× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

ইরানের মেঘ চুরি ও যৌক্তিকতা

হাসান রাজীব

১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১৭:৩৭ পিএম

তুরস্কে মেঘলা আকাশ এবং বরফে ঢাকা পাহাড়ের চূড়া দেখা গেলেও সীমানার অপর পাশে ইরানে এর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দুই দেশের মধ্যে বৃষ্টিপাত এবং তুষারপাতের এই তারতম্যের জন্য ইরানিদের মধ্যে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

বিষয়টা শুরু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু ছবি ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে। বিগত দুই মাস ধরে বেশকিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে যেগুলো তুরস্ক এবং ইরানের আবহাওয়ার বিশাল তারতম্যকে ইঙ্গিত করে। 

তবে তুরস্ক যে ইরানের মেঘ চুরি করছে এ আলাপ বেশ কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। ‘মেঘ চুরি’ বলতে মূলত সেইসকল বিশ্বাস বা অভিযোগকে বোঝানো হয় যেখানে ধারণা করা হয় একটি দেশ প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে একটি নির্দিষ্ট এলাকা থেকে বৃষ্টির মেঘকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

‘ক্লাউড সিডিং’ পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে এ ধরনের কাজ করা সম্ভব। এটি এক ধরনের আবহাওয়া পরিবর্তন কৌশল যেখানে বৃষ্টি বা তুষার উৎপাদন করার ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য মেঘের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু পদার্থ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এই পদ্ধতির কার্যকারিতা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা ক্লাউড সিডিংয়ের সাথে সম্পর্কিত সম্ভাব্য বিপদগুলি খুঁজে বের করেছেন।

মেইনের কোলবি কলেজের আবহাওয়া বিজ্ঞানী এবং ইতিহাসবিদ জেমস ফ্লেমিং এই ব্যাপারে বলেছে, ‘এর সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব হলো প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হওয়া যে আমাদের মেঘ চুরি হচ্ছে অথবা কেউ আমাদের সাথে আবহাওয়া নিয়ে যুদ্ধ বাধাতে চাচ্ছে। মেঘ কখনোই এক জায়গায় থেমে থাকেনা। এরা ক্ষণস্থায়ী এবং দ্রুত বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পরে।’

তাই যেই দেশটি ক্লাউড সিডিং করছে সেই দেশটিতেই বৃষ্টি হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই কারণ মেঘ আকাশে নির্দিষ্ট এক স্থানে না থেকে ছড়িয়ে পরে। ইরান, তুরস্ক, সৌদি আরব এবং আরব আমিরাতে সরকারিভাবে আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প চালু করা হয়েছে। ফলে প্রতিকূল অঞ্চলগুলোতে পরিবেশগত শত্রুতা নিয়ে আরও অভিযোগ আসার সম্ভাবনা বেড়ে গেলো।

বায়ুমণ্ডলের দস্যুরা

অবশ্য ইসলামি প্রজাতন্ত্রগুলোতে মেঘ চুরির অভিযোগ এটিই প্রথম নয়। দেশগুলো অনেকদিন ধরেই মিত্র এবং শত্রু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে খরা তৈরি ও পরিবেশের ক্ষতি করার অভিযোগ দিয়ে আসছে। ২০১৮ সালে ইরানের সামরিক বাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য ইসরাইল এবং আরেকটি অজানা দেশের বিরুদ্ধে (পরবর্তীতে জানা যায় দেশটি আরব আমিরাত) নিজ দেশের আবহাওয়ার ওপর প্রভাব বিস্তার এবং মেঘ ও তুষার চুরির অভিযোগ আনে।

এর দুই বছর আগে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ একই ধরনের অভিযোগ আনেন। তিনি অভিযোগ করেন, ‘শত্রুরা’ অসৎ উদ্দেশ্যে ইরানের আবহাওয়ার ক্ষতি করার পাশাপাশি দেশটির বৃষ্টির মেঘ চুরি করছে। পরে এই দুইটি অভিযোগ ইরানের আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং অন্যান্য পরিবেশগত সংস্থাগুলো খারিজ করে দেয়।

আবার নতুন করে মেঘ চুরির অভিযোগ আসছে যেখানে প্রধান দায় দেয়া হয়েছে তুরস্কের ওপর। ইরানের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবীদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, একটি তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে দেশটির উত্তরের ‘ওয়েদার ফ্রন্টস’ (এক ধরনের সীমানা যা বায়ুর ভরকে পৃথক করে বায়ুর ঘনত্ব, তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতায় পরিবর্তন আনে) কীভাবে গায়েব হয়ে যাচ্ছে সেটি খুঁজে বের করার জন্য।

এ ব্যাপারে ইরানের পরিবেশ অধিদপ্তর কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিযোগের বিষয়টি ছড়িয়ে পরার ফলে জনগণ বিভিন্ন ধরনের ভুল তথ্য পাবে পরিবেশ সম্পর্কে।

জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি, জলবায়ু এবং স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের পরিচালক কাভে মাদানি বলেন, ‘ছবিগুলো বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ের। সেগুলোকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বা বোকার মতো ভুল তথ্য ছড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে যার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।’

‘দেশগুলোর মধ্যে বৃষ্টিপাতের যেই তারতম্য সেটি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। কোন দেশে বৃষ্টিপাত কেমন হবে তা নির্ভর করে দেশটির আশেপাশে কতগুলো সমুদ্র আছে, বাতাস কোন দিক থেকে প্রবাহিত হচ্ছে এবং সেটি সুউচ্চ পর্বতমালার কতটা কাছাকাছি অবস্থান করছে তার ওপর। পাশাপাশি ইরান যেহেতু তীব্র খরার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, বিজ্ঞানীরা প্রাধান্য দিচ্ছে দেশটির পানির সংকটের মূল কারণ খুঁজে বের করার উপর।’

মাদানি বলেন, ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অথবা মুখরোচক গল্প দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব কিন্তু আসল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব না। শেষমেশ ইরানের জনগণই এই ধরনের ছলচাতুরীর প্রধান শিকার।’

বৃষ্টির জন্য বাঁধা

অন্যান্য দেশের মতো ইরানেও একটি ‘জল বছর’ (১২ মাসের একটি সময়কাল যেখানে বৃষ্টিপাত পরিমাপ করা হয়) আছে যখন ইরানের মোট বৃষ্টিপাত পরিমাপ করা হয়। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি শুরু হয়ে ১২ মাস সময় নিয়ে বৃষ্টিপাত পরিমাপ করা হয়। ইরানের আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, এই শীতে বৃষ্টিপাত সন্তোষজনক ছিল না কারণ গড়ে ৬২ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে।

কিন্তু ইরানের পানি সংকট নতুন নয় কিংবা মেঘ চুরির কারণে ঘটেছে এমনও না। গত গ্রীষ্মেই দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে পানির সংকট দেখা দিয়েছিল। মানুষকে রাস্তায় লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ট্যাংক থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়েছিল।

ইরানের দক্ষিণপশ্চিম এবং মধ্যাঞ্চলে ২০২১ সালে তীব্র পানির সংকটের কারণে দেশব্যাপী আন্দোলন হয়। পানির তীব্র সংকট থাকার পরেও দেশটির নিরাপত্তা সংস্থা বল প্রয়োগের মাধ্যমে এই আন্দোলন থামিয়ে দিয়েছিলো।

মাদানি বলেন, ‘বছরের শুরুতে ইরানে যতটুকু বৃষ্টিপাত হয়েছে সেটি চিন্তাজনক এবং এর কারণে দেশটিতে বড় খরা হওয়ার আশঙ্কা দেখা গিয়েছে।’ 

কাভে মাদানি ইরানের আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৮ সালে তিনি তার পদে ইস্তফা দেন এবং দেশ ছেড়ে চলে যান যান কারণ তার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের হয়ে গোয়েন্দাগিরি করার অভিযোগ উঠেছিলো।

মাদানি আরও বলেন, ‘যে দেশের জল দেউলিয়াপনা যত বেশি, সেই দেশে খরা হওয়ার প্রবণতা তত বেশি।’

‘জল দেউলিয়াপনা’ বলতে বোঝায়, একটি দেশ বার্ষিক যতখানি পানি জমা করতে পারছে তার থেকে বেশি পানি ব্যবহার করছে। ইরানে এই রকম হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হলো যুগ যুগ ধরে চলে আসা সম্পদ অব্যবস্থাপনা, অতিরিক্ত বাধ নির্মাণ এবং অদক্ষ কৃষি ব্যবস্থাপনা যেগুলো আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে আরও তীব্র হয়েছে।

মেঘের জন্য নীতি!

ক্লাউড সিডিংসহ অন্যান্য আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণকারী প্রযুক্তিগুলো সমগ্র বিশ্বেই অনেক দিন ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০২২ সালের শীতকালীন অলিম্পিকের সময় চীন এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছিলো আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। ২০২০ সালে সাইবেরিয়াতে দাবানল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাশিয়ার অগ্নিনির্বাপক কর্মীরাও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিলো।

ইরান, সৌদি আরব এবং আরব আমিরাতের মত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো কৃত্রিম পদ্ধতি ব্যবহার করে পানির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করতে চাচ্ছে কারণ দেশগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণ ও শুষ্ক দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে এই ধরনের কর্মকাণ্ডের সুবিধা থাকলেও কিছু ক্ষতিকর দিক আছে। 

সেন্টার ফর সাসিটেইনিবিলিটি, ইনোভেশন এন্ড গুড গভার্নেন্সের' প্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী পরিচালক অরবিন্দ ভেঙ্কটারমন বলেন, ‘আবহাওয়ার ওপর কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।’

তিনি আরও বলেন, ‘গবেষণা থেকে দেখা গেছে, এ ধরনের কিছু পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে ভবিষ্যতে আরও বেশি বন্যা বা খরা দেখা দিতে পারে। পাশাপাশি এটি আমাদের খাদ্যের জোগানের ওপর প্রভাব ফেলার পাশাপাশি ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব তৈরি করতে পারে। যদিও কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করে ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকাণ্ডগুলোতে বিশ্বব্যাপী হস্তক্ষেপের বিধান থাকা জরুরি।

জাতিসংঘের মহাপরিচালক বান কি মুনকে জলবায়ু নীতি বিশেষজ্ঞ এবং সাবেক জলবায়ু উপদেষ্টা ট্রেসি রাকজেক বলেছেন, ‘নতুন করে শুরু করার বা নতুন নীতিমালা প্রণয়নের কিছু নেই এখানে। এই ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চুক্তি আগে থেকেই আছে কিন্তু সেগুলো মানা হচ্ছে না।’

পরিবেশগত পরিবর্তনে সামরিক কৌশলে বা অন্য কোনো প্রতিকূলতা ব্যবহার না করার নীতিমালা ১৯৭৮ সালে কার্যকর হয়েছিল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ব্রিটেন, জার্মানি এবং রাশিয়া সহ ৭৮ টি দেশ সেটিতে অনুমোদন দিয়েছিলো।

মাদানি বলেন, ‘যেই আইনি ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক চুক্তি আছে সেগুলো আসলে দুর্বল। সেগুলো দিয়ে আধুনিক সময়ের সংকটগুলো দূর করা সম্ভব নয়। তাই নতুন নৃতাত্ত্বিক সংকট সমাধানে এই ধরনের নীতিমালার বড় কোন ভূমিকা নেই।’

রাকজেক জানান, ‘ক্লাউড সিডিংয়ের পাশাপাশি আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণকারী প্রযুক্তিগুলোর যেই নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে তা প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দ্রুত বৈশ্বিক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।’ ফোর্বস।

Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.