মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ইতোমধ্যে। উপজেলার কুতুবজোমের সোনাদিয়া লবণ মাঠের জমি দখল-বেদখলকে কেন্দ্র করে দুই জন খুন হওয়ার পর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে এলাকায় ব্যাপক অভিযান শুরু করে মহেশখালী থানা পুলিশ। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও সক্রিয় হয়ে ওঠে।
ইতোমধ্যে পুলিশ সোনাদিয়া বিচ্ছিন্ন দ্বীপে অভিযান চালিয়ে হত্যায় জড়িত সন্দেহে কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। হয়েছে অস্ত্র উদ্ধারও। পুলিশের নিজস্ব সোর্সের ও সংবাদের সূত্র ধরে জলে স্থলে চলছে একের পর চিরুনি অভিযান। পুলিশের চিরুনি অভিযানে টিকতে না পেরে মহেশখালী থেকে অন্যত্র আত্মগোপন চলে গেছে সন্ত্রাসীদের একটি বিশাল অংশ।
পুলিশ জানায়, সোনাদিয়া দ্বীপে লবণ মাঠ দখলের ২ পক্ষের সংঘর্ষে ২ জন নিহতের ঘটনায় মঙ্গলবার ২টি পৃথক মামলা হয়েছে। গত শনিবার ওই ঘটনার পর গত মঙ্গলবার বিবদমান ২ পক্ষ মহেশখালী থানায় ২টি মামলা দায়ের করেন।
এ ঘটনায় দায়ের করা ২ মামলার মধ্যে একটির বাদী নিহত সাইফুল ইসলামের মা মোমেনা খাতুন। এ মামলায় নুরুল আজীমকে প্রধান আসামি করে মোট ১২ জনকে আসামি করা হয়েছে।
অন্যদিকে সংঘর্ষে নিহত সাদ্দাম হোসেনের মা মনজুন আরা বাদী হয়ে প্রতিপক্ষ জকরিয়াকে প্রধান আসামি করে মোট ১০ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। তবে দুই মামলায় প্রকৃত মদদদাতারা মামলায় আসামি হয়নি বলছেন একাধিক সূত্র।
জানা গেছে,ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীদের পাকড়াও করতে পুলিশ দিন-রাত অভিযান অব্যাহত রেখেছে। যার কারণে মহেশখালী থানার ওসি সুকান্ত চক্রবর্তীর নেতৃত্বে করা টিমের পুলিশের প্রতি আস্থা বাড়তে শুরু করেছে দ্বীপের সাধারণ মানুষের মাঝে।
রোমহর্ষক এসব অভিযান দূর থেকে মনিটরিং করছে এলাকার সন্ত্রাসীদের গডফাদার ও দাগী সন্ত্রাসীদের একটি বিশাল অংশও। সংবাদে এসব সন্ত্রাসী গডফাদারদের নাম না আসায় কিংবা নাম আসলেও তাদের দিকে অভিযান তাক না হওয়ায় কখন এই অভিযানে ভাটা পড়বে কিংবা ধারাবাহিক প্রতিবেদনে ভাটা পড়বে তার দিকে তাকিয়ে আছে সন্ত্রাসীদের ওই অংশটি।
এদিকে রিপোর্টের তালিকায় সন্ত্রাসীদের নাম আসা না আসা নিয়ে মহেশখালীতে স্থানীয় প্রতিনিধির কাছে নানা দেন-দরবার ও হুমকি আসছে একটি প্রভাবশালী মহলের পক্ষ থেকে। এ নিয়ে সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর নিজেদের মধ্যে শুরু হয়েছে এক ধরনের কাঁদা ছোড়াছুড়ি। সন্ত্রাসী ও গডফাদারদের ব্যাপারে রিপোর্ট না করতে এবং প্রতিপক্ষের অপরাধ ফিরিস্তি তুলে ধরতে এক পক্ষ অন্য পক্ষের ব্যাপারে নানা অভিযোগ জানাচ্ছে প্রতিবেদকের কাছে। এতে উঠে আসছে অপরাধীদের পরস্পর বিরোধী অন্দর মহলের খবর।
সন্ত্রাসের উত্থান
স্থানীয় সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোনাদিয়া সন্ত্রাসীদের গ্রুপ, উপ-গ্রুপগুলো মূলত দুই ধারায় বিভক্ত। প্রথম থেকেই লবণ মাঠের জমি দখল বেদখল নিয়ে বড় মহেশখালীর জাহিরাঘোনা এলাকার শ্রমিক লীগ নেতা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ও একই এলাকার মোস্তাফা। মোস্তাফার সঙ্গে একই এলাকার শাহ আলমসহ আরও কয়েকজন যুক্ত হয়ে কাজ করতেন এই সব সন্ত্রাসীরা। তবে মাঠের নেতৃত্বে থাকেন শাহ আলম। এলাকায় এসব সন্ত্রাসীদের উত্থানের বিষয়ে কারিগর হিসাবে কাজ করেন সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত দুই গ্রুপের প্রধানরা।
জানাগেছে, উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নের আওতাধীন সোনাদিয়া দ্বীপের পশ্চিম পাড়া এলাকায় বিস্তৃত খালি জমিতে লবণ উৎপাদন মাঠ রয়েছে। এ মাঠে লবণ উৎপাদন করা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বেশ কয়েকদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিলে। বিবদমান দুইপক্ষের নেতৃত্বে থাকা কেউই সোনাদিয়া বা কুতুবজোম ইউনিয়নের বাসিন্দা নয়, তারা পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন বড় মহেশখালীর বাসিন্দা। তবে অনেকটা রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব খাটিয়ে তারা সোনাদিয়ায় বিবদামান জমিতে চাষ করতে যায় বলে স্থানীয়দের দাবি। মূলত বিরোধপূর্ণ এই লবণভূমিকে নিজেদের বৈধ ভূমি বলে দাবি করে আসছিল উল্লেখিত দুই গ্রুপের দল নেতারা।
তবে সোনাদিয়াসহ পাশ্ববর্তী বড় মহেশখালীর বেকার উঠতি বয়সের যুবকরা ঝুঁকে পড়েন এই বাহিনীর দিকে। এক বাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব নেন বর্তমান শ্রমিক লীগ নেতা জাহাঙ্গীর। অপরদিকে অন্য বাহিনীর নেতৃত্ব নেন শাহ আলম।
দল নয় স্বার্থই প্রধান
এখানকার দুই সন্ত্রাসী গ্রুপ আওয়ামী লীগের লেবাস পরলেও আসলে দল তাদের মুল বিষয় নয় বলে জানিয়েছেন একাধিক সূত্র। মূলত: দীর্ঘ দিনের বিবদামান পশ্চিমে বিশাল বিশাল চিংড়ি ঘের, লবণ প্রজেক্ট ও কাঁকড়া ঘোনা দখলই সন্ত্রাসীদের মূল টার্গেট। এসব বাহিনীর বিভিন্ন উপ-দলের নেতা ও ক্যাডাররা একাধিকবার দল বদল করে উভয় পক্ষের দেওয়া মামলার আসামিও হয়েছেন।
যেভাবে জোড়া খুন
গত শনিবার সোনাদিয়ার পশ্চিমপাড়া এলাকায় সকাল থেকে জাহাঙ্গীর গ্রুপ ও শাহ আলম গ্রুপের মধ্যে লবণ মাঠের দখল-বেদখল নিয়ে ধাওয়া-পালটা ধাওয়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে উভয় পক্ষে গোলাগুলি বেধে যায়। এ সময় উভয় পক্ষে শত শত রাউন্ড গুলি বিনিময় হয়, এতে উভয়পক্ষের অনেকই গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়।
একপর্যায়ে সাইফুল ইসলাম নামে এক যুবক গুলিবিদ্ধ হয়ে লবণ মাঠে পড়ে যায়। নিহত হয়ে মারা যায় জাহাঙ্গীর গ্রুপের লোক সাইফুল ।
নিহত সাইফুল ইসলাম (৩৩) বড় মহেশখালীর মুন্সিরডেইল এলাকার মৃত গোলাম কুদ্দুসের ছেলে।
এদিকে এ ঘটনায় আহত হয় উভয়পক্ষে আরও ১০-১২ জন ব্যক্তি। আহতদের একজন সাদ্দাম হোসেন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে চিকিৎসা অবস্থায় রোববার ভোর ৬টায় তার মৃত্যু হয়। নিহত সাদ্দাম হোসেন (৩৫) শাহ আলম পক্ষের লোক। সাদ্দাম সোনাদিয়ার পশ্চিমপাড়া এলাকার মৃত আনু মিয়ার সন্তান। তার শরীরে গুলি ও দায়ের কোপের আঘাত রয়েছে বলে পারিবারিক সূত্রে জানিয়েছে।
সোনাদিয়ায় জোয়ার-ভাটার হিসেবে করে নৌ-পথে যাতায়াত করতে হয় বলে আইনশৃঙ্খলা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না, ফলে অনেক সময় এখানে বড় ধরনের সহিংসতার আশঙ্কা থেকে যায়। এ অবস্থায় সোনাদিয়ায় পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের দাবি জানান কুতুবজোমের চেয়ারম্যান শেখ কামাল। আর স্মরণকালের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে শেষ হয় একটি অধ্যায়।
একটি অংশ নিরাপদে
একাধিক সন্ত্রাসী, সন্ত্রাসী বাহিনী ও তাদের গডফাদারদের ব্যাপারে সংবাদ প্রকাশিত হলেও তাদের একটি অংশ নিজেদের নিরাপদ মনে করছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন সন্ত্রাসীকে আটক করেছে পুলিশ। গত কয়েক দিন ধরে পুলিশ একাধিক অভিযান পরিচালনা করেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান কোন দিকে মোড় নিচ্ছে তার গতিবিধি দেখে পা ফেলতে চায় অন্যসব সন্ত্রাসী ও সন্ত্রাসী বাহিনীগুলো। তাই তারা আপাতত নিরাপদ আশ্রয়ে চুপচাপও রয়েছে।
এদিকে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীদের ডেরায় পুলিশ বারবার হানা দেওয়ায় সন্ত্রাসীদের একটি অংশ নিজেদের নিরাপদ ভাবতেও শুরু করেছে। সংবাদে সন্ত্রাসী তালিকায় কোনো কোনো সন্ত্রাসী ও তাদের গডফাদারদের নাম বাদ পড়ায় অনেকে হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন মনে করে নিজেদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ধারণ করে আছেন বলেও সূত্রে প্রকাশ।
প্রশাসনের হিসাব-নিকাশ
নিজেদের রক্ষার ব্যাপারে সন্ত্রাসীরা যে যতোই আস্থাশীল হোন না কেন প্রশাসনের হিসেব অন্য জায়গায়। সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে মহেশখালীর সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে রেডম্যাপ সম্পন্ন করেছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানতে পেরেছে। খুব শীগগিরই এর একটা প্রভাব সন্ত্রাসী বাহিনীর ওপর পড়তে যাচ্ছে বলে সূত্রে প্রকাশ। বৃহৎ স্বার্থে সন্ত্রাসী যেই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়ায় নামছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এ নিয়ে কক্সবাজারের ইতোমধ্যে ‘সন্ত্রাসীদের আতঙ্ক’ হিসাবে পরিচিত পাওয়া পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ‘সন্ত্রাসী কার’ এ পরিচয় না দেখে অভিযানে নামছেন বলে প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।
দৃষ্টির বাইরে উপদ্বীপ সোনাদিয়া
সোনাদিয়া মহেশখালী দ্বীপের ভেতরেও আলাদা এক’টি দ্বীপ। এ একটি দ্বীপের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড খুব একটা চেখে আসে না। দূর দ্বীপ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতাসহ নানা কারণে এমনটি হয়। এখানে প্যারাবন দখলের পর কেটে চিংড়ি ঘের বানানো, লবণ ও চিংড়ি ঘের প্রজেক্টের জমি নিয়ে গ্রুপে গ্রুপে বিরোধ চরমে। আছে জলদস্যুতা, খুনা-খুনির ঘটনাও। সোনাদিয়া সর্বশেষ জোড়া খুন হয়েছেন শনিবার।
সন্ত্রাসীদের রাজ্য সোনাদিয়া
জলদস্যু সরদার ও সোনাদিয়ায় অবৈধ দখল স্থাপন করার বিষয়ে কয়েকজনের নামটি বেশ আলোচিত ছিল এক সময়।
কয়েকজনের নেতৃত্বে ছিল একটি শক্ত দস্যু গ্রুপ। দক্ষিণ চট্টগ্রাম তথা কক্সবাজার উপকূলীয় এলাকার বঙ্গোপসাগরে প্রতিদিন এই বাহিনীর হাতে একাধিক ট্রলার দস্যুতার শিকার হত। দাবড়ে বেড়াত তারা।
কিন্তু মহেশখালীর ইতিহাসে সরকারের ডাকে সাড়া দিয়ে দস্যুরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তৎকালীন পুলিশের আইজিপির হাতে অস্ত্র ও গোলবারুদ জমা দিয়ে ২য় দফা আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসলে আত্মসমর্পণের মত বিরল ঘটনা ঘটে। এতে কমে যায় দস্যুতা। শৃঙ্খলা শান্তি ফিরে মহেশখালী দ্বীপে। তবে হঠাৎ সোনাদিয়া দ্বীপে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানিতে কারা জমি দখল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে এটি দেখার বিষয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে বলছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এসব অস্ত্র উদ্ধারের প্রয়োজন মনে করছেন এলাকাবাসী।
নিরীহদের শনিরদশা
এখানে বছর দুয়েক ধরে থানার কোনো ওসিই বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেননি। এখন এখানে প্রতি ওসির গড়ে বছর খানিক চাকরির স্থায়িত্ব হলেও মানুষের দুখের শেষ নেই। অনুসন্ধানে ভুক্তভোগী অনেকে অভিযোগ করে বলেন, মহেশখালীতে ভালো অফিসার আসেন না। যারা এসেছেন তারা সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতে চেষ্টা করেছে। সম্প্রতি প্রণব চৌধুরী নামের এক ওসি মহেশখালীতে এসে নিরপেক্ষতার দৃষ্টিকোণ থেকে নিরীহ মানুষের প্রশংসা কুড়ালেও তাকে বেশিদিন রাখা হয়নি।
একই অবস্থা উপজেলা প্রশাসনেও। এখানেও টাকা ছাড়া ভালো কিছু আশা করা যায় না। মহেশখালীর অপরাধের মুল সূত্র ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে। আর এই বিরোধ জিইয়ে রাখার জন্য উপজেলা ভূমি অফিসই যথেষ্ট বলে মনে করেন অনেকে।
মহেশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ সুকান্ত চক্রবর্তী বুধবার রাতে পূর্বকোণকে জানান, পুলিশের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে চেষ্টার কোন কমতি নাই,তবে সোনাদিয়া দুর্গম এলাকায় হওয়ায় পুলিশ পৌঁছতে সময় লাগায় অপরাধী গা ঢাকা দে। তার পরেও অপরাধীদের গ্রেফতার করতে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh