× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার কারণ ও প্রতিকার

রেজাউর রহমান রিজভী

২৯ অক্টোবর ২০২৩, ২০:০০ পিএম

চলতি মাসের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের বৃষ্টিশ্রান্ত দিনগুলোতে চরম ভোগান্তি সহ্য করেছে নগরবাসী। দু-তিন বছর আগে ঘণ্টায় ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও যেখানে জলাবদ্ধতা হতো না, সেখানে এখন ৩৫ মিলিমিটারেই ঢাকার রাস্তায় পানি জমে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা।

এখন ঢাকার প্রায় সব এলাকাতেই বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে ধানমন্ডি ২৭, মিরপুর রোড, কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউর বিভিন্ন অংশ, আসাদ গেট, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, তেজতুরী বাজার, কারওয়ান বাজার, রায়েরবাজার,  হাজারীবাগ, মতিঝিল, সচিবালয়, দৈনিক বাংলা, পুরানা পল্টন, বিজয়নগর, সেগুনবাগিচা, পুরান ঢাকার বংশাল ও বাংলাবাজার, জুরাইন, যাত্রাবাড়ীর কাজলা, গুলশানের শুটিং ক্লাব মোড়, তেজগাঁও-গুলশান লিংক রোড, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, কাকরাইল, বিমানবন্দর সড়ক, রায়েরবাজার, আজিমপুর, পলাশী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ফুলবাড়িয়া, মৎস্য ভবন, শাহবাগ হয়ে কারওয়ান বাজার সহ শহরের প্রধান প্রধান সড়ক ও অধিকাংশ এলাকার অলি-গলি পর্যন্ত পানিতে দীর্ঘ সময় ডুবে থাকে। 

বৃষ্টির সময় বিভিন্ন কারণে গাড়ির গতি কমে যাওয়ার পাশাপাশি ছোট যান, যেমন সিএনজিচালিত অটোরিকশার ইঞ্জিনে পানি ঢুকে বন্ধ হয়ে যায়। সড়কে যানবাহনের ইঞ্জিন বিকল হলে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এ সময় একটি অঞ্চলের সড়কে যানবাহনের গতি কমে গেলে এর প্রভাব অন্য এলাকাগুলোয়ও পড়ে। ফলে এর প্রভাব ধীরে ধীরে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে ট্রাফিক পুলিশকে যানজট নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হয়।

আবার ঢাকার ড্রেনেজ-ব্যবস্থা নাজুক হওয়ার কারণে বৃষ্টির সময় রাস্তার দুই পাশে পানি জমা শুরু হয়। এ সময় যানবাহনগুলো রাস্তার মাঝখান দিয়ে চলাচল শুরু করে। এতে করে রাস্তার যানচলাচলের সক্ষমতা ৫০ শতাংশ কমে যায়। সামান্য বৃষ্টি হলেই ঢাকায় তীব্র যানজটের এটা অন্যতম কারণ।

এর আগে গত মাসের ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকা শহরের নাগরিকরা স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ এক জলাবদ্ধতার শিকার হন। সেই রাতের বৃষ্টিতে রাজধানীতে জলাবদ্ধতা ও যানজটে আটকে পড়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হন হাজার হাজার মানুষ। ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় ঠাঁয় দাড়িয়ে অনেকেই ঘরে ফিরেছেন মধ্য বা শেষ রাতে। রাজধানীর অনেক সড়ক ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলাবদ্ধ থাকে। পানি এত বেশি ছিল অনেক সড়কে যানবাহন বিকল হয়ে পড়েছিল।

এদিন রাজধানীতে সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ১২২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, এটা এ মৌসুমে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। উপরন্তু সেই রাতেই মিরপুরে জলাবদ্ধ রাস্তায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান একই পরিবারের তিনজনসহ চারজন। এর আগে ২০১৯ সালের আগস্টে ঢাকার গ্রিনরোডে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান তরুণ চিকিৎসক পলাশ দে।

তবে এমন বৃষ্টি প্রায় প্রতি বছরই হয়। ২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর ঢাকায় পুরো দিনে ২৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল।

বৃষ্টি বেশি হলে পানি জমতে পারে। কিন্তু নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা থাকলে সেই পানি দ্রুত সরে যাওয়ার কথা। কিন্তু ঢাকার পানি নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা নেই।

আবার ঢাকার অনেক স্থানে পরের দিনও বৃষ্টির সেই পানি নেমে যেতে পারেনি। বৃষ্টির পানি নর্দমা হয়ে খালের মাধ্যমে নদীতে যাওয়া পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ধাপ রয়েছে। প্রথমে বৃষ্টির পানি ক্যাচপিটের (নালার ওপরের ছিদ্রযুক্ত ঢাকনা) মাধ্যমে সড়কের নিচে পানি নিষ্কাশনের নালায় যায়। বিভিন্ন সড়কে সিটি করপোরেশনের আওতায় সড়ক ও ফুটপাত সংস্কারকাজের কারণে বহু ক্যাচপিট এবং নালার মুখ বন্ধ গেছে। এছাড়া পলিথিন, চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতলসহ নানা বর্জ্য এবং বালু জমেও নালার মুখ বন্ধ হয়ে থাকে। ফলে নালার মুখ বন্ধ থাকায় পানি নেমে যেতে পারেনি। পরবর্তীতে সেসব ক্যাচপিট ও নালার মুখ পানি চলাচলের জন্য পরিষ্কার করা হলে পানি নামতে শুরু করে।

অন্যদিকে বৃষ্টির পানি সড়কের নিচের অংশের নালা হয়ে খাল ও নদীতে গিয়ে পড়ে। সেই নালার অবস্থাও করুণ। খালের তলায় মাটি জমে ও ময়লা ফেলে ফেলে গভীরতা কমে যাওয়ায় পানির ধারণক্ষমতা কমে গেছে।

নগরবিদগণের মতে, শহরের মোট ভূমির কমপক্ষে ১২ শতাংশ জলাধার থাকা দরকার। কিন্তু ঢাকায় আছে মাত্র ২ শতাংশ। ফলে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জায়গা নেই।

চলতি বছরের ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার মোহাম্মদপুর সোসাইটি লিমিটেড এলাকার ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি খাল থেকে কয়েক টন ময়লা পরিস্কার করে আলোচনায় এসেছেন কার্টুনিস্ট মোর্শেদ মিশু। শ’খানেক স্বেচ্ছাসেবী যুবককে সঙ্গে নিয়ে এলাকার কাউন্সিলরের প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় এই অসাধ্য সাধন করেন তিনি। এলাকার এই ময়লা আবর্জনার স্তুপের নিচে যে পানির জলাধার রয়েছে তা এলাকাবাসী বহুদিন পর প্রত্যক্ষ করলেন। মাত্র এক লাখ টাকারও কম খরচে এই কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করেছেন মিশু। অথচ সরকারী ভাবে করতে গেলে এই খরচ কোথায় গিয়ে ঠেকতো ও প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতা কি রকম হতো আর বলাই বাহুল্য। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জনশুমারির (২০২২) প্রাথমিক প্রতিবেদন বলছে, রাজধানী ঢাকায় ১ কোটি ২ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে। জলাবদ্ধতা মানুষের জীবনে নানাভাবে দুর্ভোগ তৈরি করে। চলাচলের ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। জলাবদ্ধতা অর্থনীতির ক্ষতি করে। 

২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের ‘জলবায়ু ও দুর্যোগসহিষ্ণু বৃহত্তর ঢাকা এলাকা: একটি ব্যষ্টিক বিশ্লেষণ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরে জলাবদ্ধতার কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ গড়ে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা, এখন যা আরও বেশি।

নগরের জলাবদ্ধতার ভয়াবহতা দেখে ২০১৭ সালে তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, ‘আমি প্রমিজ (অঙ্গীকার) করছি, সামনের বছর থেকে আর জলাবদ্ধতা দেখবেন না।’ 

সাবেক এই মন্ত্রীর ঘোষণার পর ছয় বছর পেরিয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে এসেছেন নতুন মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। ঢাকা ওয়াসার হাত ঘুরে জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্ব গেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কাছে। 

২০২১ সালের আগে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। তখন বৃষ্টির পানিতে রাস্তা ডুবে গেলে সিটি করপোরেশন ঢাকা ওয়াসার ওপর দায় চাপাত। তবে এরপর থেকে খাল খনন ও নর্দমা নির্মাণে দুই সিটি করপোরেশন শত শত কোটি টাকা ব্যয় করলেও জলাবদ্ধতা থেকে ঢাকাবাসী মুক্তি পায়নি।

ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, গত এক যুগে জলাবদ্ধতা নিরসনে কমপক্ষে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দায়িত্ব পাওয়ার পর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন তিন অর্থবছরে ব্যয় করেছে অন্তত ৭০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরেও দুই সিটি করপোরেশনের ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা আছে।

অথচ কাক্সিক্ষত ফল পাচ্ছে না নগরবাসী। বরং একটানা কয়েক ঘন্টা বৃষ্টি হলেই রাস্তায় পানি জমে যাচ্ছে। তাতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ নগরবাসীকে।

ঢাকার ড্রেনেজ-ব্যবস্থা এতটাই অপরিকল্পিত যে এটা কয়েক দিন পর পরই ভাঙা হয়, আবার সেটি ঠিক করা হয়। দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা করে ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরি করার কোন বিকল্প নেই। এর সঙ্গে খাল ও নদ-নদীর যোগসূত্র তৈরি করে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক করতে হবে। তা না হলে দীর্ঘমেয়াদে কোন সমাধান পাওয়া সম্ভব হবে না।

আবারো আসা যাক কার্টুনিস্ট মোর্শেদ মিশুর মোহাম্মদপুরের খাল পরিস্কার প্রসঙ্গে। খালটি পরিস্কারের ক’দিন বাদেই আবারো দেখা যাচ্ছে জলাধারটিতে ময়লা জমতে শুরু করেছে। তাহলে যে এলাকাবাসী এই খাল পরিস্কারের প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী তাদেরই হয়তো কেউ কেউ জেনে বা না জেনেই খালে ময়লা ফেলছেন। এজন্য প্রয়োজন নাগরিক সচেতনতা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ। কারণ অনেক সময় সচেতনতার অভাব থাকলেও আইনের যথার্থ প্রয়োগ ভালো ফল দেয়। 

অনুরূপভাবে ঢাকা শহরের বৃষ্টিতে যেসব স্থানে বৃষ্টিতে পানি বেশি জমে সেসব স্থানের অধিকাংশতেই দেখা গেছে ভ্রাম্যমান বিক্রেতা ও হকার বসে। তারা একদিকে তো রাস্তার প্রায় অর্ধেক অংশ দখল করে যানজট বাড়িয়ে তোলে, অপরদিকে পলিধিন সহ নানাবিধ প্লাস্টিক ও আবর্জনা ফেলে রাস্তা নোংরা করে। এতে সামান্য বৃষ্টি হলেই এসব পলিধিনসহ নানা আবর্জনা পানি নিষ্কাশনের নালাগুলোকে বন্ধ করে দেয়। এতে পানিও সহজে নেমে যেতে পারে না। এজন্য পুলিশসহ প্রশাসনের উচিত এ ব্যাপারে কঠোর ভূমিকা নেয়া। 

পরিশেষে এটাই বলা যায় যে, সামগ্রিকভাবে সব পক্ষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতা ছাড়া ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব হবে না। আর এই প্রচেষ্টা যত দেরি হবে ততই নাগরিক দুর্ভোগ অব্যাহত থাকবে।

লেখক: রেজাউর রহমান রিজভী, প্রাবন্ধিক ও নৃবিজ্ঞানী

Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.