ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তানি আমল এমনকি স্বাধীন দেশেও চালু ছিল ঠাকুরগাঁওয়ের বিমান বন্দরটি। তখন দেশের জনসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি। এখন ২০ কোটি। ৪১ বছরেও বিমান বন্দরটি চালু না হলে, আর কত বছরে কত জনসংখ্যা বৃদ্ধি হলে চালু হবে এ বিমান বন্দর? এ প্রশ্নটি শুধু মাত্র গুটিকয়েক মানুষের না। জেলার প্রত্যেকটি মানুষের। জেলায় শিল্পকারখানা নির্মাণের জন্য বিমানবন্দরটি চালু জরুরি বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তারা মনে করছে আগামির সমৃদ্ধ ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যেকটি মানুষের আর্থিক অগ্রগতির ভাগ্য নির্ভর করছে এ পরিত্যাক্ত বিমান বন্দরটির উপর। বলা যায় এ পরিত্যক্ত বিমান বন্দরের রানওয়েতে আটকে আছে আগামির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ ঠাকুরগাঁও।
বিমানবন্দরটি ঠাকুরগাঁও জেলার শিবগঞ্জে ১৯৪০ সালে ৫৫০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি তৎকালীন বৃটিস সরকার সরকারি ও সামরিক কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলো। পাকিস্তান সরকার বিমানবন্দরের জমি আর্মি স্টেট হিসেবে ঘোষণা দিলে ১১১ একর জমি বুঝে পায় সিভিল অ্যাভিয়েশন। ওই অংশে বন্দরের ভবন ও রান রয়ে গেল অবস্থিত।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারতীয় বিমান বাহিনী এখানে হামলা চালালে বিমানবন্দরের রান ওয়েটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরবর্তীতে দেশ স্বাধীনের পর এই বিমানবন্দরটি ১৯৭৭ সালে বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য সংস্কার করা হয় এবং কয়েক বছর এখানে কিছু বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালিত হলেও আগ্রহের অভাব এবং যাত্রী সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে বিমানবন্দরের কার্যক্রম থেমে যায় । পরে ১৯৮০ সালে বিমান বন্দরটি পরিত্যক্ত হয়। এখন বর্তমানে বিমান বন্দরের অনেক জমিতে কৃষি আবাদ হচ্ছে। রানওয়েটি স্থানীয়দের গোচরণ, ফসল মারাই ও ফসল শুকানোর চাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখে ঠাকুরগাঁও বিমান বন্দরটির অবকাঠামো পরিদর্শন করেন সরকারের সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের কাছে মত বিনিময় করে তিনি বলেন, ঠাকুরগাঁও বিমান বন্দর চালুর বিষয়ে শীঘ্রই ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকার মানুষ সাথে থাকলে বিমান বন্দরটি চালু করা অসম্ভবের কিছু নয়। এক বছরের মধ্যেই ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দর চালু করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন এবং সে সময়ে এটাও বলেছিলেন যে, আগামী ছয় মাসের মধ্যে এ বিমানবন্দরের কারিগরি ত্রুটিপূর্ণ কাজগুলো মেরামত করা হবে।
সে সময় পরিত্যাক্ত থাকা বিমান বন্দরটি দীর্ঘ অনেক বছর পর চালু হবে শুনে আশাবাদী ঠাকুরগাঁওবাসী সাধুবাদ জানিয়েছেলেন সাবেক এই মন্ত্রীকে। কিন্তু ঠাকুরগাঁওবাসীর সময়ের দাবিতে পরিণত হওয়া বন্ধ বিমানবন্দরটি চালুর বিষয়ে একধাপও অগ্রসর হয়নি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণায়লয়। এমন মন্তব্য ঠাকুরগাঁওয়ের সমাজকর্মী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র মাহাবুব আলম রুবেল।
রুবেল বলেন, সরকার ঠাকুরগাঁওকে একটি সম্ভাবনাময় অঞ্চল বললেও বিমান বন্দরটি চালু হচ্ছেনা। কিন্তু এখানকার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে বিমান বন্দরটি অতপ্রত ভাবে জড়িত। বিমান বন্দরটি চালু করার পূর্বে লোকসানের কথা চিন্তা করেই সরকার এটি চালু করতে অনাগ্রহতা দেখাচ্ছে। কিন্তু ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড়ের কি পরিমান মানুষ বিমানে প্রতিদিন যাতায়াত করছে? বিমান বন্দরটি চালু করতে কি পরিমাণ বাজেট লাগবে? কাজ করতে কি পরিমাণ সময় লাগবে? প্রতিদিন সর্বনিম্ন দুইটি ফ্লাইট এখানে উঠা নামা করলে কি পরিমাণ যাত্রী লাগবে, কি পরিমাণ অর্থ আয়-ব্যয় হবে এর সঠিক অর্থনৈতি সমীক্ষা কোন জনপ্রতিনিধি বা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্তদের উপস্থাপনায় আমরা পাইনি। আমি মনে করি প্রথমে বিমান বন্দরটি চালু করার বিষয়ে সরকারের কার্যকরী ভূমিকা রেখে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এর সঠিক সমীক্ষা উপস্থাপন করা। সেই সাথে এই সমীক্ষাকে ভিত্তি করে এ অঞ্চলের মানুষের দাবিকে জড়ালোভাবে প্রয়োগ করা বঞ্চনীয় বলেও মনে করি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ইতিহাস বিভাগের ছাত্র মোঃ বাবুল হোসেন বলেন ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলায় অনেক প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন রয়েছে। দেশে-বিদেশের অনেক দর্শনার্থী যোগাযোগ ব্যবস্থার ভালো মাধ্যম না পাওয়ায় অনেক সময় ব্যয় করে এতদূরে যেতে চায়না। বিমান বন্দরটি চালু হলে অনেক পর্যটক, দর্শনার্থী ঠাকুরগাঁওয়ে এসব দর্শনীয় জায়গায় খুব কম সময়ে যেতে পারবে। এতে করে যে সব প্রত্নতাত্বিক স্থাপনা গুলো আছে এগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণ করতে জাড়ালো ভূমিকা রাখবে সরকার। বলা যেতে পারে শুধু মাত্র ওই পরিত্যাক্ত বিমান বন্দর চালু হচ্ছেনা বলে উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ের সাথে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও খুব বেশি সংযুক্ত হতে পারছেনা দেশ বিদেশের পর্যটকরা।
জেলার একটি বেসরকারি কলেজের প্রভাষক মাহমুদ হাসান প্রিন্স বলেন, এ অঞ্চলে দেশী ও বিদেশী কোন বড় বিনিয়োগকারী হাজার হাজার কোটি টাকা শিল্পখাতে বিনিয়োগ করলে সবার আগে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দিবে। কিন্তু উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা সম্ভাবনাময় ঠাকুরগাঁওয়ে শিল্পের বিপ্লব ঘটার প্রধান বাধা যোগাযোগ ব্যবস্থা। তাই এখানে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করছেনা। এখানে বিমান বন্দরটি চালু হলে এ অঞ্চলে শিল্পের বিপ্লব ঘটবে এতে কোন সন্দেহ নেই। ফলে এ অঞ্চলের প্রত্যেকটি পেশার মানুষ এর আর্থিক সুফল ভোগ করবে। এভাবে বিমান বন্দরটি চালু করার বিষয়ে কালক্ষেপন করলে দেশ ও জেলা দিন দিন পিছিয়ে পড়বে এবং আরও বেশি সংকট সৃষ্টি হবে।
অর্থনীতিক বিশ্লেষক, মতিউর মিঠু বলেন, বিমান বন্দরটি পুন:প্রতিষ্ঠিত করতে সর্বোচ্চ ১ শ কোটি টাকা লাগবে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এ বাজেট থেকে মাত্র ১০০ কোটি টাকা একটি জেলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরু ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি বলেন, বিমান বন্দর চালু করতে দৃশ্যমান কাজ শুরু হলে, কাজ শেষ হতে হতে যে সময় লাগবে সে সময়ে ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড়ের মানুষের বিমানের প্রতি আগ্রহ আরও বেশি বাড়বে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh