× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

ছয় দফা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু

হীরেন পণ্ডিত

০৮ জুন ২০২৩, ০৬:৩৮ এএম

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ছয় দফা দাবি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয় জাতির মুক্তির সনদ। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি। বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের গভীরে প্রবাহিত ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। স্বাধীনতার বাইরে তার আর কোনো চিন্তা ছিল না। কারাবরণ, নিপীড়ন, নির্যাতন সহ্য করে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার পথ নির্দেশ দিয়েছেন।

স্বাধীনতার দাবিতে এবং বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসক দলের বিরুদ্ধে ৭ জুন বাংলাদেশের জনগণ সাধারণ ধর্মঘট করে। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বাঙালি জাতিকে গোলাম করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর কনভেনশনের আলোচ্যসূচিতে বাঙালির মুক্তির জন্য ছয় দফা উত্থাপনের প্রস্তাব করেন। বৈঠকের সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ছয় দফা নিয়ে আলোচনা করতে রাজি হননি। ১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে ঢাকা বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানান। ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে দলীয় কর্মসূচি হিসেবে ছয় দফা গৃহীত হয়। ছয় দফা এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে এই পুস্তিকাটি বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে সযত্নে সংরক্ষিত ছিল।

স্বৈরশাসক আইয়ুব ছয় দফা দেওয়াকে অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করে বঙ্গবন্ধুকে 'বিচ্ছিন্নতাবাদী' বলে অভিহিত করেন এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা আইনে আওয়ামী লীগকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করেন। আওয়ামী লীগের ডাকে ১৩ মে সারা এলাকায় প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। প্রতিবাদ দিবসের জনসভায় ছয় দফার প্রতি জনসমর্থন ব্যক্ত করা হয়। দলের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ গ্রেফতার হলে সাংগঠনিক সম্পাদক মিজান চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। ৭ জুন ধর্মঘটের সময় বাংলাদেশের বিক্ষুব্ধ জনগণ স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবি জানায়। ৭ জুন আমাদের স্বাধীনতা চেতনার সূচনা বিন্দু রচিত হয়েছিল এই দিনে।

বঙ্গবন্ধুর উত্থাপিত ছয় দফা দাবি 'মুক্তির সনদ' বা বাঙালির 'বেঁচে থাকার দাবি' নয়; বরং এটা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি। ৭ জুনের প্রেক্ষাপটে অর্থাৎ ছয় দফা দিবসে বাঙালি জাতির বিসর্জন, সংগ্রাম ও প্রতিবাদের দিকটি সামনে আসে। ১৯৭১ সালের এই দিনে ছয় দফা দাবি আদায়ের আন্দোলনে বাঙালি জাতি জীবন দিয়েছে, রক্তে রঞ্জিত হয়েছে রাজপথ, প্রেপ্তার হয়েছে ছয় শতাধিক মানুষ, বিচার হয়েছে অগণিত মানুষের। ছয় দফা দাবি করার পর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো দলের নেতা থাকেননি; হয়ে ওঠেন আমাদের বাঙালিদের একমাত্র নেতা। পরবর্তীকালে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বাধীনতা-উত্তর রাজনীতি ও রাজনীতি সবই এক ব্যক্তিকে ঘিরে আবর্তিত হয় এবং তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি আর ব্যক্তি ছিলেন না; একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে।

ঐতিহাসিক ছয় দফায় য দাবিগুলো ছিল- প্রথম দফা: সরকারের বৈশিষ্ট্য হবে ফেডারেল বা যৌথরাষ্ট্রীয় ও সংসদীয় পদ্ধতির; তাতে যৌথরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলো থেকে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন হবে প্রত্যক্ষ এবং সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে। কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার প্রতিনিধি নির্বাচন জনসংখ্যার ভিত্তিতে হবে। দ্বিতীয় দফা: কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব থাকবে কেবল প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয় এবং তৃতীয় দফায় ব্যবস্থিত শর্তসাপেক্ষ বিষয়। তৃতীয় দফা: পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক মুদ্রা-ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যা পারস্পরিকভাবে কিংবা অবাধে উভয় অঞ্চলে বিনিময় করা চলবে। অথবা এর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে একটি মুদ্রা-ব্যবস্থা চালু থাকতে পারে এই শর্তে যে, একটি কেন্দ্রীয় সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যার অধীনে দুই অঞ্চলে দুটি রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। তাতে এমন বিধান থাকতে হবে যেন এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে সম্পদ হস্তান্তর কিংবা মূলধন পাচার হতে না পারে। চতুর্থ দফা: রাজস্ব ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকবে অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে। প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয়ের ব্যয় নির্বাহের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রয়োজনীয় রাজস্বের যোগান দেওয়া হবে। সংবিধানে নির্দেশিত বিধানের বলে রাজস্বের এই নির্ধারিত অংশ স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে জমা হয়ে যাবে। এহেন সাংবিধানিক বিধানে এমন নিশ্চয়তা থাকবে যে, কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্বের প্রয়োজন মেটানোর ব্যাপারটি এমন একটি লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে যেন রাজস্বনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নিশ্চিতভাবে অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে থাকে। পঞ্চম দফা: যৌথরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্য যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে, সেই অঙ্গরাজ্যের সরকার যাতে স্বীয় নিয়ন্ত্রণাধীনে তার পৃথক হিসাব রাখতে পারে, সংবিধানে সেরূপ বিধান থাকতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হবে, সংবিধান নির্দেশিত বিধি অনুযায়ী নির্ধারিত অনুপাতের ভিত্তিতে অঙ্গরাজ্যগুলো থেকে তা আদায় করা হবে। সংবিধান নির্দেশিত বিধানানুযায়ী দেশের বৈদেশিক নীতির কাঠামোর মধ্যে, যার দায়িত্ব থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে, বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কে চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক সরকারগুলোর হাতে থাকবে। ষষ্ঠ দফা: ফলপ্রসূভাবে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার কাজে সাহায্যের জন্য অঙ্গরাজ্যগুলোকে মিলিশিয়া বা আধা-সামরিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হবে।

১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তি সনদ ছয় দফা ঘোষণা দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আফজালের সভাপতিত্বে বিরোধী দলের সম্মেলন শুরু হয়। সাবজেক্ট কমিটির এই সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি পেশ করেন। প্রস্তাব গৃহীত হয় না। ৬ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটি পত্রিকা এ দাবি সম্পর্কে উল্লেখ করে বলে যে পাকিস্তানের দুটি অংশ বিচ্ছিন্ন করার জন্যই ছয় দফা দাবি আনা হয়েছে। ১০ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সংবাদ সম্মেলন করে এর জবাব দেন। ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। বিমানবন্দরেই তিনি সাংবাদিকদের সামনে ছয় দফা সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরেন।

আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটিতে ছয় দফা দাবি পাস করা হয়। আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে এ দাবি গ্রহণ করা হয়। ব্যাপকভাবে এ দাবি প্রচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় দলের নেতৃবৃন্দ পুরো পূর্ব পাকিস্তান সফর করে জনগণের কাছে এ দাবি তুলে ধরবেন। ছয় দফা দাবির ওপর বঙ্গবন্ধুর লেখা একটি পুস্তিকা দলের সাধারণ সম্পাদকের নামে প্রকাশ করা হয়। লিফলেট, প্যাম্ফলেট, পোস্টার ইত্যাদির মাধ্যমেও এ দাবিনামা জনগণের কাছে তুলে ধরা হয়।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিল, সে যুদ্ধের সময় পূর্ববঙ্গ বা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই অঞ্চলের সুরক্ষার কোনো গুরুত্বই ছিল না। ভারতের দয়ার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল পূর্ব বাংলাকে। ভারত সে সময় যদি পূর্ববঙ্গে ব্যাপক আক্রমণ চালাত, তাহলে ১ হাজার ২০০ মাইল দূর থেকে পাকিস্তান কোনোভাবেই এই অঞ্চলকে রক্ষা করতে পারত না। অন্যদিকে তখনকার যুদ্ধের চিত্র যদি পর্যালোচনা করি, তাহলে আমরা দেখি পাকিস্তানের লাহোর পর্যন্ত ভারত দখল করে নিত যদি না বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকেরা সাহসের সঙ্গে ভারতের সামরিক আক্রমণের মোকাবিলা করত।

একটু পেছন ফিরে তাকালে আমরা দেখি যে বাঙালির বিরুদ্ধে সব সময় পাকিস্তানের শাসক চক্র বৈমাত্রেয়সুলভ আচরণ করেছে। প্রথম আঘাত হানে বাংলা ভাষা বা আমাদের মাতৃভাষার ওপর। তারা আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত শুরু করে। রক্ত দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করে বাঙালিরা। সে ভাষা আন্দোলন শুরু করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান, ১৯৪৮ সালে। মূলত তখন থেকেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন-শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে হবে।

বাঙালিরা সব সময়ই পশ্চিমাদের থেকে শিক্ষা-দীক্ষা, সাংস্কৃতিক চর্চায় সমৃদ্ধ ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনেও অগ্রণী ভূমিকা ছিল এই অঞ্চলের মানুষের। জনসংখ্যার দিক থেকেও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি। ৫৬ শতাংশ মানুষের বসবাস ছিল পূর্ববঙ্গে।

আইয়ুব খানের নির্যাতন-নিপীড়নের পটভূমিতে যখন ছয় দফা পেশ করা হয়, অতি দ্রুত এর প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধি পেতে থাকে। পৃথিবীতে এ এক বিরল ঘটনা, কোনো দাবির প্রতি এত দ্রুত জনসমর্থন পাওয়ার।

৭ জুন হরতাল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘১২টার পরে খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে, হরতাল হয়েছে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। তারা ছয় দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়। বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তিস্বাধীনতা চায়, শ্রমিকের ন্যায্য দাবি, কৃষকদের বাঁচার দাবি তারা চায়, এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যে হয়েই গেল।’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃ: ৬৯)

১৯৬৬ সালের ১০ ও ১১ জুন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সভায় হরতাল পালনের মাধ্যমে ছয় দফার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করায় ছাত্র-শ্রমিক ও সাধারণ জনগণকে ধন্যবাদ জানানো হয়। পূর্ববঙ্গের মানুষ যে স্বায়ত্তশাসন চায়, তারই প্রমাণ এই হরতালের সফলতা। এ জন্য সভায় সন্তোষ প্রকাশ করা হয়।

পূর্ব বাংলার বাঙালিদের ভোটেই মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। এটি এক ঐতিহাসিক সত্য। অবিভক্ত ভারত রাষ্ট্রে পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমানের অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত হচ্ছিল না। ভারত রাষ্ট্রে পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমান বরাবরই নিজেদের অপর ভেবেছে; ভাবতে বাধ্য হয়েছে। ফলে পূর্ব বাংলার বাঙালি জনগোষ্ঠী খুব কওে চেয়েছে একটা নতুন রাষ্ট্র, যে-রাষ্ট্রে তাদের অংশগ্রহণ থাকবে; অর্থনৈতিক অধিকার ও আত্মমর্যাদা সমুন্নত থাকবে।

১৯৪৭ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বাঙালির পক্ষ থেকে দাবিদাওয়া ও প্রতিশ্রুতির দফাও কম ঘোষিত হয়নি। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবি মূলত দেড়যুগ ধরে বাঙালি যা আকাঙ্ক্ষা করেছে তারই অত্যাশ্চর্য সংক্ষিপ্ত প্রকাশ।

এই নব্য ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার বাঙালিরা কথা বলেছে, রাজপথে নেমেছে। হাটে, মাঠে, ঘাটে, রাজপথে উত্তাপও ছড়িয়েছে। বিদ্যায়তনে একাডেমিক পরিসরে পণ্ডিতদের মধ্যেও ওইসব বঞ্চনা আর অমর্যাদা নিয়ে কম কথা হয়নি। কোটি কথা, হাজারও শ্লোগান-মিছিল, অমেয় রক্ত, হাজারও রাজনৈতিক কবিতা-প্রবন্ধ-উপন্যাস-নাটক, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অযুত-নিযুত একাডেমিক শব্দাবলী ও তত্ত্ব নীরবে ধারণ করে আছে মাত্র এই ছয়টি দফা। ছয় দফা আসলে বাঙালির দীর্ঘকালের রাষ্ট্র, গণতন্ত্র ও আত্মমর্যাদা সম্পর্কিত ধারণার সংক্ষিপ্ত প্রকাশ।

ছয় দফা শেখ মুজিবুর রহমানের ওইরকম এক রাজনৈতিক দাবিনামা। তিনি তার জনগোষ্ঠীর আকাক্সক্ষাকে, দীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা দাবিকে একটি সংক্ষিপ্ত পরিসরে ধরে ফেলেছেন। বড় নেতা তো কবির মতোই। তিনি তো তার জনগোষ্ঠীর অব্যক্ত কথাকে ব্যক্ত করেন। তিনি স্বপ্ন দেখান, স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চান। তিনি কবির মতোই সম্মোহিত করেন।

ছয় দফা শেখ মুজিবের এবং আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা কী পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছিল তা বোঝা যায় ৭ জুন হরতালের পরে ন্যাপের প্রচারপত্র থেকে। ন্যাপের প্রচারপত্রে হরতালের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে পাকিস্তানের জীবন ইতিহাসে এমন হরতাল আর দেখা যায় নাই। পিকেটিংয়ের প্রয়োজন হয় নাই, স্বেচ্ছাসেবকের কথা কেউ চিন্তাও করে নাই-তবুও ৭ জুন ভোরবেলা দেখা গেল লক্ষ জনতা নিজেরই স্বেচ্ছাসেবক, চোখেমুখে তাদের দৃপ্ত শপথ, আত্মশক্তিতে গভীর আস্থা- কোনও ভ্রুকুটি, কোনও নীতিই তাহাদিগকে টলাইতে পারিবে না।’ কিন্তু আইয়ুব সরকার হত্যা, গণ-গ্রেফতার, জেলজুলুমের মাধ্যমে ছয় দফা আন্দোলনকে থামিয়ে দেয়। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া এবং মুজিবের গ্রহণযোগ্যতা বোঝা যায় উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে।

ছয় দফা আন্দোলন-সংগ্রাম ছিল মূল বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রাম; ন্যায্য হিস্যার আন্দোলন। পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসে ছয় দফা আন্দোলনসহ এর আগের সব আন্দোলন-সংগ্রাম জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রাম বলে কীর্তি হওয়ায় ছয় দফাকেও বলা হয় পাকিস্তানের শেকল কেঁটে বের হয়ে আসার আন্দোলন। কথাটা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের পরিপ্রেক্ষিতে ঠিকই আছে। কিন্তু ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব বাংলার বাঙালির পাকিস্তান-ব্যাকুলতা প্রমাণ করে এই আন্দোলন ছিল মূলত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যেই ছয় দফার দাবিগুলো তোলা হয়েছিল।


বাঙালি লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে যে-স্বায়ত্তশাসন দাবি করেছিল ছয় দফা তারই প্রতিফলন। আইয়ুুব সরকার বাঙালিকে অধিকার দেওয়ার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। বরং ছয় দফাকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী’, ধ্বংসাত্মক’ বলে অভিহিত করা হয়। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ‘এক নম্বর দুশমন’ বলে সাব্যস্ত করা হয়।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আছে এমন যেকোনো রাজনৈতিক দল এবং এর নেতাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ জনগণের আকাক্সক্ষা অনুধাবন করা। শুধু অনুধাবন করলেই হয় না, জনগণের আকাক্সক্ষাকে দলের কর্মকাণ্ডের মধ্যে প্রতিফলিত করাও একটা বড় কাজ। জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ও এর নেতাদের এই দায়িত্ব থাকে আরও একটু বেশি। কারণ যেকোনো জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রাম দানা বেঁধে ওঠে সাধারণ মানুষের আকাক্সক্ষাকে পুঁজি করেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা ছিল এমন একটি রাজনৈতিক দাবি যা পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার বাঙালি জনগোষ্ঠীর আকাক্সক্ষাকে সবচেয়ে গভীরভাবে অনুবাদ করতে পেরেছিল। ছয় দফা দাবি আর এই দাবিকেন্দ্রিক আন্দোলনের এটাই কি সবচেয়ে বড় তাৎপর্য নয়!

১৯৬৬ সালের ৮ মে নারায়ণগঞ্জে আয়োজিত সভায় বক্তৃতা করার পরে দেশরক্ষা আইনের ৩২ নম্বর ধারায় শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর সাংবাদিকদের বলতেন, 'আমি যতদিন গভর্নর, শেখ মুজিবকে জেলেই থাকতে হবে।' ৬ দফা কর্মসূচি বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের পরে ব্যাপক আকার ধারণ করে। জনগণ মিছিলে গণআন্দোলনের প্রতিষ্ঠায় উজ্জীবিত হয়। প্রায় আটশত লোককে গ্রেফতার করে মোনেম খান। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং ৬ দফার সমর্থনে হরতাল পালন শুরু করে। ছাত্রজনতা ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হলে ১৪৪ ধারা জারি করে গভর্নর। স্লোগান ওঠে 'জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনব।' এই সময় শেখ মুজিবকে প্রধান আসামী করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা জারি করা হয়।' প্রবল প্রতিরোধে উত্তাল হয়ে ওঠে পূর্ববঙ্গবাসী।

আওয়ামী লীগ 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে' প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুললে পুলিশের নির্যাতনে শহীদ হয় অনেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ 'সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করে ১১ দফাভিত্তিক আন্দোলনের সূত্রপাত করে। এই আন্দোলনের প্রথম শহীদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামান পরে শহীদ হয় স্কুলছাত্র মতিউর রহমান। শহীদ হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের চাপে ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। বঙ্গবন্ধু মুক্তিলাভ করেন। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রমনা রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করা হয় লক্ষ লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে।

১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ সামরিক শাসক আইয়ুব খান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। পুরো পাকিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক শাসন জারি হয়। ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন করার কথা ঘোষণা করে। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হন। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন, কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাকে প্রধানমন্ত্রী না করার জন্য ষড়যন্ত্র করে। ইয়াহিয়া খান সংসদ অধিবেশন স্থগিত করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশব্যাপী শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে তার ভাষণে বলেন, 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।  শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন। ৫ বছরের ব্যবধানে তিনি স্বাধীন দেশের স্থপতি হন। ৬ দফা থেকে স্বাধীনতা এই ছিল গৌরবের ইতিহাস।

হীরেন পণ্ডিত, প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো

Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.