× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

মানুষের মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ছে ভেজাল খাদ্যে

ওসমান গনি

০৪ ডিসেম্বর ২০২২, ০৫:২০ এএম

মানুষের জীবনে খাদ্য অপরিহার্য,  সে খাদ্য হতে হবে ভেজালমুক্ত। খাদ্য একজন মানুষের জীবনের প্রধান মৌলিক অধিকার। খাদ্য গ্রহণ ছাড়া মানুষসহ কোনো প্রাণীই বেঁচে থাকতে পারে না। তবে সে খাবার অবশ্যই হতে হবে বিশুদ্ধ। দূষিত বা ভেজালমিশ্রিত খাদ্য মানুষের জন্য স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়ে থাকে। আজকের বাংলাদেশে বিশুদ্ধ খাবার খুঁজে পাওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। বাজার থেকে কেনা কোনো খাদ্যই যেন আর বিশুদ্ধ নেই। বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি মানুষ ভেজাল ও দূষিত খাদ্য গ্রহণের কারণে অসুস্থ হয়। এর মধ্যে মারা যায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এ ছাড়া দূষিত খাদ্য গ্রহণজনিত কারণে ৫ বছরের কম বয়সের আক্রান্ত হওয়া ৪৩ শতাংশ শিশুর মধ্যে মৃত্যুবরণ করে ১ লাখ ২৫ হাজার।


পরিবেশ বাঁচাও অন্দোলনের (পবা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু  ভেজাল খাদ্য গ্রহণের কারণে প্রতি বছর দেশে ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে, ২ লাখ লোক কিডনি রোগে,দেড় লাখ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া গর্ভবতী মা ১৫ লাখ বিকলাঙ্গ শিশুর জন্মদান করেন। ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে হেপাটাইটিস, কিডনি, লিভার ও ফুসফুস সংক্রমিত রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে। গণমাধ্যমে খবরে প্রকাশিত, ২০১৫ সালে দিনাজপুরে কীটনাশকমিশ্রিত লিচুর বিষক্রিয়ার ৮ এবং ২০১২ সালে ১৪ জন শিশুর প্রাণহানি ঘটে। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল (যেমন: ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, প্রোফাইল প্যারা টিটিনিয়াম পাউডার, ইথেফেন ইত্যাদি) মেশানোর বিষয়টি দেশে দীর্ঘদিন ধরেই নিন্দিত হয়ে আসছে। অথচ জনগণ যেন এ থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছে না। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, দেশে শিল্প খাতে ফরমালিনের প্রয়োজন ৪০-৫০ টন। কিন্তু প্রতি বছর ফরমালিন আমদানি করা হয় প্রায় ২০৫ টন। অর্থাৎ, বাড়তি ১৫০ টনের বেশি ফরমালিন বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে দেশবাসীর পেটে গেছে। অনেক সময় বিভিন্ন বাজারকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফরমালিনমুক্ত ঘোষণা করতে দেখা যায়। অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ঐ বাজার আগে যা ছিল, কয়েক দিন পরে আবার তা-ই হয়েছে! ভেজালযুক্ত খাবার গ্রহণের কারণে জনগণ স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভুগছে। তবে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে অগণিত শিশু, যাদের বলা হচ্ছে আগামীর ভবিষ্যতৎ। এ ধরনের পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। আমাদের পুরো খাদ্যচক্রের মধ্যে প্রতিনিয়ত যেভাবে বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাতে মনে হয় জাতি হিসেবে আমারা দ্রুতগতিতে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। 


আমাদের দেশে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফার জন্য খাদ্যে ভেজাল ও মানহীন খাদ্য সামগ্রি উৎপাদন ও বিপণন করে চলেছে। খাদ্যে ভেজাল নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ভোক্তা অধিকার সংস্থা, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমে জোরালো প্রতিক্রিয়া হলেও ভেজাল বন্ধ করে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। ২০১৩ সালে ভেজাল খাদ্য প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রণয়নের দাবি উঠলে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ পাস করা হয়। আশা করা হয়েছিল, আইন কঠোর হলে খাদ্যে ভেজাল দেয়া বা মানহীন ও অননুমোদিত খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন কমে আসবে। আদতে তা হয়নি। গত এক দশকে খাদ্যে ভেজালের হার কমেনি বরং ভিন্ন আঙ্গিকে আগের চেয়ে বেড়েছে। সেই সাথে ভেজাল বিরোধী অভিযানও আগের চেয়ে কমেছে। আইন থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা এবং খাদ্য উৎপাদনকারি কারখানাগুলোতে উৎপাদিত পণ্যের মান সুষ্ঠু তদারকি না থাকায় খাদ্যপণ্য উৎপাদক ও বিক্রেতারা জনস্বাস্থ্য ও আইনগত শাস্তির কোনো তোয়াক্কা করছেনা। সম্প্রতি রাজধানীর টঙ্গিতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের এক ভেজাল বিরোধী অভিযানে স্থানীয় বাজারে জনপ্রিয় কয়েকটি ফলের রস উৎপাদনে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অনুমোদনহীনতা, মানহীনতা এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি থাকায় একটি কারখানাকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমান আদালত। ফলের রসের নামে ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশ্রিত এসব পানীয় মূলত শিশুখাদ্য হিসেবেই বিক্রি হয়ে থাকে। না জেনে না বুঝে শিশুরা এসব ড্রিঙ্ক পান করে নানা রকম জটিল স্বাস্থ্য সমস্যার শিকার হচ্ছে। মাছ-মাংস, ফল, সবজি, চাল-ডাল, তেল, আটা-ময়দা, পাউডার দুধ, কেক-পেস্ট্রি, আইসক্রিম, মিষ্টান্ন, দধি থেকে শুরু করে হোটেল-রেস্তোরা ও বাজারে বিক্রি হওয়া এমন কোনো পণ্য নেই, যা ভেজাল ও নকলের শিকার হচ্ছে না। দেশের অগণিত মানুষ নতুন নতুন স্বাস্থ্য সমস্যার শিকার হওয়ার মূল কারণই হচ্ছে ভেজাল ও রাসায়নিক মিশ্রিত মানহীন খাদ্য। উপরন্তু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে অসুস্থ্য হয়ে ডাক্তারের চিকিৎসা নিতে যাওয়া সাধারণ মানুষ নকল, মানহীন ওষুধের কারণে আরো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ভেজাল, নকল, মানহীন ও অননুমোদিত ও ঝুঁকিপূর্ণ খাদ্যপণ্যের ব্যবসা দেশে একটি সামাজিক মহামারি আকার ধারণ করেছে, যা দেশের কোটি কোটি মানুষকে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ঠেলে দিয়েছে। ফর্মালিন, কার্বাইড, ডিডিটিসহ ক্ষতিকর ক্যামিকেল ও রং মিশ্রিত খাদ্যপণ্যের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করতে হবে।

খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি ভেজাল-নকলের মাত্রা বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রেও অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। স্বল্প আয়ের দরিদ্র মানুষ অপেক্ষাকৃত কমমূল্যে ভেজাল-নকল পণ্য কিনে প্রকারান্তরে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভেজাল বিরোধী অভিযানকে সফল করতে হলে দেশের সব বাজারে, খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিটি কারখানায় পণ্যের মান নিশ্চিতে নিয়মিত তদারকি ও অভিযান অব্যাহত রাখা জরুরি হলেও বিদ্যমান ব্যবস্থায় মাঝেমধ্যে নাম কা ওয়াস্তে অভিযান পরিচালনা করতে দেখা যায়। লাখ লাখ শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টিকারী কারখানার মালিককে দু-চার লাখ টাকা জরিমানা আদায় করে ছেড়ে দেয়ার পর তারা পুনরায় একই ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা বানাচ্ছে। 

ভেজাল বিরোধী অভিযানের ম্যাজিস্ট্রেটরা ফুটপাথের ব্যবসায়ী, দোকানদার ও ছোট হোটেল-রেস্তোরাকে ১০-২০ হাজার টাকা জরিমানা করেই দায় সারছেন। এতে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানির বিভিন্ন পণ্যের ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর, অননুমোদিত, ক্ষতিকর উপাদান ও রাসায়নিক মিশ্রিত পণ্যের তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাঝে মধ্যে ফাঁস হলেও ওসব কর্পোরেট কোম্পানির পণ্যের মানহীনতার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কোনো দৃষ্টান্ত নেই। ভেজাল ও মানহীন খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করতে প্রতিটি বাজারে নজরদারি, নিরাপদ খাদ্য আইনের কঠোর প্রয়োগ বাড়াতে হবে। দোষি কোম্পানির বিরুদ্ধে মোটা অংকের জরিমানা ছাড়াও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অনৈতিক পন্থায় অধিক মুনাফা করার মাইন্ডসেট বা সাধারণ মানসিক প্রবণতা দূর করতে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতা গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিটি এলাকায় পণ্য ক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করে সমিতির নিবন্ধিত টাটকা পণ্য বা খাবার ক্রয় করে স্থানীয়ভাবে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে উন্নত প্যাকেজিং ও লেবেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারলে খাদ্যের ভেজাল যেমন রোধ করা যাবে, তেমনি অপচয়ও অনেকাংশে কমানো সম্ভব। তবে ব্যবসায়ী সমিতির মাধ্যমে খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছে কিনা, সেটার মনিটরিং ব্যবস্থা থাকা উত্তম। পাইকারি বাজারগুলোকে উন্নয়নের মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে গড়ে তুলে টাটকা খাবার বা পণ্যের উন্নত সংরক্ষণ ও ডিসট্রিবিউটর বা হোম ডেলিভারির মাধ্যমে সরবরাহ ব্যবস্থা করতে পারলে কর্মসংস্থানেরও সুযোগ বাড়বে। ভেজাল রোধে দরকার ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা, প্রচার মাধ্যমের দায়িত্বশীলতা, প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন বন্ধ করা, সামাজিক প্রতিরোধ, নৈতিক শিক্ষা, উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত সব ধাপে নজরদারি, ভেজালবিরোধী আইনের সঠিক ও কঠোর প্রয়োগ, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান জোরালো করা এবং ব্যবসায়ীদের ভাল মানসিকতা। তবে খাদ্যে ভেজাল রোধে জনসচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। ‘একজন অন্যজনকে ঠকাবো না’ এমন মানসিকতাই পারে খাদ্যে ভেজাল রোধ করতে। রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারী উদ্যোগে বিজ্ঞাপন আকারে ভেজালবিরোধী প্রচার চালালে সুফল আসতে পারে। সংবাদ মাধ্যম, ইউটিউব এবং সেমিনারের মাধ্যমে নিজ নিজ উদ্যোগে প্রচার চালানো যেতে পারে। লিফলেট, পোস্টার, নাটক, জারিগান, কার্টুন ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জনসচেতনতার ব্যবস্থা করা, স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার পাঠ্য বইয়ে খাদ্যপণ্যে ভেজাল নিয়ে সমসাময়িক বিষয় অন্তর্ভুক্ত এবং মুক্ত আলোচনা করা, খাদ্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা অতীব জরুরী। পূর্বঘোষণা ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা গেলে খাদ্যে ভেজাল রোধ সম্ভব। সেই সঙ্গে পাড়া বা মহল্লায় যুব সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় খাদ্যে ভেজাল রোধে সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলে সুফল মিলবে অনেক বেশি পরিমাণে। 

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.