× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

একান্ত সাক্ষাৎকারে ইনু

দুর্নীতি গুণ্ডাতন্ত্রের দাপটে সুশাসন মার খাচ্ছে

সাজেদা হক

১২ জানুয়ারি ২০২২, ০৫:২৯ এএম । আপডেটঃ ১২ জানুয়ারি ২০২২, ০৫:৩১ এএম

হাসানুল হক ইনু সাবেক তথ্যমন্ত্রী। তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ একাংশের নেতা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক তার দল। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বাংলাদেশের প্রাপ্তি, প্রত্যাশা এবং দিকনির্দেশনা বিষয়ক কথা বলেছেন সংবাদ সারাবেলার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাজেদা হক।

সংবাদ সারাবেলা: ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নিয়ে যদি কিছু বলেন?
হাসানুল হক ইনু: দেখুন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের স্বপ্ন ছিলো একটা শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং স্বাবলম্বী বাংলাদেশের। যে বাংলাদেশে বাঙালিয়ানার চর্চা হবে এবং আমরা গর্বিত হবো। সেই স্বপ্ন নিয়ে আমরা যুদ্ধ করেছি। সেই যুদ্ধে আমরা পাকিস্তানি সামরিক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেছি, তাদের দোসরদের পরাজিত করেছি। পাকিস্তানিরা নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। সুতরাং মনে রাখবেন যে, ১৬ই ডিসেম্বর যে বিজয় দিবস এটা কিš‘ পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশ সরকারের কোন সন্ধি চুক্তি ছিলো না, এটা বাংলাদেশ সরকারের কাছে বা মিত্রবাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ছিলো। দেশ স্বাধীন হওযার পর বহু মানুষ সমালোচনা করার চেষ্টা করেছে যে বাংলাদেশ টিকবে না, বাংলাদেশ একটি তলাবিহীন ঝুড়ি, বাংলাদেশের কোন ভবিষ্যৎনেই, এতো ছোট ভূখ-ে এতো মানুষ কোনভাবেই টিকবে না, না রাজনৈতিকভাবে, না অর্থনৈতিকভাবে। এইসব সমালোচনা শুনতে শুনতে আমাদের মানে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রাটা শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ আজকে ৫০ বছরে পদার্পণ করেছে।  যখনপেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি তখন আমি অর্জনগুলো দেখি। দেখি, কি নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে আমরা প্রমাণ করেছি যে ৫০ বছরে বাংলাদেশ টিকে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন আছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর দরবারে মাথা উঁচু করে আছে এবং গর্বিত জাতি হিসেবেই জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে ভূমিকাও রাখছে। আমি এভাবে বলবো যে, ৫০ বছরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিই হলো স্বাধীনতা। চার হাজার বছরের ইতিহাসে অনেকে অনেক রকম চেষ্টা করেছে কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে স্বাধীনতার দরজাটা খুলে যায় এবং বাঙ্গালি জাতি, স্বত্তার ভিত্তিতে একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায়। এটা সবচেয়ে বড় অর্জন। দ্বিতীয় অর্জন হলো বাংলাদেশ ভালোভাবেই টিকে গেলো এবং টিকে আছে ভালভাবেই।
আবার আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার দিকে যদি নজর দেই তাহলে দেখি যে, স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশ একটি অনুন্নত দেশ ছিলো, পশ্চাৎপদ দেশ ছিলো। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে আমি বলবো, কে অস্বীকার করবে? নিন্দুকের কথাই বলুন কিংবা শত্রুদের কথাই বলুন অথবা বাহ্যিক শক্তির কথাই বলুন-আপনার কি অস্বীকার করতে পারবেন যে, অনুন্নয়ন থেকে, পশ্চাদপদতা থেকে আমরা দেশটাকে বের করে আনতে পেরেছি। শুধু তাই না, চরম দারিদ্র অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছি। আমরা সাড়ে সাত কোটি মানুষ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম, এখন ষোল কোটি মানুষ এবং এই ষোল কোটি মানুষের এই দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা ঈর্ষনীয় সবার কাছে।  মাঝখানে যদি রাজনৈতিক দুর্যোগ না হতো অর্থাৎ সামরিক উপুর্যপরি হস্তক্ষেপ না হতো তাহলে  বাংলাদেশ হয়তো আরো  এগুতে পারতো।
 
আর্থ-সামাজিক অর্জনের দিকে যদি আমি তাকাই তাহলে দেখতে পাবো যে, বাংলাদেশের গড় আয়ু বেড়েছে, মাতৃমৃত্যুর হার, শিশুমৃত্যুর হার কমে গিয়েছে। পূষ্টিগ্রহণের মাত্রা বেড়েছে, গৃহায়নের চিত্র বদলে গেছে, আমাদের স্যানিটেশন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে, আমরা সারাবছর সুপেয় পানি পান করি, আমাদের বস্ত্র ব্যবহারের হার বেড়েছে, বিদ্যৃতের ব্যবহার সর্বোচ্চ এবং সর্বোত্র নিশ্চিত হয়েছে এবং নারীর ক্ষমতায়নে চমৎকার সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। শিক্ষায় দশম শ্রেনী পর্যন্ত বালক-বালিকার সখ্যা প্রায় সমান সমান। সুতরাং শিক্ষায় বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে বলেন, কর্মসংস্থানেই বলেন, বাংলাদেশ দারুন উন্নয়ন সাধন করেছে।

যোগাযোগ ব্যবস্থায় বাংলাদেশের উন্নয়ন অভূতপূর্ব। ৫০ বছর আগে ঢাকা পৌঁছাতে সময় লাগতো অনেক বেশি আর এখন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও ঢাকায় ১২ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছানো যায়। কোন উপজেলার সাথে কোন অঞ্চল বিচ্ছিন্ন না। দুর্গম এলাকা বলে এখন আর কোন এলাকা নেই। এছাড়াও যেটা চোখে পড়ার মতো তা হলো, প্রতি ঘরে ঘরে যেন একটা সচ্ছলতার ছোঁয়া লেগেছে। আমি এভাবে বলবো যে, আপনি কত টাকা আয় করলেন, সেটা বড় কথা নয়, আপনি ভোগ করছেন কি-সেটাই বড় কথা। মনে করেন আগে একজন রিকশাওয়ালা দেড় বেলা খেতো, এখন খায় তিনবেলা। এসব বিবেচনা করলে অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে একটা স্বাবলম্বীতার ছাপ আছে। কিন্তু ৭১ এর অনুন্নয়নতা, পশ্চাৎপদতা থেকে বহুগুনে উন্নত এবং স্বাবলম্বী বাংলাদেশ।

আমাদের বিদেশি অর্থের উপর নির্ভরশীলতা কমেছে। আমরা ৭১ পরবর্তী সময়ে যখন বাজেট তৈরি করি, তখন বিদেশী অর্থের উপর নির্ভরশীলতার ছাপ ছিলো। বিদেশের টাকা না আসলে আমি বাজেট তৈরি করতে পারতাম না। এখন কিš‘ বিদেশ নির্ভরতার কোন ছাপ নাই। নিজের বাজেট নিজেই তৈরি করছে বাংলাদেশ। এটা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শক্তিমত্ত্বার বিশাল পরিচয়। একথায় বলবো, বাংলাদেশ বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল। এর বাইরে পোশাকশিল্প খাত, খাদ্য উৎপাদন খাত, মৎস উৎপাদন খাত, সবজি উৎপাদন খাত, বস্ত্র উৎপাদন খাত কিংভা গবাদি পশুর উৎপাদন খাতে বাংলাদেশের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। এসবকিছু মিলিয়ে, আমাদের যে সবুজ পাসপোর্ট, সেই পাসপোর্ট নিয়ে ৫০ বছর আগে যে কয়জন লোক বিদেশে যেতে পেরেছে  তা সংখ্যায় ছিলো অনেক কম, এখন এ সংখ্যাটা প্রায় দেড় কোটির মতো। এসবকিছু মিলিয়ে আমি মনে করি, ৫০ বছরের মাথায় অনুন্নয়ন, পশ্চাৎপদতা বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ একটু স্ব”ছলতার মুখ দেখছে, স্বাবলম্বীতার মুখ দেখছে। এগুলো হ”েছ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন।
এর বাইরে যদি প্রাপ্তির দিকে তাকাই তাহলে কি দেখি যে বাংলাদেশে একটা সামরিক হস্তক্ষেপ হয়েছে, সরাসরি উপুর্যপরি সামরিক হস্তক্ষেপ হয়েছে, আধা সামরিক হস্তক্ষেপ হয়েছে। এরপরেও বাংলাদেশের অর্জন ব্যাপকই বলবো আমি। কারণ পৃথিবীর বহু দেশেই সামরিক হস্তক্ষেপ হয়েছে। সেসব দেশের সাথে বাংলাদেশে পার্থক্য কী? পার্থক্য হলো বাংলাদেশের জনগণের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসকরা পরাজিতও হয়েছে, পদানতও হয়েছে এবং অধিনস্তও হয়েছে। সাংবিধানিক শাসনটাকে আমরা পুনরুদ্ধার করতে পরেছি, সচল করতে পেরেছি এবং সংবিধানকে সমুন্ন রাখতে পেরেছি। এটাও কিন্তু একটা বিরাট অর্জন।
 
সংবাদ সারাবেলা: সামরিক শাসনের বিষয়টা নিয়ে যদি আরেকটু আলোকপাত করতেন?
হাসানুল হক ইনু: ৫০ বছরে সামরিক শাসনের আবর্ত থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনতে জনগণ সক্ষম হয়েছে। আমি মনে করি, দেশে গণতান্ত্রিক কর্মধারা অব্যাহত রাখার জন্য এই অর্জ বিশাল প্রাপ্তি। সাংবিধানিক শাসনতন্ত্র কায়েম অব্যাহত রাখতে পেরেছে বাংলাদেশ। সংবিধানকে সমুন্ন রাখতে সক্ষম হচ্ছে বাংলাদেশ। আপনি খেয়াল করবেন, বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের উপর যতই বিপদ-আপদ আসুক না কেন বাংলাদেশের সংবিধান কিš‘ কখনই বাতিল হয় নি। এর উপর কাঁটাছেঁড়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সংবিধানটা টিকে গেছে। আর এই সংবিধানটাই একটা বাতিঘরের মতো দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছে, যাচ্ছে। এটা কম্পাসের মতো কাজ করছে। যে কারণে আমরা বিগত ৫০ বছরে অনেক রাজনৈতিক ঝড়ঝাপ্টা অতিক্রম করেও আবার দেশটাকে সাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থায় রাখতে সক্ষম হয়েছি। এর বাইরে  যে প্রাপ্তি হলো সংবিধানের যে মূল  চার নীতি (ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদ) প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছি। ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় কিন্তু আমেরিকা আমাদের বিরুদ্ধে ছিলো, মধ্যপ্রাচ্য আমাদের বিরুদ্ধে ছিলো, সৌদি আরব আমাদের বিরুদ্ধে ছিলো। মহান এই যুদ্ধে কিন্তু ইতিহাসের বর্বরতম নির্যাতন হয়েছে, গণহত্যা হয়েছিলো, যুদ্ধাপরাধ হয়েছিলো। কেউ বিশ্বাস করতে পারে নাই যে, যেহেতু আমেরিকা, সৌদি আরব বিরোধিতা করেছে সেই দেশ ৫০ বছর টিকে থাকবে। অথচ বাস্তবতা হলো ৫০ বছর এই বাংলাদেশের সাথেই বন্ধুত্ব কায়েম করতে আগ্রহ প্রকাশ করছে আমেরিকা, সৌদি আরব। আমাদের লক্ষ লক্ষ লোক সৌদি আরবে কাজ করে। সৌদি কিংবা আমেরিকার মতো দেশগুলো মনে করেছিলো বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই ৫০ বছরে বিশ্বেকে আমরা দেখিয়ে দিলাম, বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে পারি আমরা। যুদ্ধাপরাধের বিচারটা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ দমন করার জন্য  একটি যুগান্তকারী মাইলফলক। একই সঙ্গে বহু দেশে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে, অনেক নেতা-নেত্রী মারা গিয়েছে- তাদের বিচার-আচার হয় না কিন্তু। অথচ বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, জেল হত্যাকাণ্ড, যুদ্ধাপরাধের মতো পরিকল্পিত হত্যাকা-গুলোর বিচার করে বিশ্বে সাড়া জাগিয়েছে। এটা একটা বড় প্রাপ্তি আমাদের।

এসবের বাইরেও যদি বলি আমাদের ভৌগলিক অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায়। আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারত বৃহৎ রাষ্ট্র। ভারতের সাথে আমাদের অনেক দ্বি-পাক্ষিক সমস্যা আছে, সেই সমস্যাগুলোর সমাধান হচ্ছে। এতদস্বত্বেও আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো, আমরা সীমানা চিহ্নিত করেছি, সেই সীমানা আবার সংহত করতে সক্ষম হয়েছি।  এই যে সীমানা সংহত হওয়াটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। অনেক দেশেই সীমানা চিহ্নিত হয় ঠিকই, কিন্তু‘ সীমানা সংহত হয় না। সুতরাং এখানে আমাদের বিরাট অর্জন সাধিত হয়েছে। ঠিক এই মুহুর্তে বাংলাদেশের এক ইঞ্চি জমিও কারো দখলে নাই, কিংবা বাংলাদেশও কারো ভূমি দখল করেনি। সুতরাং বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে সীমানা চিহ্নিতকরণ, সীমানা সংহতকরণ, সমুদ্রের জলের সীমানা চিহ্নিতকরণ, সীমানা সংহতকরণ করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী বেশ প্রশংসনীয় অবস্থানে আছে। বাংলাদেশ হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম স্বশস্ত্রবাহিনী যারা শান্তি রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত আছে। এটাও  বাংলাদেশের জন্য একটা বিশাল অর্জন এবং প্রাপ্তিও।

এরপরও আমরা একটা ছোট দেশ, উন্নয়নশীল দেশ। আমাদের চেয়েও বৃহৎ অর্থনীতির দেশ পৃথিবীতে আছে। ভূ-রাজনীতি আছে, সামরিক মেরুকরণ আছে- এসবের পরেও আন্তর্জাতিক পরিসরের সব প্রভাব কাটিয়ে উঠে বাংলাদেশ সরকার, স্বাধীনভাবে কূটনীতির চর্চা করতে পারছে- এটাও কিন্তু একটা বড় সাফল বলে আমি মনে করি।
 
আরেকটা প্রাপ্তি আছে, বাংলাদেশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ। যেসব জায়গায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে, তারা কিন্তু জঙ্গিবাদের অত্যাচারে জর্জরিত, ক্ষত-বিক্ষত। আমরা এখানে ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি অনুসরণ করতে পারছি, অপরদিকে জঙ্গি-সন্ত্রাসকে দমন করতে পারছি। তাদের কোনঠাসা করে দিতে পেরেছি, কাবু করে দিয়েছি। এখানে জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা, সাম্প্রদায়িকতাকে কেন্দ্র করে মাঝে মাঝে বিব্রত করছে, মাঝে মাঝে আঁচড় কাঁটছে কিন্তু আমাদেরকে ক্ষত-বিক্ষত করতে পারছে না। সুতরাং জঙ্গিবাদ দমনেও বাংলাদেশ বেশ সফল বলে আমি মনে করি।

সংবাদ সারাবেলা: আপনি তো ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জনের কথা বললেন, অপ্রাপ্তি কি কিছুই নেই?
হাসানুল হক ইনু: অবশ্যই আছে। প্রথম কথা হচ্ছে, আমাদের একটা সংবিধান থাকলেও এবং সংবিধানে চমৎকার গণতন্ত্রের রীতি-নীতি পালনের নির্দেশনা থাকলেও বিগত ৫০ বছরে আমরা গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সম্পূর্ণ সফল হতে পারি নি। এই জায়গাটায় একটা ঘাটতি আছে আমাদের।

দ্বিতীয় ঘাটতি হচ্ছে আমাাদের সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা বিকেন্দ্রীভূত/বিকেন্দ্রীকরণ শাসন প্রক্রিয়াটা চালু করতে পারিনি। অর্থাৎ স্তরে স্তরে নির্বাচিতদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। এখন পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের উপরে অনির্বাচিত, সরকারি আমলাদের প্রভাব রয়েই গেছে। প্রভাব আছে কেন্দ্রিয় সরকারেরও। রাজনীতিকদেরও প্রভাব রয়েছে। সুতরাং তৃণমূল পর্যায়ের নির্বাচিতরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। সুতরাং বিকেন্দ্রীকরণের প্রক্রিয়াতে একটা ঘাটতি বেশ লক্ষণীয়।

আরেকটা ঘাটতি হলো যে, আমরা গণতন্ত্রের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি ঠিকই তারপরও একটা ভালো নির্বাচনী সংস্কৃতি আমরা দাঁড় করাতে পারিনি। এটা একটা সমস্যা কিš‘। সুতরাং একটা বিতর্কমুক্ত নির্বাচনী সংস্কৃতি আমাদের এখানে দাঁড় করানো উচিত বলে আমি মনে করি। কারণ এখনও নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক হয়, দ্বন্দ্ব-সংঘাত-ফ্যাসাদ হয়।
আরও একটা বিষয় হচ্ছে যেটা ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে আমরা কিছু বিষয় নিষ্পত্তি করেছিলাম, কিন্তু বিগত ৫০ বছরে আমরা খেয়াল করলাম, সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে মীমাংসিত বিষয়গুলি অমীমাংসিত করার একটা রাজনৈতিক পাঁয়তারা ধারাবাহিকভাবে চলেছে। ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করার একটা পায়তারা চলেছে এবং ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করার একটা অপচেষ্টা চলছে। এই তিনটা বিষয় আমরা এখনও নিশ্চিত করতে পারিনি। অর্থাৎ মীমাংসিত বিষয় আর অমীমাংসিত হবে না, ধর্মকে আর রাজনীতিতে ব্যবহার করা যাবে না,  ঐতিহাসিক সত্য অস্বীকার করা হবে না- এ ব্যাপারে একটা জাতীয় ঐক্যমত্য এখনও প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। যার জন্য রাজনৈতিক শান্তি  কিছুটা বিগ্নিত হচ্ছে, স্থিতিশীলতা কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে, মৌসুমে মৌসুমে সাম্প্রদায়িক চক্র চোরাগোপ্তা হামলার মধ্য দিয়ে অশান্তি তৈরি করছে এবং রাষ্ট্রের ভিত্তিকে নাড়া দেয়ার একটা অপচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে আমি মনে করি যে, এই জাতিসত্ত্বার উপর হামলা এখনও অব্যাহত আছে। কারণ ধরেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একটি ঐতিহাসিক সত্য, এখনও অনেকে আছেন, যারা এই সত্যকে মেনে নিতে চান না, আবার স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ শে মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ ঘোষণা দিয়েছেন কিন্তু এখনও এই ঘোষণার ঘোষক নিয়ে আমরা কুতর্ক করেই যাচ্ছি। আবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এটা মিমাংসীত বিষয়, এখনও বহুত জন আছেন যারা বঙ্গবন্ধুর নামই উ”চারণ করতে চান না।
 
আমরা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার কবর দিয়েছি। সুতরাং ধর্মের ব্যবহার করবো না, কিন্তু এখনও ধর্মের ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা জানি মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ লক্ষ শহীদ হয়েছেন, এই ৩০ লক্ষ শহীদকেও অস্বীকার করার একটা প্রবণতা আছে। মুক্তিযুদ্ধে নারীদের সম্ভ্রমহানির বিষয় নিয়েও অস্বীকার করার একটা প্রবণতা আছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সংবিধানের চার নীতি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, অথচ এই চার নীতিকে অস্বীকার করারও প্রবণতা আছে। অনেকেই চার নীতি না মেনেই রাজনীতি করতে চাচ্ছেন। মিমাংসিত বিষয় অমীমাংসিত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানপন্থার, পাকিস্তানের মতো একটা সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানানোর একটা চেষ্টা অব্যাহত আছে। আমরা মনে করি যারা এই মীমাংসিত বিষয়কে অমিমাংসিত করার রাজনীতি করে তাদের একটা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক আছে। কিছু রাজনৈতিক দল  বাংলাদেশে সরাসরি এই সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, রাজাকারদের পৃষ্ঠপোষকতা করে এবং সকল রাজাকারদের, সকল জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের একটা নিরাপদ ঠিকানা হলো রাজনৈতিক দল। আমি মনে করি এইসব রাজনিতক দলগুলো যারা সাম্প্রদায়িকতার চর্চা করছে, সাম্প্রদায়িকতাকে তোষণ বা লালন করছে অথবা রাজনৈতিক পার্টনারশিপ করছে তারাই জঙ্গিাবাদ ও সন্ত্রাসবাদ উৎপাদন পুনরউৎপাদন করে। এটা আমাদের এই ৫০ বছরের অর্জনকে কিছুটা হলেও ম্লান করে দেয়। একটা সিন্ডিকেটেড দুর্নীতিবাজদের একটা উত্থান ঘটেছে। দূর্নীতির দাপটটা বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি আমরা দলবাজি, গুণ্ডাতন্ত্রের একটা দাপট লক্ষ্য করছি। যা এই দুর্নীতি এবং গুণ্ডাতন্ত্রের ফলে সুশাসনের ঘাটতি হচ্ছে। ৫০ বছরে এসে আমি বলবো বাংলাদেশে সুশাসনের ঘাটতি আছে। দুর্নীতির দাপটে এবং গুণ্ডাতন্ত্রের কারণে বাংলাদেশে আইনের শাসন মার খাচ্ছে। হ্যাঁ, দারিদ্র কমেছে ঠিকই, কিন্তু বৈষম্য বেড়েছে। সুতরাং বৈষম্য তো আমার সংবিধানের নির্দেশিত পথ না। সবমিলিয়ে এগুলোকেই আমার অপ্রাপ্তি মনে হয়। আমি যদি জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদকে বিপদ বলি, তাহলে দুর্নীতি, গুণ্ডাবাজি এবং বৈষম্যকে আপদ বলবো। সুতরাং এই বিপদ-আপদের বাইরে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে হবে।

সংবাদ সারাবেলা: সিন্ডিকেটের বিষয়টার যদি আরেকটু ব্যাখ্যা দিতেন।
হাসানুল হক ইনু: বাংলাদেশে একটা দুর্নীতির সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। প্রশাসনের ভেতরে অসৎ কর্মচারীরা, রাজনৈতিক অঙ্গণে অসৎ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা এবং ব্যবসায়িদের ভেতরে অসৎ ব্যবসায়িরা মিলে একটা সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। এই সিন্ডিকেটটাই আমাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। এদেরকে আমি ঘরকাঁটা ইঁদুর বলি। উন্নয়নের সুফলটা এরা খেয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। এই দুর্নীতির সিন্ডিকেটটা রাজনৈতিক ছাতার তলে বসবাস করছে। দুর্নীতির এই সিন্ডিকেটটা কাজ করতে পারছে আইনের শাসনের ঘাটতির জন্য। সুতরাং দুর্নীতির এই সিন্ডিকেটটাকে ধ্বংস করতে হয় তাহলে আমি দল দেখে, মুখ দেখে বা কে কোন জার্সি পরলো তা না দেখে আইন অনুযায়ী যদি ব্যবস্থা গ্রহণ করি, তাহলে দুর্নীতির এই সিন্ডিকেটটা ভেঙ্গে যাবে। একই সাথে আামাদের উন্নয়নের ধারাটা রক্ষা পাবে।

আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গণে একটা দলবাজির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ দলবাজিটা শুধু এক দলে না, সবক্ষেত্রেই, সবদলেই এই দলবাজিটা দেখা গেছে। কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে  গণতন্ত্রের চর্চার ঘাটতি আছে। এই ঘাটতির ফলে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বড় রাজনৈতিক দলগুলো যারা ক্ষমতা দখল করেছে, বা ক্ষমতায় ছিলো বা ক্ষমতায় আছে তারা যেহেতু নিজের দলের ভেতর গণতন্ত্রে চর্চা করছে না, উল্টা সেখানে আমি একজন রাজনৈতিক কর্মীর বদলে লাঠিয়াল বাহিনী তৈরি করছি, তৈরি করছি তল্পিবাহক, তোষামোদকারী। এগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা, সমর্থন এবং লালনই কিন্তু দলগুলোকে দলবাজ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। তাই ঘটেছে কিন্তু। আমরা দেখছি যে, বাংলাদেশে উপর্যপুরি সামরিক হস্তক্ষেপ, সরকার উৎখাতের যে চক্রান্তের রাজনীতি- সবকিছু মিলিয়ে কিন্তু একটা ভালো গণতন্ত্র চর্চার একটা ঘাটতি আছে। সেই ঘাটতিটা যতক্ষণ আমি দূর না করতে পারছি, এই গুণ্ডাবাজি, দলবাজি যদি না ছাড়তে পারি তাহলে আর কখনই এসব থেকে বের হতে পারবো না। তবে আমি মনে করি যে, আমরা যেহেতু নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারছি, জঙ্গিবাদ দমন করতে পারছি , সেহেতু ৫০ বছরের মাথায় আমরা চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করতে পারি। সুতরাং দুর্নীতিবাজ, গুণ্ডাতন্ত্রকে ধ্বংস করতে হবে, দমনও করতে হবে। যদি বাংলাদেশের আরেক ধাপ উন্নয়ন করতে হয়, বাংলাদেশকে আরও সমৃদ্ধ হতে হয় তাহলে সেখানে ১ নম্বর পূর্ব শর্ত হচ্ছে সুশাসন। সুশাসনের শক্ত পাটাতন ছাড়া সমৃদ্ধ অর্থনীতি দাঁড়াবেনা কিন্তু। সুতরাং অর্থনীতি এখন যে পর্যায়ে আছে এই জায়গাটায় যদি দূর্নীতির সিন্ডিকেট এবং দলবাজির ছোবল থাকে তাহলে কিন্তু অর্থনীতির গতিটা হোঁচট খাবে।
সংবাদ সারাবেলা: তাহলে কি সরকারের ধারাবাহিকতাকে দুষছেন আপনি?

হাসানুল হক ইনু: না, সরকারের ধারাবাহিকতার সাথে এর কোন সম্পর্ক নাই। বহু দেশে সরকারের ধারাবাহিকতা আছে কিন্তু গুণ্ডাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণে আছে এবং সরকার টিকে থাকে আইনের শাসনের উপর ভিত্তি করে। আসলে আইনের উর্ধে কেউ না-এটা প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই কিন্তু যে কোন সরকার টিকে থাকে। সরকারে ধারাবাহিকতাকে দোষ দিয়ে বা দোষারূপ করে আমাদের দুর্নীতি এবং গুণ্ডাবাজির যে আপদ তা থেকে আমরা বাঁচবো না কিন্তু। এটা একটা উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা হয় নি, উপর্যপুরি সামরিক হস্তক্ষেপ হয়েছে সেজন্য এই আপদটা বুদবুদের মতো দেখা দিয়েছে। আমি মনে করি যে জঙ্গীবাদকে যখন আমরা দমন করতে পেরেছি সুতরাং দুর্নীতি এবং গুণ্ডাবাজিকেও আমরা দমন করতে পারবো। বাকি যেটা আছে যে সকল রাজনৈতিক অঙ্গণ থেকে আওয়াজ তুলতে হবে যে সুশাসন চাই। এটাই।  আমি মনে করি যে, ধীরে ধীরে যদি সুশাসনের শক্ত পাটাতন তৈরি করি তাহলে একদিকে বৈষম্য কমবে কারণ অর্থনীতিতে সুশাসন আসবে, দলবাজিটা কমে যাবে, গুণ্ডাবাজিটা কমে যাবে এবং রাজনীতির অঙ্গণে নির্বাচনী সংস্কৃতিটা নিশ্চিত হবে এবং একটা ভালো নির্বাচন হবে। এই মুহুর্তে আমি সুশাসন নিশ্চিতের সংগ্রামকে গুরুত্বপূর্ণ হবে। সমান্তরালভাবে জঙ্গীবাদীদের দমনের ব্যাপারে সতর্ক থাকবো।
 
সংবাদ সারাবেলা: সেক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?
হাসানুল হক ইনু: যেখানেই গুণ্ডাবাজি, যেখানেই দুর্নীতি সেখানেই আমরা প্রতিরোধ করি, প্রতিবাদমূখর হই। আগে আমাকে মানতে হবে যে, দুর্নীতি আছে। আগে তো মানতে হবে যে গুণ্ডাবাজি হচ্ছে। যদি নাই মানি তাহলে তো আর প্রতিবাদ করবো না। সুতরাং আমি দেশবাসীকে বলবো, রাজনৈতিক কর্মীকে বলবো যে মতেরই হোননা কেন বাংলাদেশের জন্য সুশাসন দরকার এবং সুশাসনের জন্য আসুন আমরা দুর্নীতি, দলবাজী, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই। এই মুহূর্তে আমি চার মাত্রার সংগ্রাম দেখছি। অর্থাৎ জঙ্গীদমন করা, জঙ্গিকে একদম ধ্বংস করে ফেলতে হবে যাতে রাজনৈতিক বিশৃংখলা যাতে না আসে, যাতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকে, দুর্নীতি-দলবাজির সংগ্রাম কঠোরভাবে দমন করতে হবে, বৈষম্য কমানোর সংগ্রামটাও অব্যাহত রাখতে হবে। এই চার মাত্রার সংগ্রামটা আমার সমান্তরালভাবে চালাতে হবে।
 
সংবাদ সারাবেলা: দুর্নীতি, বৈষম্যহীনতা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম তো দীর্ঘদিনের জঞ্জাল, অল্প সময়ে কি এসব দূর করা সম্ভব?
হাসানুল হক ইনু: মনে করেন যে, সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগটা যদি শক্তিশালী হয়ে যায় অথবা আরেকটু তৎপর হয় এবং বিচার যদি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পারি তাহলে সুশাসনের জন্য বিচার বিভাগের দক্ষতা বৃদ্ধি, বিচার কাজ দ্রুত নিষ্পত্তি করাও কিš‘ বিরাট ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি যতরকম জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান আছে তার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। আমি গণমাধ্যমের ভূমিকার কথা বলবো। কারণ গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। গণমাধ্যমও যদি সুশাসনের জন্য সো”চার থাকে, গণমাধ্যম যদি ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রশাসনের অন্দর মহলে আলো ফেলতে পারে, তাহলে সুশাসনের আন্দোলনটা অনেক বেগবান হবে। আমি মনে করি বিচার বিভাগ আর গণমাধ্যম যদি আরও তৎপর হয়, তাহলে সুশাসনের জন্য সহায়ক হবে।

সংবাদ সারাবেলা: আগামী ৫০ বছরের জন্য আপনার প্রত্যাশাটা কি?
হাসানুল হক ইনু: বাংলাদেশ একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হোক আগামী ৫০ বছরে এটা প্রত্যাশা করি আমি। বাংলাদেশ হয়ে উঠুক সম্পূর্ণ বৈষম্যমুক্ত, সুষম সমন্বিত (ইংরেজিতে হারমোনিয়াস সোসাইটি) সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা। একটা শান্তিময় সহাবস্থানের সমাজ তৈরি করার প্রত্যাশা এবং অবশ্যই সব ব্যবস্থায় ডিজিটাল প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ থাকবে এটা প্রত্যাশা করি। এজন্য আমার কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে।

প্রথম কথা হচ্ছে আমার যে সংবিধান তার বয়স কিন্তু ৫০ বছর হয়ে গেলো, সংবিধান নিয়ে ২০১১ সালে শেষ পর্যালোচনা করেছি। এরপর আর পর্যালোচনায় বসা হয়নি। কাজেই সংবিধানকে একটু হাল নাগাদ করতে হবে। সুতরাং সংবিধান পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি বানানো দরকার। সংবিধানকে আরও অংশগ্রহণমূলকআরও গণতান্ত্রিক, আরও জবাবদিহিমূলক এবংআধুনিক সমাজ ধারণ করার রূপরেখা দিতে হবে।

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আমার যে অর্থনীতি, সে অর্থনীতির দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। আমাদের সমৃদ্ধি কিন্তু‘ হচ্ছে, সেই সাথে বেড়েছে বৈষম্য। এই বৈষম্য কমিয়ে সমৃদ্ধি বাড়াতে হবে। আর এটা করতে গেলেই সমাজতন্ত্রের চশমা দিয়েই আমাদেরকে অর্থনীতিটা দেখতে হবে। সংবিধানের মূল চার নীতিতে কিন্তু সমাজতন্ত্র আছে। সুতরাং এখানে লাজ লজ্জার কিছু নাই। আর সমাজতন্ত্রের চশমা দিয়ে যদি আমরা অর্থনীতিকে দেখি তাহলে দেখবো যে, চার মাত্রার সমন্বিত অর্থনীতি তৈরি করতে হবে আমাকে। এক. রাষ্ট্রের ভূমিকা, দুই. সামাজিক চাহিদা, ৩. বাজার শক্তি এবং উদ্যোক্তা শ্রেনী। এই চারের সমন্বিত একটা অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করতে হবে। রাষ্ট্রের ভূমিকা খাটো না করে বিগত ১৩ বছরে শেখ হাসিনার শাসনামলেই কিš‘ চমৎকার উন্নয়ন আমি দেখেছি। গ্রামীণ অর্থনীতির পরিবর্তন আমি দেখেছি। সুতরাং রাষ্ট্রই এখানে মূল ভূমিকায়। বাজেটটা সেইভাবে করতে হবে। তাতে আমরা সমৃদ্ধিও পাবো, বৈষম্যও কমে আসবে। নারীর ক্ষমতায়নও পাবো, শিশুর নিরাপত্তাও পাবো।
তৃতীয়ত আমি সুশাসনের কথা আগেও বলেছি, এখনও তাই বলবো। কারণ আগামীর বাংলাদেশটারই চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সুশাসনের বাংলাদেশ কায়েম করা। সুশাসনের শক্ত পাটাতন তৈরি করবো। যে পাটাতনের উপর দাঁড়িয়ে বাঙ্গালি জাতি আরেকধাপ উপরে উঠে যাবে। যার মধ্য দিয়ে অর্থনীতিতে সুশাসন, নির্বাচনে সুশাসন, রাজনীতিতে সুশাসনসহ সর্বক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করাই হবে আগামীর চ্যালেঞ্জ।

চতুর্থত, আমি আগেও বলেছি যে জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ অনেকটাই সফল হয়েছে। এখনও যে ছিঁটেফোঁটা জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ চলে, মৌসুমে মৌসুমে যে হামলা হয়, এটা থেকে আমাদের একেবারে বেড়িয়ে আসতে হবে। শূন্যসহিষ্ণু নীতি অনুসরণ করে এই জঙ্গী-সন্ত্রাসী-সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানকে নিষিদ্ধ করতে হবে, দমন করতে হবে এবং অবশ্যই ধ্বংস করতে হবে। একই সাথে যারা এই জঙ্গী-সন্ত্রাসী-সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং পাকিস্তান পন্থার পৃষ্ঠপোষকতা করে সেই রাজনৈতিক দলকেও রাজনীতি থেকে বিদায় জানাতে হবে। এটা হয়তো অনেকের শুনতে খারাপ লাগছে, কিন্তু পাকিস্তানপন্থা এবং বাংলাদেশপন্থার ভেতরে ঘুরপাক খেতে থাকলে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগোতে পারবে না। সেই জন্য এই আবর্জনাগুলোকে উপড়ে ফেলতে হবে। মীমাংসিত বিষয়গুলোর উপর দাড়াতে হবে, ঐতিহাসিক সত্যগুলো যেমন, জাতির পিতাকে না মানা, চার নীতিকে না মানা, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে না মানা, স্বাধীনতার ঘোষণাকে যারা মানবে না-এমন বিষয়কে অমীমাংসিত ইস্যু হিসেবে  উপস্থাপন করবে তাদের আসলেই বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বিদায়ই জানাতে হবে। এর বিকল্প আমি কিছু দেখছি না।
 
আপনি দেখবেন যে, সংবিধানের মূল ভিত্তিই হচ্ছে বাক-স্বাধীনতা। বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ যদি করতে হয়,  তাহলে কিছু পরিবর্তন এই সংবিধানে আনতে হবে।  করোনাকাল কিন্তু আমাদের দেখিয়ে দিলো রাষ্ট্রের এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার দুর্বলতাগুলো। সেখানে আমি দেখছি, শিক্ষা ব্যবস্থায় দুর্বলতা, খাদ্য ব্যবস্থায় দুর্বলতা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা।আমি মাত্র পাঁচটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করলাম। এই পাঁচটি ক্ষেত্রকে আমি মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভূক্ত করতে চাচ্ছি। যা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। অর্থাৎ স্বাস্থ্য অধিকার, খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, ইন্টারনেটের সার্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং সামাজিক সুরক্ষাকে সংবিধানে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে যুক্ত করতে হবে। তাহলে দেখবেন যে বৈষম্য অনেক কমে এসেছে। এই পাঁচটি অধিকার বাস্তবায়নে রাষ্ট্র বাধ্য থাকবে।
 
সবশেষে আমি বলবো, যে জাতীয়তাবাদের উপর বাঙ্গালী জাতি দাঁড়িয়েছে, যে অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করেছি আমরা সেই বাঙ্গালিয়ানার উপরে এখন একটা সাম্প্রদায়িক ঝাপটা চলছে-এটা মূলত ৭৫ পরবর্তী সময়ে শুরু হয়েছে, সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির এই ঝাপটা থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করে বাঙালিয়ানাকে চর্চায় আনতে হবে। এই চর্চার মধ্য দিয়ে বাঙালিয়ানার পূনর্জাগরণ করাটা বাঞ্ছনীয়। আপনি যদি গর্বিত জাতি না হন, আপনি যদি পরিচয় সংকটে ভোগেন তাহলে কিন্তু আপনি একটা সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। সেজন্য সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির ঝাপটা থেকে বের করে এনে বাঙালিয়ানার চর্চার একটা উদ্যোগ  আমাদের চালাতে হবে। আর কাজগুলোর মধ্য দিয়ে আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশ আরো উন্নত হবে, আরও সংস্কৃতিবান হবে, আরও গণতান্ত্রিক হবে এবং আরও সমৃদ্ধ হবে।
 
সংবাদ সারাবেলা: এই সোনার বাংলায় কি তাহলে সোনার মানুষ নাই?
হাসানুল হক ইনু: সোনার বাংলায় সোনার মানুষ অবশ্যই আছে। কিন্তু বিভিন্ন পর্যায়ে পর্যায়ে শাসক শ্রেনীর ব্যর্থতার কারণে সোনার মানুষদের যথাযথ ভূমিকা রাখার জায়গাটা তৈরি হয়নি। সুতরাং মানুষ সোনার মানুষই আছে। আর সোনার মানুষ না হলে খাদ্য উৎপাদন তো দ্বিগুণ হতো না, নারীর ক্ষমতায়ন হয় না। দেশের এতো এতো উন্নয়ন হয় না।
 

Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.