কখনো পাঁচশ, কখনো হাজার টাকা। আবার কখনো খালি হাতে ঘরে ফিরে যান দৃষ্টিহীন শিল্পী। সারাদিন নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রে সিঁড়িতে, আবার কখনো সড়কের পাশে পাহাড়ের ধারে আসর বসিয়ে ঢোল বেজে নিজের সুরেলা কণ্ঠে গান শোনাচ্ছেন তিনি। সন্ধ্যা নেমে আসলে ফিরে যান নিজ বাড়িতে।
সকাল হলে আবার গাড়িযোগে ছুটে আসেন যৌথ খামার মুখে। সেখানে নেমে কখনো হেঁটে আবার কারো সাহায্য পেলে চলে আসেন গাড়ি করে। তবে প্রায় সময় সন্তানের কাঁধে হাত দিয়ে কয়েক মাইল পথ হেঁটে ছুটে যান নিলাচল কেন্দ্রে পর্যটকদের আনন্দ দিতে।
সারাদিন নিলাচলে বসে ঢোল বাজিয়ে গান শুনাচ্ছেন অনেকজনকে। তার গলার মিষ্টি কণ্ঠে গানের সাথে তাল মিলিয়ে আনন্দে মেতে উঠেন পর্যটকরা। তাদের অনুরোধে বিভিন্ন গান গেয়ে শোনান দৃষ্টিহীন এই শিল্পী। তার ঢোলে গানের সুরে মুখরিত হয়ে উঠে নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রটি। কখনো বাউল, আবার আঞ্চলিক, মুর্সিদী, বিচ্ছেদ ও পল্লী গান গেয়ে থেকেন। তার গানের খুশি হয়ে যা দিয়ে যান সেটি তার আয়। এভাবে টানা ৩০ বছর ধরে বান্দরবানের নিলাচল পর্যটন কেন্দ্রে বসে ঢোল বাজিয়ে গান শুনিয়ে আনন্দ দিয়ে আসছে তিনি। দিনশেষে যেসব টাকা উপার্জন করেন সেসব টাকায় টেনেটুনে সংসার চালাচ্ছেন তিনি।
অন্ন জলদাশের চোখ হারিয়েছে আট বছর বয়সে। টাইফয়েড রোগের পাশপাশি অনান্য রোগের আক্রান্ত হওয়ার পর অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেননি। তান্ত্রিক ঔষদের উপর নির্ভর করে তবুও চোখের দৃষ্টি ফেরাতে পারেননি। তখন থেকে দৃষ্টিহীন হয়ে পড়ে। তারপরেও হার মানেননি, অন্ধ হয়েও ভিক্ষা না করে গান শুনিয়ে আয় উপার্জন করছেন। তার একমাত্র সম্বল কাধের ঝুলে থাকা ঢোল। তার এই ঢোলের শব্দ শুনে ছুটে আসেন পর্যটকরা। আনন্দে মেতে উঠেন বিভিন্ন শ্রেনীর মানুষ। সারাদিন গান শুনিয়ে যেসব আয় করেন সেসব টাকা দিয়ে তার সংসার চলে। তবে পর্যটক না থাকলে অনেক সময় খালি হাতে ফিরিয়ে যান। তবে তার গান শুনতে অপেক্ষায় প্রহরে থাকেন স্থানীয়সহ পর্যটকরাও।
দৃষ্টিহীন শিল্পীর অন্ন জলদাশের বয়স এখন চল্লিশ বছর। বসবাস করেন সাতকানিয়া উপজেলার ধর্মপুর গ্রামে। তার নিজ গ্রামে সম্পত্তি বলতে কোন কিছু নাই। নিজের সর্বশেষ সম্বল একটি বাড়ি একটি রয়েছে সেখানে পরিবারের সবাই বসবাস করেন। মাঝে মধ্যে এনজিও থেকে লোন নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। বাড়িতে তার তিন সন্তান রয়েছে। তারা পড়ালেখা জানেন নাহ। পরিবার দরিদ্রতা হওয়ার কারনে সন্তানদের পড়ালেখা শিখাতে পারেননি। সন্তানরা সাহায্য করতে প্রতিদিন বাবার সাথে করে নিলাচলে আসেন। বিকাল গরিয়ে গেলে আবার ছেলের কাধ ধরে বাড়িতে ফিয়ে যান। সাতকানিয়া থেকে যৌথ খামারের মুখে আসতে প্রতিদিন তার খরচ হয় দুইশত মাঝে মধ্যে আবার বিনামূল্যে নিয়ে আসেন চালকরা। নিলাচলে সারাদিন বসে থাকেন গান শোনাতে। কিন্তু খাবার কখনো খাওয়া হয় আবার কখনো পানি খেয়ে দিন পাড় করেন। নিলাচলে ঘুরতে আসা পর্যটকদের আনন্দ দিতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটে যান তিনি। সংসার চালানো ত্যাগীতে প্রতিদিন নিলাচলে এসে পর্যটকদের গান শুনিয়ে আনন্দ দিয়ে থাকেন দৃষ্টিহীন অন্ন জলদাশ।
ঘুরতে আসা পর্যটক কামাল, ইমন, শফিকুলসহ বেশ কয়েকজন শ্রোতা সাথে কথা হয়। তারা জানিয়েছেন, নিলাচলে ঘুরতে আসলে দৃষ্টিহীন শিল্পীর গান শোনেন সবাই। তার ঢোলের ও মধুর কন্ঠের গান শুনে সবাই আনন্দ পান। তার গান শুনে অনেকে তাকে বিশ টাকা থেকে শুরু করে পাঁচশ টাকাও দিয়ে যায়। এভাবেই গান গেয়ে যে আয় হয় তা দিয়ে চলে তার সংসার। ইচ্ছেমতো গান শোনা হলে তারপর যাই। তবে যে যার স্থান থেকে সহযোগীতা হাত বাড়ানো জন্য সকলের প্রতি মিনতি করেন পর্যটকরা।
নীলাচলে চায়ের দোকানদার সুস্মিতা তংচঙ্গ্যা বলেন, প্রতিদিন সকাল হলেই নিলাচলে চলে আসেন গান শোনাতে। মাঝে মধ্যে একা আবার অনেক সময় তার সন্তানকে সাথে নিয়ে আসে। সারাদিন সিড়িতে বসে ঢোল বাজিয়ে গান শোনান পর্যটকদের। অনেকে খুশি হয়ে টাকা দিয়ে যায়। সন্ধ্যায় হলে আবার চলে যায়। সহযোগিতা হাত বাড়িয়ে দিলে তার জন্য খুব ভালো হয়।
কথা হয় দৃষ্টিহীন শিল্পীর অন্ন জলদাশের সঙ্গে। তিনি বলেন, ছোটবেলায় টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে না পেরে তার দুই চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন। এরপর থেকে একটি বাউল শিল্পীর কাছ থেকে গান শিখেন। পরে তাকে বিভিন্ন স্থানে গান করতে ভাড়া করে নিয়ে যায়। যা পান তাই দিয়ে টেনেটুনে সংসার চলে। তাছাড়া বিগত ৩০ বছর ধরে নিলাচল পর্যটন কেন্দ্রে গান শুনিয়ে আসছেন। কখনো বাউল আবার কখনো আঞ্চলিকসহ নানা পদের গান। তার গান শুনে পর্যটকরা ২০ টাকা থেকে শুরু করে যা দিয়ে যায় সেটি তার আয়। কখনো পাঁচশ বার কখনো একহাজার পান। মাঝে মধ্যে খালি হাতে ফিরে গেছেন।
অন্ন জলদাশ বলেন, আমার চোখ হারিয়েও থেমে থাকেনি। ভিক্ষা করতে আমার লজ্জা লাগে। তাই গান গেয়ে সবাইকে শোনায়। পরিবারের তিনজন ছেলে মেয়ে আছে। টাকার অভাবে কাউকে পড়ালেখা শেখাতে পারেনি। সংসারের আমি একজন অর্থ উপার্জন করি। আর সবাই এখনো নাবালক। প্রতিদিন নীলাচলে ছেলেদের নিয়ে এসে বসে সবাইকে গান শোনাচ্ছি। সন্ধায় হলে বাড়িতে ফিরে যায়। তাছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে পাননি কোনো সহযোগিতা। তাই তো প্রধানমন্ত্রীসহ সমাজের বিত্তবানদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন অন্ন জলদাশ। একটু সহযোগিতা পেলে হয়তো শেষ বয়সটা শান্তিতে কাটাতে পারতেন তিনি।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । সম্পাদক: 01703-137775 । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh