বরাদ্দে বেশ প্রশংসনীয় একটি উর্ধ্বমুখী গতি রয়েছে। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ওয়াশ এর জন্য বরাদ্দকৃত অর্থে ২৩% হ্রাস পরিলক্ষিত হয়েছে (১৮২.২৮ বিলিয়ন টাঁকা থেকে ১৩৯.৭২ বিলিয়ন টাকা), যদিও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ৭.২২% (১৪৯.৮১ বিলিয়ন টাকা)বৃদ্ধির কারণে এই অবচয়ের কিছুটা বিপরীত চিত্রও দেখা গিয়েছে। আমরা আশা করি ২০২২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার এই খাতে ন্যায্যতা ভিত্তিক বরাদ্দ করবে।
স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয়তার উপরও গুরুত্বারোপ করা হয়।
গত ৫-৬ মাস ধরেই এই অর্থবছরের বাজেট নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা হয়ে আসছে। আশা করা যাচ্ছে উন্নয়ন বাজেটে বা এডিপিতে এবারের এই বিষয়গুলো পর্যাপ্ত গুরুত্ব পাবে এবং জনগণের বিশেষ সুপারিশ নিয়ে জনবান্ধব বাজেট ২০২৪-২৫ ঘোষণা করা হবে।
আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হাওর ও উপকূলীয় অঞ্চলে দেখেছি, তৃণমূল পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছিল না। যেমন, ইউনিয়ন পরিষদে তেরোটি স্ট্যান্ডিং কমিটি আছে। এদের মধ্যে একটি হচ্ছে পানি এবং হাইজিন বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটি এবং এটি উপজেলাতেও আছে, জেলা পর্যায়েও আছে। এই কমিটিগুলো নিয়ে যখন ওখানকার মানুষের সাথে আলোচনা করেছি, তখন জেনেছি, তারা যে নিজেদের দাবী উত্থাপন করতে পারে বা প্রয়োজনীয় প্রকল্প খসড়া করে জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে জমা দিতে পারে, এই ধারণাই তাদের ছিল না। গত এক দশকে তারা এই চর্চা ধীরে ধীরে রপ্ত করেছে। তারা নিজেরা বাজেট প্রণয়ন করা শুরু করেছে এবং তাদের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হচ্ছে। বরাদ্দের অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা পায় অংশগ্রহণমূলক বাজেট প্রণয়ন। এই প্রক্রিয়া চলমান থাকলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাগ্য বদলে যেতে পারে। যারা সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, যারা পানি পাচ্ছে না বা দারিদ্রতার কারণে টয়লেট স্থাপন করতে পারছে না, জলোচ্ছ্বাসের শিকার হচ্ছে এই মানুষগুলো যখন স্থানীয় পর্যায়ে আলোচনায় অংশ নেবে, তখন বাজেটের গুরুত্ব বুঝবে। এজন্য স্থানীয়ভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পানি-স্যানিটেশন অধিকার বাস্তবায়নে জন অংশগ্রহণমূলক বাজেট আলোচনা বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে। বাজেট প্রণয়নের সময় প্রতিটি ওয়ার্ডে এ সংক্রান্ত আলোচনা চলমান রাখা উচিত, ইউনিয়ন পর্যায়েও যেন চলমান থাকে, কারণ " শুনতে হবে তাদের কথা, যাদের কথা হয় না শোনা"।
লেখক: পানি ও স্যানিটেশন বিশেষজ্ঞ এবং উপ-নির্বাহী পরিচালক, ডর্প।
ইমেইল: [email protected]
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh