আমাদের সাহিত্য ১৯৪৭ পরবর্তী সময় থেকে ১৯৭১ এ যেভাবে রূপান্তরিত হয়েছে, তার প্রতিফলন বলতে গেলে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস হয়ে এসেছে। ধর্মকে সেখানে কোন বাড়াবাড়ি করা হয়নি। বিশেষ করে কোন সাহিত্যে বা গল্পে দেখানো হয়নি যে পুজামণ্ডপে আগুন লাগানো হয়েছে বা ঘরবাড়ি নষ্ট করা হয়েছে।
আমাদের সাহিত্যের বেশিরভাগ লেখক যারা সচেতনভাবে নিজের সাহিত্য চেতনাকে জাগ্রত করেছেন এবং লিখেছেন তারা ধর্মকে ধর্মের ঊর্ধ্ব মানবিক চেতনাবোধে রেখেছেন। কারণ ধর্ম প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত পবিত্র বিশ্বাস। সেই ধর্ম নিয়ে কাউকে আক্রান্ত করার কোন যুক্তি নেই। তারপরও যখন জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে, যখন মানুষ অন্যায় যেকোন কিছুকে নিজের চেতনাবোধে স্থান দেয়, যখন মানুষ নিজের অন্যায় আচরণকে সঠিক আচরণ মনে করে তখনই তার চেতনায়, তার লেখায়, তার সবকিছুর মধ্যে সেই বিষয়টি চলে আসে। যেখানে মানবিক চেতনাবোধের বাইরে মানুষ ধর্মকে নৃশংসভাবে নষ্ট করা হয়, নৃশংসভাবে চিন্তা করা হয় এবং এই সবকিছুর ভেতর দিয়ে সাহিত্যের একটি জায়গা তৈরি হয়, যে জায়গাটা কোনক্রমেই কাম্য নয়।
বাংলা সাহিত্যে এক সময়ে নানাভাবে নারীকে পিছুটান হিসেবে দেখানো হয়েছে, নারীকে মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। কিš‘ আমরা যখন বেগম রোকেয়ার রচনা পাঠ করি, সেই ১০০ বছরেরও বেশি সময় আগে তখন আমরা দেখতে পাই, নারীদের নিয়ে নারী চেতনার কথা তিনি কিভাবে বর্ণনা করেছেন। বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্ন বইটি যদি আমরা পড়ি, সেখানে তিনি দেখিয়েছেন নারীরা একটি রাজ্য প্রতিপালকের দায়িত্ব পালন করছে এবং সর্বত্রই নারীরা দায়িত্বশীল পদে কাজ করছে। এগুলো হলো একটি প্রতিবাদী চিন্তা। এই প্রতিবাদী চিন্তাকেও নানাভাবে তিনি চিত্রিত করেছেন।
যখন আমরা জেন্ডার সমসতার কথা জানতাম না, তখন, সেই এখন থেকে ৩০ দশক আগে তখন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম উ”চারণ করেছিলেন একটি অসাধারণ কবিতার লাইন,“এই বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তাঁর করিয়াছে নারী, অর্ধেক তাঁর নর”। কারণ নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া সামাজিক মূল্যবোধের জায়গা, জীবন সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জায়গা তৈরি হয় না। সেজন্য এই জায়গাগুলোকে ধারণ করে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই অসাধারণ লাইন দুটি কবিতায় লিখেছেন। পরবর্তী সময়ে আমাদের সাহিত্যে জেন্ডার সমতার কথা নানাভাবে উঠে এসেছে।
৪৭ পরবর্তী সময় থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য যুগ শুরু হয়, তখনি কিš‘ আমরা দেখেছি আমাদের সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন, রিজিয়া রহমান, রাজিয়া খানের মতো কথা সাহিত্যিককে। তারা কিš‘ তাদের গল্প, কবিতা, উপন্যাস এবং সাহিত্যে চমৎকারভাবে উপ¯’াপন করতে পেরেছেন। এইভাবে নারীর সমতার জায়গা আমাদের নারী লেখকদের হাতে একটি ধারাবাহিকভাবে চলে এসেছে এবং এখন পর্যন্ত যারা নবীন লেখক তারাও সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই চলেছেন। তাদের সকলের সাহিত্যে নারী-পুরুষের সমতা দিয়ে সামাজিক মূল্যবোধের জায়গাটাকে প্রতিষ্ঠিত করছেন।
বাংলা একাডেমি শুধু নারী সাহিত্যিকদের তুলে আনার ব্যাপারে আলাদাভাবে কোন কিছু চিন্তা করছে না। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য করছেন। যিনি ভালো লিখতে পারছেন, যার ভালো রচনা আছে, সেটা গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ কিংবা নিবন্ধই হোক না কেন সবকিছু মিলিয়েই কাজ করছে। আসলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি প্রশিক্ষণ নিয়ে সাহিত্যিক হওয়া যায় না।
বাংলা একাডেমিতে একবার তরুণ লেখকদের নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিলো। আমিও সেখানে থাকতাম, ওরা যারা এ কর্মশালায় ছিলো, তারা সকলেই কিš‘ সাহিত্যিক হতে পারেনি। সাহিত্যিক হওয়াটা আপন সৃজনশীলতার বিষয়। ব্যক্তির মেধা আর মননের চর্চা থেকে নিজস্ব চিন্তার জগৎ তৈরি হয়, সেখান থেকেই তৈরি হয় সাহিত্য এবং সাহিত্যিক। কোন প্রশিক্ষণ দিয়ে কাউকে সাহিত্যিক বানানো যাবে না। তবে হ্যাঁ, প্রশিক্ষণ দিয়ে কাউকে বিশ্বের সাহিত্যের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দেয়া যায়, তাকে আঙ্গিকগত দিকটা বোঝানো যেতে পারে কিš‘ সাহিত্যিক বানানো যাবে না। সাহিত্যটা একদম ব্যক্তির ব্যক্তিগত সৃজনশীল চিন্তা।
আমাদের সাহিত্যে অনেকেই নানাভাবে গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসংখ্য বই হয়েছে, সাহিত্য রচনা হয়েছে। আমার মনে হয়, একজন ব্যক্তিকে নিয়ে এতো বই, বিশ্বের আর কোথাও নেই, থাকলেও আমার জানা নেই। আমি নিজেও এ বছর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ১৬টি গল্প লিখেছি। বঙ্গবন্ধুর ছায়ায় এই গল্পগুলো প্রকাশিত হয়েছে। আমি ১৫ আগস্টের হত্যাকা-কে পটভূমি করে ‘আগস্টের এক রাত’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছি। আবার ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের সেই ভাষণকে পটভূমি করে আরো একটি উপন্যাস লিখেছি। আমি নিজে এসব করছি, অন্যরাও অনেক গল্প উপন্যাস লিখেছে।
১৯৭১ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরসারি দেখতে পাই। আমি ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমিতে যোগদান করি। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে আমন্ত্রণ দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন বাংলা একাডেমির বইমেলার উদ্বোধন করার জন্য এবং সেই সময়ে যারা বিদেশিরা ছিলো, তারা বাংলা একাডেমি থেকে বাংলা ভাষা শিখতো তাদের সার্টিফিকেট দেয়ার জন্য। সে সময় বাংলা একাডেমির পরিচালক ছিলেন, প্রফেসর কবীর চৌধুরী।
অনুষ্ঠানটি হচ্ছিলো বাংলা একাডেমির মাঠে যে বটমূল আছে সেখানে। মাঠে শত শত শ্রোতা আর মঞ্চে বসা বঙ্গবন্ধু। হঠাৎ একজন এসে বঙ্গবন্ধুর কানে কানে কিছু একটা কথা বলে গেলেন। আমরা দূর থেকে সে কথাটা কেউই শুনতে পাইনি। দেখলাম, তিনি একটু ক্ষুব্ধ হলেন, উত্তেজিত হলেন, মুখটা দেখে এমন মনে হচ্ছিলো। কিন্তু তিনি মুখে কিছু উ”চারণ করেননি, কোন কথা বলেননি।
মাঠের সামনের সারিতে বসে ছিলেন রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী হুসনা বানু খানম। বঙ্গবন্ধু সেই বিখ্যাত রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী হুসনা বানু খানমকে বললেন, আপনি মঞ্চে আসেন। হুসনা বানু মঞ্চে গেলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, একটা গান করেন। হুসনা বানু খানম আপা বললেন, কি গান করবো? বঙ্গবন্ধু বললেন, ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা। হুসনা আপা এ গানটি করলেন। মাঠের সবাই নিস্তব্ধ হয়ে শুনলাম। আমরা সেদিন আর কিছু জানতে পারলাম না যে, কে এসে বঙ্গবন্ধুকে কানে কানে কি বলে গেলেন। অনুষ্ঠান শেষ হলে বঙ্গবন্ধু চলে গেলেন।
অধ্যাপক কবীর চৌধুরী তখন পরিচালক ছিলেন, এখন সেই পদটা মহাপরিচালক। অনুষ্ঠানের ২/৩ তিন পর তিনি আমাদের ডাকলেন এবং সেইদিন যা ঘটেছিলো তা আমাদের বললেন। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৫টায় ভুট্টো, ইয়াহিয়া খান এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিলো, সেই বৈঠকে ভূট্টো আসবে না বলে বৈঠকটি ¯’গিত করা হয়েছে। সেই খবরটিই সেদিন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে এসে জানিয়েছিলেন।
আমার কাছে সেই ঘটনা এখনো স্মৃতি। কারণ সেই ঘটনায় আমার কাছে বঙ্গবন্ধুকে একজন শিক্ষকের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সেদিন তিনি একটি অনুষ্ঠানে এসেছেন, সেই অনুষ্ঠানটি করছেন । কিš‘ সেই সংবাদে তিনি উত্তেজিত হয়ে এমন কোন স্লোগান দিলেন না, ভাষণ দিলেন না-তাহলে কিš‘ সেই দিন বাংলা একাডেমি থেকে একটা মিছিল বেরিয়ে যেতে পারতো। মাঠে সেদিন ২ থেকে ৩ শত মতো লোক ছিলো, সবাইকে সেদিন কেবল গানের মাধ্যমে দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত করে গেলেন।
সেদিন আমার মনে হয়েছিলো একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি কিভাবে সংস্কৃতি চেতনায় সব মানুষের আবেগকে মথিত করলেন। গানের বাণী এবং সুরে দেশপ্রেমে অণুপ্রাণিত হলো মানুষ। একজন রাজনৈতিক নেতা হয়েও কিভাবে সংস্কৃতিক বলয়কে ধারণ করে বঙ্গবন্ধু মানুষকে শান্ত করে চলে গেলেন। এটিই আমার কাছে সেদিন একটি বড় শিক্ষণীয় ছিলো, এখনো আছে, আগামীতেও থাকবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh