× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

পঁচাত্তর থেকে ২০১০

বাংলাদেশ এগিয়েছে কোন শিক্ষানীতি ছাড়াই- আ আ ম স আরেফিন সিদ্দীক

সাজেদা হক

০১ জানুয়ারি ২০২২, ০৬:৪৭ এএম

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করলো বাংলাদেশ। সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই স্বপ্নের কতটুকু কাছাকাছি পৌঁছেছি আমরা- এ নিয়ে সংবাদ সারাবেলা কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সাথে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সংবাদ সারাবেলার অনলাইন ইনচার্জ সাজেদা হক।

করোনার সংক্রমণ সারা পৃথিবীকেই স্থবির করে ফেলেছে। বিশেষ করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার যে ক্ষতি করে গেলো এটি পুনরায় উদ্ধার করা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আমরা দেখেছি আমাদের দেশেই গত মার্চ ২০২০ থেকে একাধারে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রাথমিক পর্যন্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিলো। পরবর্তীতে অক্টোবরে এসে যখন খোলার প্রক্রিয়া শুরু হলো, তখন দেখা যাচ্ছে যে, বহু ছেলে-মেয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ঝড়ে পড়ছে। এটি আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে খুবই স্বাভাবিক। পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে বহু ছেলে-মেয়ের পক্ষে আর পড়াশুনা কন্টিনিউ করা সম্ভব হচ্ছে না।

করোনা সংকট শুধু শিক্ষা ব্যবস্থার উপরই যে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে তা তো নয়, আমাদের কর্মসংস্থান, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতির উপরেও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। নানা কারণে আমরা বুঝতে পারি প্রায় দুই বছরের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকা, আর্থিক অস্বচ্ছলতা শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই দুরাবস্থা কাটিয়ে উঠতে চাইলে, মুহূর্তেই তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়, এজন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। সুপরিকল্পিতভাবে যদি এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার পরিকল্পনা না নেওয়া হয়, তাহলে এটি আমাদের সামনের দিনগুলোতে নতুন প্রজন্মের মধ্যে একধরণের হতাশারও জন্ম দেবে। আর এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য বহুমাত্রিক পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। যেমন:
১. এই যে প্রায় দুই বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ছিলো, সেটার সমন্বয় করতে হবে। অর্থাৎ আগামী বছরগুলোতে যেসব ছুটি আছে, যেমন শরৎকালীন ছুটি, রমজানের ছুটি, গ্রীষ্মকালীন অবকাশ- এগুলোকে সংক্ষিপ্ত করে শ্রেণি কক্ষে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
২. যে সমস্ত ছেলে-মেয়ে আর্থিক কারণে ঝড়ে পড়েছে তাদেরকে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া। সহজ শর্তে আর্থিক ঋণ দেওয়া কিংবা অনুদান দিয়ে হলেও ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কক্ষে ফেরাতে হবে। এভাবে পরিবার ভিত্তিক আমাদের পরিকল্পনা করতে হবে।
৩. এগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে করা সম্ভব হবে না। জেলা এবং উপজেলায় আমাদের যে শিক্ষা কর্মকর্তা আছেন তাদেরকে এ দায়িত্ব দিতে হবে। সকলে যদি সততার সাথে সদি”ছা নিয়ে কাজগুলো করে তাহলে আমি বিশ্বাস করি একটা সময়ের পর এই সংকট আমরা কাটিয়ে উঠবো। হ্যাঁ এই সময় হয়তো ৬-৯ মাস, কিংবা তারও বেশি, অথবা তারও কম।
৪. এটাও মনে রাখতে হবে, সময় চলে গেলে তা আর ফিরিয়ে আনা যায় না। আজকের দিনটি যখন চলে যাবে, তখন তা সময়ের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে, এদিন আর কোনভাবেই ফিরিয়ে আনা যাবে না। অতএব প্রায় দুই বছরের শিক্ষা শূন্যতা আমরা কখনই ফিরিয়ে আনতে পারবো না এটা যেমন ঠিক, তেমনি আমরা অনেকটাই শিক্ষাক্রম পুনরুদ্ধার করতে পারবো। যদি আমাদের সেই সদি”ছা থাকে, সততা থাকে এবং একই সাথে আমাদের সেই সক্ষমতা থাকে।

করোনাকালীন ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থা একটি অত্যন্ত সময়োপযোগী প্রযুক্তি ছিলো। ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরের কথা প্রধানমন্ত্রী ২০০৮ সালের ১২ই ডিসেম্বর ঘোষণা করেছিলেন। ২০০৮ সালে ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে দলীয় নির্বাচনী মেনুফেষ্ট ঘোষণাকালে আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা এ ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, এবার যদি আমি নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারি তাহলে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হবে এই বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তর করা।
পরবর্তীতে আমরা দেখেছি ২০০৯ সালে তিনি যখন সরকার গঠন করলেন তখন থেকেই তিনি বাংলাদেশকে ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে উন্নতির দিকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। সেই সুবাদে আমি বলতে পারি, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০১০ সালেই আমাদের বিশাল ভর্তি কর্মযজ্ঞ সেটিকে ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় নিয়ে এসেছিলাম। এভাবেই আজকে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল প্রযুক্তির আওতাধীন আছে।

করোনার এই প্রাদুর্ভাবের সময় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে তাদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদান কার্যক্রম চালাতে পারে নি, সে সময় তারা ডিজিটাল বা অনলাইন ক্লাসভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু এখানে যে সমস্যাটা আমরা দেখেছি যে বহু ছেলে-মেয়ে তাদের তথ্য-প্রযুক্তির জ্ঞানের ঘাটতির কারণে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে যুক্ত হতে পারেননি। এটার কারণ তাদের পারিবারিক অস্বচ্ছলতা, স্মার্ট ডিভাইজগুলোর অভাব এবং ইন্টারনেট সাপোর্টেরও অভাব।

একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষার্থীর এ ধরণের অভাব আছে, ঘাটতি আছে এটা কারা ভালো জানেন? এটা জানে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, তিনি হতে পারেন প্রধান শিক্ষক, তিনি হতে পারেন অধ্যক্ষ, তিনি হতে পারেন উপাচার্য। আর জানবেন যেই শ্রেণির শিক্ষক জানবেন। তো তারা যদি এই তালিকাটা তৈরি করে, সেটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানদের কাছে জমা দেন , আমার ধারণা যে, তাহলে সরকারের পক্ষে থেকে কোন না কোনভাবে এই আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের সহায়তা দেওয়া সম্ভব হবে। আর একান্তই যদি সরকারের একার পক্ষে এইসব অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট এলাকার বহু বিত্ত্ববান মানুষ আছেন, যাদের কাছে আবেদন জানানো যেতে পারে। আমার বিশ্বাস তারাও হয়তো এ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবে।

এখানে আসলে দরকার একটি সমন্বিত কার্যক্রম। এই সমন্বিত কার্যক্রমের মাধ্যমে বিত্ত্ববান শ্রেণি, বিভিন্ন দাতা প্রতিষ্ঠান এবং সরকার এক সাথে কাজ করবে। এভাবে সমন্বয় করে কাজ করলে আমার বিশ্বাস আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া সকল শিক্ষার্থীকে শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। আমি মনে করি যে, আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া শিক্ষিার্থীদের যদি যথাযথভাবে আর্থিক সহায়তা দেওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে লেখাপড়ার দিক থেকে তারা অনেক এগিয়ে যাবে। কারণ তারা অনেকেই উচ্চ পর্যায়ের মেধার অধিকারী বলে আমি মনে করি। মনে করি কেবল সুযোগ এবং অর্থের অভাবে তারা লাইম লাইটে আসতে পারছে না।

বর্তমানে অটোপাস নিয়ে যে ট্রল হয়, তা করা ঠিক নয়। আমরা যদি অতীত দেখি বিশেষ করে ১৯৭১ সালের কথাই যদি বলি, তাহলে বলতে হয়, ১৯৭১ সালেও কিন্তু অটোপাস ছিলো না। ১৯৭১ সালেও সকলেই পরীক্ষা দিয়েই পাশ করেছে। কিন্তু কারিকুলামটা ছিলো সংক্ষিপ্ত। সংক্ষিপ্ত পাঠক্রম দিয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী অটোপাস চেয়ে উপাচার্যকে ঘেরাও করেছিলেন।  সেদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সেই সময়কার গণভবন থেকে নিজে হেঁটে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চলে এসেছিলেন এবং উপাচার্যকে ছাত্র-ছাত্রীদের ঘেরাও থেকে বের করেছিলেন  এবং বলেছিলেন, কোন অটোপাস হবে না।

কিন্তু করোনাকালীন দুই বছরে একবার এসএসসি ও এইচএসসি যে অটোপাস দেওয়া হয়েছিলো সেটাকে সরাসরি অটোপাস বলা যাবে না। কারণ এই ফলাফল ছিলো প্রত্যেকটা শিক্ষার্থীর জেএসসি, পিএসসি এবং বিগত দিনগুলোর ক্লাস টেস্টের মূল্যায়নের ভিত্তিতে। কিন্তু এই মহাসংকট কালে বিশ্বের বহু দেশ বহুভাবে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রাখার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছে। আমরাও করেছি। এখন এই সিদ্ধান্তগুলোর ব্যাপারে শতভাগ সঠিক হয়েছে তা বলা যাবে না। কিন্তু‘ সময়ের কারণে এই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার পেছনে কিছু যুক্তি আছে। এগুলো সব দিক থেকে একেবারেই যে পারফেক্ট বা নিখুঁত সিদ্ধান্ত সেটি আমরা বলতে পারবো না। সময়ের প্রয়োজনে এ সব সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হতে হয়েছে।

আপনারা দেখবেন কিশোরগ্যাংয়ের সংবাদ দেখবেন, এরা সমাজে একটি দুষ্টুচক্রের মতো আবির্ভূত হয়েছে। আমি মনে করি, একজন শিক্ষার্থীর সবচেয়ে বড় বিদ্যালয় হলো তার পরিবার। আমরা একবিংশ শতাব্দীর এই চরম ব্যবস্ততার সময় আমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে সময় দিচ্ছি না। অভিভাবক হিসেবে আমরা নিজেদের স্বার্থ নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। বহু শিক্ষার্থীকে স্কুলে বা কলেজে পাঠিয়েই অনেক অভিভাবক মনে করি, আমাদের দায়িত্ব শেষ। এই জায়গাটাতেই একটা বড় ধরণের ভুল করে যাচ্ছি আমরা।

এটা আমাদের মনে রাখতে হবে, পরিবার হচ্ছে একজন শিক্ষার্থীর প্রথম বিদ্যালয়, প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। অতএব এখানেই যে শিক্ষাটা সে পাবে এই শিক্ষাই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আমি দেখেছে অনেক বাবা-মা তারা হয়তো নিজেরাও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পাননি, তারা এমন সৎ জীবন যাপন করেন যে সেটি দেখেই তাদের ছেলে-মেয়েরা সততার শিক্ষা নেন। এই শিক্ষাটা যদি পরিবার থেকে না আসে এবং পরবর্তীতে যদি স্কুলেও আমরা এ শিক্ষাটা না দিতে পারি, তাহলে যা ঘটার সেটাই ঘটছে।

এই যে ছেলে-মেয়ে যে কিশোর গ্যাংয়ের নামে পরিচয় দিয়ে তারা সমাজে অনাচার সৃষ্টি করে, এরাতো কোন না কোন স্কুলের, কলেজের শিক্ষার্থী। তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে যে সেখানে তারা কি শিখছে? পরিবারই বা তাদের কি শিক্ষা দিচ্ছে। এই প্রশ্ন আমাদেরকেই আমাদের করতে হবে। অভিভাবক হিসেবে আমরা কি আমাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি? শিক্ষক হিসেবে কি আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করতে পারছি? সমাজের যারা নেতৃত্ব দেন তারা কি তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারছেন-এই প্রশ্নগুলো আমাদের করতে হবে। শুধু কিশোরদের উপর দোষ না চাপিয়ে এই প্রশ্নগুলো আমাদেরকেও করতে হবে। এর সমাধান কি হতে পারে তা খুঁজে বের করা দরকার। আর এভাবে ভাবলেই আমাদের ছেলেমেয়েদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

এজন্য আমাদের বহু করণীয় আছে। প্রথমেই প্রয়োজন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলার চর্চা, ছবি আঁকার চর্চাসহ আউট অব কারিকুলামকে গুরুত্ব দেওয়া। প্রতিটি মহল্লায়, পাড়ায়, খেলার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা, সামাজিক ক্লাব সৃষ্টি করা এবং একই সাথে জাতীয়ভাবে এই বিষয়গুলোর উপর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। বিশেষ করে আমাদের সাংস্কৃতি কর্মকাণ্ডে সরকারি বরাদ্দ অনেক অনেক গুণে বাড়ানো  উচিৎ।

আমরা আজকাল বিশেষ করে শহরগুলোতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা এসব বড় বড় শহরগুলোতে দেখছি যে স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেকটা রাস্তার একদম কাছেই। অনেকটা রাস্তা থেকে স্কুল কক্ষে এবং কক্ষ থেকে রাস্তায় বের হচ্ছেন একজন শিক্ষার্থী। প্রশ্ন হলো, খেলার মাঠ কই? সাংস্কৃতিক পরিচর্চা করার জন্য মিলনায়তন কই? বরঞ্চ গ্রামে-গঞ্জে এখনও দেখা যায়, বহু স্কুল যেগুলো বৃটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের সামনে অবারিত মাঠ আছে। শিক্ষার্থীরা সেখানে খেলাধুলা করার সুযোগ পায়। কিশোর গ্যাং কিন্তু আমরা এই শহর এলাকাতেই দেখি, গ্রামে এই ধরনের গ্যাং নেই বললেই চলে।

তাহলে আমাদের ঘাটতিটা আসলে কোন জায়গায়? আমার মতে, আমরা প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থানে যথাযথ গুরুত্ব দিতে পারিনি। এটা আমাদের জন্য একটা বড় ব্যর্থতা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সারাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণের আওতায় নিয়ে এসেছিলেন। কখন তিনি এই কাজটি করলেন, যখন রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য। মানুষের আহার-বাসস্থান-বস্ত্র সংকট অর্থাৎ মৌলিক চাহিদা পূরণ করার জন্য সারাবিশ্ব থেকে সাহায্য-সহযোগিতা এনে সেগুলো পূরণ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তখনও তিনি মনে করেছেন প্রাথমিক শিক্ষাকে মানসম্পন্ন করতে হবে। সেজন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে তিনি জাতীয়করণের আওতায় নিয়ে আসলেন। এর অর্থ কি? যে সকল প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন-ভাতা সরকার থেকে দেওয়া হবে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর খরচ সরকার থেকে বহন করতে হবে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে।

এতো বড় ঝুঁকি বঙ্গবন্ধু কেন নিলেন? নিয়েছিলেন এই কারণে যে বঙ্গবন্ধু জানতেন, তিনি যে বাংলাদেশ গড়ে তুলবেন, যে বাংলাদেশকে তিনি সোনার বাংলা বানাতে চান, আর সেই সোনার বাংলা রচনার জন্য যে ভিত রচনা করতে হবে, তা রচিত হবে আজকের নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের হাত ধরে। তাদেরকে সেই ধরণের শিক্ষাই দিতে হবে যা নিয়ে তারা সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। সেই জন্য বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় তিনি কোন বৈষম্য রাখেননি। একমুখী ও একধারার শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পরে আমরা দেখলাম প্রাথমিক শিক্ষাকে কতভাগে ভাগ করা হলো। সে কারণে আজকে প্রাথমিক নানা বিভাজন। আর এ কারণে নতুন প্রজন্মকে আমরা একটা জায়গাতেই আনতে পারছি না। তারপরে তারা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হচ্ছে। এই ব্যর্থতার দায় আমাদের সকলকেই নিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পরে ১৯৭৫ থেকে ২০১০ এই দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে কোন শিক্ষানীতি ছাড়া।

একজন মানুষের যদি চোখ থাকে তাহলে সে দেখতে পারে, কিš‘ তার মধ্যে যদি আমরা বিদ্যার আলো প্রজ্বলিত না করতে পারি, তাহলে সে কিন্তু চোখ থাকতেও অন্ধ। আর একজন মানুষ তার যদি চোখ নাও থাকে কিন্তু তার মধ্যে যদি বিদ্যার আলো প্রজ্বলিত করা যায় তিনি কিন্তু আরও বেশি দৃশ্যমান। বাংলাদেশ শিক্ষানীতি ছাড়া এগিয়ে যাওয়ার অর্থ হলো অন্ধের মতো এগিয়ে যাওয়া, তাই গেছেও। এই যে একটা প্রজন্ম, যে প্রজন্মটি সঠিক শিক্ষা পেল না, তারাই তো এখন নেতৃত্ব দিচ্ছে বা ভবিষ্যতে দেবে। সে কারণেই এই সমস্যাগুলো হচ্ছে।

আমি এখনও মনে করি বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে যে সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলিন, প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বিস্তৃত করে একমুখী শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে প্রাথমিক শিক্ষা, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা এবং দ্বাদশ শ্রেণি থেকে উচ্চ শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা উচিৎ। যেটি এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাস্তবায়নের পথে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছেন। একই সাথে অষ্টম শ্রেণির পড়ে কেউ যাবে ধর্মীয় শিক্ষা, কেউ যাবে কারিগরি শিক্ষা, বৃত্তিমূলক শিক্ষা-এইভাবে নানা বিভাজনে যাবে। কিš‘ প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রজাতন্ত্রের সকল শিক্ষার্থী যদি একই শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে থাকে তাহলে সেই শিক্ষার্থী অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাংলাদেশের ইতিহাস, উদারতা, সংকীর্ণতাকে পরিহার করে বেড়ে উঠতে বাধ্য। সেই সাথে বাংলা ভাষা এবং বাংলাদেশকে গুরুত্ব দেওয়ার মতো সার্বিক বিষয়গুলো আমরা শিক্ষাদের কাছে তুলে ধরতে পারবো।

আমি জানি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে বহু শিক্ষার্থী হয়তো আর পরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থাতেই যাবে না। তারা হয়তো অষ্টম শ্রেণী শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পন্ন করে কেউ চাকরিতে যোগ দেবে, কেউ কৃষি কাজে যুক্ত হবে, কেউ কেউ বিদেশে শ্রমিক হিসেবে যুক্ত হবে অথবা কেউ কেউ ব্যবসায় যুক্ত হবে। কিন্তু এই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যে শিক্ষাটা সে যে পেলো, এটাই তাকে বাংলাদেশের উপযোগী একজন নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সকল শিক্ষা দেবে। তাকে বিনয়ী করে তুলবে, তাকে সৎ করে তুলবে, তাকে দেশপ্রেমিক করে তুলবে।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর কথাই যদি বলি, বিশেষ করে চীনের কথা, জার্মানির কথা কিংবা জাপানের কথাই যদি বলি, তাহলে বলতে হবে সব দেশেই কিন্তু এই শিক্ষা ব্যবস্থাই পরিচালিত হচ্ছে। এখানেই উন্নত বিশ্বের সাথে আমাদের দেশের একটা ফারাক বা পার্থক্য আমরা লক্ষ্য করি। তার মূল কারণই হলো এটি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়তো শিক্ষার্থীদের তৈরি করছে না, এখানে এসে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হচ্ছে। এই শিক্ষার্থীরা আসছে কোথা থেকে? এরাই তো প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক, মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং তারপর আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত যে শিক্ষা ব্যবস্থা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বা যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষা ব্যবস্থা এটা তো একই ধারাবাহিকতায় চলমান। আমরা যদি একটা ফ্যাক্টরির কথা চিন্তা করি, কাঁচামালটা ডুকছে প্রাথমিকে, আর সেই কাঁচামাল বের হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরও রিফাইন্ড হয়ে, পরিশীলিত হয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং নিয়ে আমরা অনেক সময় প্রশ্ন তুলি, প্রশ্ন তোলাটাই স্বাভাবিক। তারপরও এই কথাটাই বলতে হবে যে, আমরা যদি প্রাথমিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে সেইভাবে শিক্ষার পুনর্বিন্যাস করতে পারি তাহলে দেখা যাবে বহু ছাত্র-ছাত্রী যারা উচ্চ শিক্ষায় যাবে তারা প্রাথমিক থেকেই অনেক বেশি মেধার অধিকারী হবে।

জাপানের উদাহরণ যদি বলি কিংবা জার্মানির কথা যদি বলি, সেসব দেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের যেভাবে মান এবং সম্মান দেওয়া হয় আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে মান সম্মান দেওয়া হয়, তা প্রায় সমমানের। কারণ প্রজাতন্ত্রের একজন নাগরিক গড়ে তোলার জন্য প্রাথমিক শিক্ষকের যে দায়িত্ব সেটি কোন অংশেই কম নয়। কিন্তু আমরা কি করি?

আমরা প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদেরকে তো আমরা সরকারের চতুর্থ কিংবা তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা তাদের চাইতেও কম বেতন-ভাতা দিয়ে থাকি। ফলে দেখা যায় যে, যারা একটু মেধাবী তারা প্রাথমিকের শিক্ষক হতে চান না। যারা প্রাথমিকের শিক্ষক হয়ে আসেন তারা বাধ্য হয়ে আসেন, কারণ তারা কোথাও চান্স পাননি। এমনকি পরিবারেও তারা সেই সম্মান পাচ্ছেন না। ধরেন এক পরিবারের ৪ সন্তান, কেউ সরকারি কর্মকর্তা, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ চিকিৎসক আর কেউ প্রাথমিকের শিক্ষক। দেখা যাবে সেই পরিবারের অভিভাবকও চিন্তা করবে তার এই শিক্ষক সন্তানটি কবে অন্য পেশায় যাবে। প্রাথিমিক শিক্ষকতা যে একটা গর্বের জায়গা, একটা অহংকারের জায়গা এই বোধটাই আমরা সমাজেও সৃষ্টি করতে পারি নাই, পরিবারেও সৃষ্টি করতে পারি নাই, সরকারি পর্যায়েও সৃষ্টি করা যায়নি। এই দায়টা আমাদের সকলকেই নিতে হবে।

জাতির পিতার সেই আদর্শের দিকে যদি আমরা ফিরে তাকাই তাহলে আমরা বুঝতেই পারি যে, প্রাথমিক শিক্ষাকে বঙ্গবন্ধু কতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সেই গুরুত্ব তো আর শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এ দায়িত্ব আমাদের সকলকেই নিতে হবে। এখন থেকেই আমাদের চেষ্টা করতে হবে। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি শিক্ষানীতি তৈরি করেন। ১৯৭৫ থেকে ২০১০ আমরা তো জাতিগতভাবে অন্ধের মতো চলেছি। ২০১০ থেকে আমরা একটা নীতিমালা অনুসরণ করে চলছি।
এ বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাধ্যমিক শিক্ষাকে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। নবম-দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান-কলা-মানবিক শাখার এই যে বিভাজন এটা বন্ধ করেছেন। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোন বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া নিষিদ্ধ করেছেন। এই পদ্ধতিগুলো কিন্তু উন্নত বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আমি মনে করি যে, এগুলোর একটা ইতিবাচক ফলাফল আমরা সামনে দেখতে পাবো।

আমি মনে করি, শিক্ষার ক্ষেত্রে আমুল পরিবর্তন আনতে রাষ্ট্রের করণীয় অনেক। একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে কাজ করতে হবে রাষ্ট্রকেই। একই এলাকায় একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমরা দেখি নিয়মিতই। প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা আছে। সেসব প্রতিষ্ঠানে বিনা বেতন শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে এমপিওভুক্তিও করা হবে সে আশাতে অনেকেই শিক্ষকতা পেশা শুরু করেন। পরে দেখা যায় দশকের পর দশক চলে যাচ্ছে, কিন্তু এমপিওভুক্ত হচ্ছে না। তখন বিনা বেতনে কিংবা নামমাত্র বেতনে মানবেতর জীবনযাপন করছেন শিক্ষককরা। তাদের পক্ষে মানসম্পন্ন শিক্ষা আশা করা কতটা যৌক্তিক?

অথচ একটা এলাকায় কতজন শিক্ষার্থী আছেন, তাদের জন্য কয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন, তা নির্ধারণ করার প্রয়োজন আছে। এটা নির্ধারণের জন্য সরকার যদি একটা পরিকল্পনা করে এবং এলাকাভিত্তিক চাহিদা অনুসারে যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করা যায় তাহলে এই সমস্যাগুলো কিন্তু আর থাকতো না।

আবার কখনও কখনও একজন রাজনীতিবিদ কিংবা একজন বিত্ত্ববান মানুষ নিজের নামে অথবা তাঁর পরিবারের নামে মাদ্রাসা করেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেন। কোন রকমে করেই তিনি আর কোন অর্থায়ন করেন না, এমপিওভুক্তির আশায় সেখানেও কিছু শিক্ষকদের যোগদানও করান কিন্তু মানসম্পন্ন শিক্ষা তো আর তাদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব না। বিনা পয়য়কে শিক্ষকতা করবে বলেন। তখন এলাকার কিছু ছেলে-মেয়েকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আবার মাদ্রাসাও আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও আছে, ফলে শিক্ষার্থী সংকট তৈরি হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে বলেছিলেন, আমি স্বাধীন বাংলাদেশে কেরানি শিক্ষা ব্যবস্থা বন্ধ করবো এবং কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার ঘটাবো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেদিক থেকেও আমরা পিছিয়ে গিয়েছি।

আজকে একজন শিক্ষার্থীকে এইচএসসি পাসের পর কোন না কোনভাবে তাকে অনার্স পাশ করতে হয়। পাবলিক বিশ্বদ্যিালয়ে সুযোগ না পেয়ে, সে তখন চলে যাচ্ছে একটা প্রাইভেট কলেজে। খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে যে, সেসব কলেজে একটা শিক্ষক পর্যন্তও নেই। থাকলেও একজন বা দুইজন শিক্ষক। সেখানে সে কোনরকমে একটা অনার্স ডিগ্রি নেয়। অনার্স ডিগ্রি নেওয়ার পরেও সে কোন কাজের সাথে যুক্ত হতে পারে না। বেকার থাকছে।

বিকল্প আমরা দেখি একজন শিক্ষার্থী ক্লাস এইট বা টেন পাশ করেই সে হয়তো হাতের কাজ শিখেছে, দেখা যাবে সে দকি ভালোই আয় করছে। অথচ অনার্স পাশ করা সার্টিফিকেট নিয়েও সে একটা চাকরি পারছে না। বাবা-মারাও মনে করছে কারিগরি শিক্ষার চাইতে অনার্স-মাস্টার্স সার্টিফিকেটটা জরুরি। ফলে আমরা এখন কি দেখি, যে একজন অনার্স পাশ করা শিক্ষার্থী কংবা মাস্টার্স পাশ করা শিক্ষার্থীরা কেরানি চাকরিও করতে পারছেন না, করতে হচ্ছে পিয়নের কাজ, দারোয়ানের কাজ। এই যে যেভাবে অপরিকল্পিতভাবে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স সাধারণ কলেজগুলোকে দেওয়া হয়েছে। এগুলো এদেশের যুব শক্তিকে ধ্বংস করার নামান্তর। যুব শক্তি এভাবে নিজেদের প্রাণ শক্তি সেটাকে ধ্বংস করছে।

এখানে আমার মনে হয় যে সরকারের শিক্ষা পরিকল্পনা আরও জোরদার করা এবং পরিকল্পনার আওতায় পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ে এসে, আমাদের যুব শক্তির পরিসংখ্যান বিবেচনা করে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঠেলে সাজাতে হবে। যাতে কোন যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণী শিক্ষা গ্রহণের পর বেকারত্বের জীবনে গিয়ে না পড়ে। এটা তার জীবনকে এমন একটা হতাশার দিকে ঠেলে দেয় যে সারাটি জীবন সে হতাশা নিয়ে কাটিয়ে দেয়।

আমার প্রস্তাবনা হবে:
১. প্রাথমিক শিক্ষাকে একমুখী এখন হয়তো করা কঠিন হবে। তবে যেটা করতে হবে শুণ্য থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সবমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে একটা সমন্বয় আনতে হবে। অর্থাৎ যে সরকারি বাংলা স্কুলে পড়ছে, যে শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় পড়ছে কিংবা ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ছে –এমন সব প্রাথমিক শিক্ষার মধ্যে কোর প্রোগ্রাম থাকতে হবে। কোর সিলেবাস, যা সব মাধ্যমেই পড়াতেই হবে।
২. এই কোর সিলেবাসে থাকবে ইংরেজি, বাংলা, গণিত, ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং নৈতিক শিক্ষা-এরকম কয়েকটা বিষয় বাছাই করতে হবে। এটা শিক্ষাবোর্ড ঠিক করবে। এই কো-কারিকুলামটা সকলকেই পাশ করতে হবে। তাহলে সে সার্টিফিকেট পাবে। হোক তা মাদ্রাসার, হোক ইংরেজি মিডিয়ামের কিংবা বাংলা মাধ্যমের।
৩. এর ফলে বঙ্গবন্ধুর যে একধারা শিক্ষার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা আবারো বলবৎ হবে। হয়তো ঠিক ওটাই নিশ্চিত করা গেলো না, কিন্তু‘ একই রকম একটা শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে আমরা এগিয়ে গেলাম। এটা যদি করা যায় তাহলে আমি ধারণা করি আমাদের শিশুদেরকে একটা বাংলাদেশমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করা সম্ভব হবে।
৪. নৈতিক শিক্ষাটাকে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন আছে। একটি শিশু প্রাথমিকেই জেনে যাবে যে সে একজন মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছে। জন্মগ্রহণ করার সাথে সাথেই সে মানুষ হয়ে যায় নাই। তাকে মানুষ করে গড়ে তুলতে হবে। রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উক্তি আছে, সকল শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য একটি, একজন শিক্ষার্থীর মাঝে মনুষ্যত্যের বিকাশ ঘটানো। তো, এই মনুষ্যত্যের বিকাশ যদি প্রাথমিকেই ঘটানো যায় তাহলে সে চুরি করা, দুর্নীতি করা, খুন করা তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। কারণ সে তখন মানুষ হয়েছে। সেই মানুষ হওয়ার কথাই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সোনার মানুষ চাই।
৫. আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় সব কিছু আছে কিন্তু সেই সোনার মানুষ হওয়ার শিক্ষাটা আমরা এখনও দিতে পারিনি। আমরা জিপিএফ ৫ পাওয়ার শিক্ষা দিচ্ছি, প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার শিক্ষা দিচ্ছি কিন্তু‘ মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিচ্ছি না। আর সে কারণেই সে সচিব হয়েও দুর্নীতি করছে। বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসেও এখানে মিথ্যা কথা বলছে। একজন সত্যিকারের শিক্ষিত মানুষ কখনও মিথ্যা বলতে পারে না। সুশিক্ষিত মানুষ সব সময়ই সত্যবাদী হবে।

এই শিক্ষাগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই এই শিক্ষাগুলো দিতে হবে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির মধ্যেই। এই শিক্ষা দেওয়ার জন্য সেই মানের শিক্ষকই দরকার। সেইখানটাতেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। মানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে পারে এমন শিক্ষক নিয়োগ দিতে না পারলেও প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা যেতে পারে। এইখানেই সবচেয়ে বেশি বাজেট বরাদ্দ দিয়ে ভালো ভালো মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। আর এটা করা গেলেই আমি মনে করি শিক্ষা সংক্রান্ত ৮০ শতাংশ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

আমরা যদি জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ফলো তাহলে দেখবো সেখানে ক্লাশ টেন পর্যন্ত কোন পরীক্ষা নেওয়া হয় না। তাদের মূল্যায়ন করছে শিক্ষকরা। জাপানের শিক্ষার্থীরা তাদের টয়লেট পরিস্কার করছে, তাদের শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার করছে, তাদের বাগান তারা করছে, একজন মানুষ হওয়ার জন্য যে শিক্ষাটা তাদের পাওয়া দরকার তা তারা পাচ্ছে, সেই সাথে একজন আরেকজনের সাথে সহমর্মিতা, সহযোগিতা, সমব্যাথী হওয়া শিখছে। এসব শিক্ষার উপরই তার মার্কিংটা বেশি। এমন শিক্ষার্থী পেতে হলে আমাদের আগে মানবিক শিক্ষক তৈরি করতে হবে। এমন শিক্ষক পেতে হলে প্রয়োজনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনতে হবে। তাদেরকে জাপানে পাঠাতে হবে, তাদেরকে জার্মানিতে পাঠাতে হবে। এজন্য সরকারের বরাদ্দও বাড়াতে হবে। অথচ আমরা প্রাথমিকের শিক্ষকদের বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে বেশি চিন্তা করি। চিন্তা বেশি করা উচিৎ প্রাথমিকের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের নিয়ে। তাহলেই ১৯৭৫ থেকে ২০১০ এ তৈরি শিক্ষাশুণ্যতা কিছুটা হলেও পূরণ করা সম্ভব হবে।  


Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.