বিশ্ব এখন আধুনিকতার চরম শিখরে অবস্থান করছে। সর্বাধুনিক এই বিশ্বে একদিকে যেমন মহাকাশ ভ্রমণ, গ্রহ-উপগ্রহ বিজয় এমনকি নক্ষত্রমণ্ডলীতেও মানুষের যাত্রার অভিলাষ। ভূমিতেও উচ্চগতির সব যানবাহন যেমন, মেট্রোরেল এবং আন্তঃনগর ট্রেনসহ রয়েছে বুলেট ট্রেন। এর মধ্যে কিছু ট্রেন চলে বিদ্যুতে, আবার কিছু চলে ডিজেলচালিত ইঞ্জিনের মাধ্যমে।
তবে আমাদের পাশের দেশ পাকিস্তানে এমন এক ট্রেনের দেখা মেলে যা একেবারেই ব্যতিক্রম। এই রেলগাড়ি চালিত হয় শুধুই ঘোড়ার মাধ্যমে।
পাকিস্তানের ফয়সালাবাদে জারানওয়ালায় এক গ্রামের নাম গঙ্গাপুর। এ গ্রামেই সেই ঘোড়ার ট্রেন দেখা যায়। রেললাইনের উপর কাঠের তৈরি টেবিলের মতো আসন পাতা থাকে। সেখানে ১৬-১৮ জন যাত্রী বসতে পারেন। আসনের নিচে চাকা হিসেবে ব্যবহার করা হয় সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্কের পরিত্যক্ত চাকা।
গ্রামটি প্রতিষ্ঠা করেন ব্রিটিশ ভারতের প্রখ্যাত প্রকৌশলী স্যার গঙ্গারাম আগরওয়াল। গঙ্গাপুরের বাসিন্দারা এককালে নিকটবর্তী বুচিয়ানা রেলস্টেশনে পৌঁছানোর জন্য ব্যবহার করতেন ঘোড়ায় টানা ট্রেন। অত্যন্ত সুলভ এবং উপভোগ্য ভ্রমণ ছিল সেটি। একটি ট্রেনে ১৫ জন যাত্রী বসতে পারতেন।
বুচিয়ানা রেলওয়ে স্টেশন থেকে গঙ্গাপুর পর্যন্ত তিন কিলোমিটার রেলওয়ে ট্র্যাক নির্মাণ করা হয়েছিল ১৯০৩ সালে। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত গ্রামবাসীরা এই ট্রেনে চড়েই নিয়মিত যাতায়াত করতেন।
গঙ্গারামের জন্ম লাহোরের নিকটবর্তী মংতানওয়ালায়, ১৮৫১ সালের ১৩ এপ্রিল। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের থমসন কলেজ অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে প্রকৌশলে পড়াশোনা করেন তিনি। এই প্রতিষ্ঠান বর্তমানে আইআইটি রুরকি নামে পরিচিত।
পাকিস্তানের লাহোর জাদুঘর, মায়ো স্কুল অব আর্টস, লাহোর হাইকোর্ট এবং লাহোর জেনারেল পোস্ট অফিসের মতো শহরের বিভিন্ন ভবন নির্মাণের পেছনের মানুষ গঙ্গারাম।
ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকরির সময় গঙ্গারাম বহু ঐতিহাসিক প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহী হিসেবে কাজ করেছেন। অবসরে যাওয়ার পর গঙ্গারাম পাঞ্জাব রাজ্যে প্রায় ৮৫ হাজার একর জমি ইজারা নেন। প্রকৌশল বিদ্যা খাটিয়ে উদ্ভাবন করেন সেচ ব্যবস্থা। ঊষর ভূমিকে করে তোলেন উর্বর। এরপর থেকেই ওই স্থানটি গঙ্গাপুর নামে পরিচিতি পায়। এই সেচ প্রকল্পের লোকবল এবং যন্ত্রপাতি পরিবহনের জন্য গঙ্গারাম স্থাপন করেন একটি সরু রেললাইন। এই ট্র্যাকের ওপরই ১৮৯৮ সালে চালু করেন ঘোড়ায় টানা রেলগাড়ি।
১৯২৭ সালে মারা যান স্যার গঙ্গারাম। এরপর ঘোড়ার রেলগাড়ি এস্টেট সোসাইটির কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সেটি ভালোভাবেই সচল ছিল। ওই সময় এই রেলগাড়ির চালকেরা বুদ্ধি খাটিয়ে কয়েকটি ট্রেন চালু করেন। লাইন একটি হওয়ায় দুটি ট্রেনের ক্রসিংয়ের সময় যাত্রী ও ঘোড়া বদল করা হতো। গাড়ি দুটি সেভাবেই তৈরি করা।
১৯৯৩ সালে ট্র্যাক চুরি হয়ে গেলে এই রেল সেবা বন্ধ হয়ে যায়। তবে ১৭ বছর পর স্থানীয়দের দাবির মুখে আবার চালু করা হয়। জেলা প্রশাসন, জারানওয়ালা তহসিল মিউনিসিপ্যাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং স্থানীয়রা মিলে রেল ট্র্যাকটি পুনরুজ্জীবিত করে।
স্থানীয় সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ নাজিম মুনাওয়ার আহমদ খান এই ট্রেনটি আবার চালুর জন্য প্রচারণা চালান। এই সুলভ পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে এলাকার নিম্ন আয়ের মানুষ উপকৃত হতে পারে বলে প্রশাসনের কাছে দাবি পেশ করেন তিনি।
জেলা প্রশাসনে ৩৩ লাখ রুপি, জারানওয়ালা তহসিল পৌর প্রশাসনের ৪০ হাজার এবং গ্রামবাসীর দেওয়া চাঁদা ১৭ লাখ রুপি খরচ করে রেলগাড়িটি আবার চালু করা হয়, ২০১০ সালে।
ওই সময় পাকিস্তানি পত্রিকা ডনের সঙ্গে আলাপকালে মুনাওয়ার আহমদ খান বলেন, গ্রামবাসীর সুবিধার জন্য ট্রেনটি আবার চালু করতে চার বছর লেগেছে। কারণ সরকারি দপ্তরের কেউ সাহায্য করতে চাইছিল না। এটি প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক একটি জিনিস। স্যার গঙ্গারামের স্বপ্নকে নতুন করে বাস্তবায়ন এটি। তবে দুঃখের বিষয়, পুরো ব্যবস্থার তত্ত্বাবধান নিয়ে ঝামেলার কারণে ২০১৪ সালে এই ঘোড়ার ট্রেন আবারও বন্ধ হয়ে যায়।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh