× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

ঝিনাইদহ জেলার ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থানসমূহ

কাজী নাসরীন

০৭ অক্টোবর ২০২২, ১০:১৭ এএম

গাজী কালু ও চম্পাবতীর মাজার

ঝিনাইদহ ৬টি উপজেলা নিয়ে জেলার প্রশাসনিক অঞ্চল গঠিত। বৃটিশ আমলে এখানে কোর্ট ছিল এবং ১৮৬২ সাল পর্যন্ত এটি মহকুমা বাণিজ্য নগরী হিসেবে খ্যাত ছিল।হরিণাকুন্ডু লোকমুখে প্রচার আছে ‘‘অভয়কুন্ড নামে এক ইংরেজ কর্মচারীর অত্যাচারী পুত্র হরিচরণ কুণ্ডুর নামানুসারে এ অঞ্চলের নাম হয় হরিণাকুন্ডু । বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা বিভাগের ঝিনাইদহ জেলার আয়তন ১৯৬৪.৭৭ বর্গ কিলোমিটার(৭৫৮.৬০ বর্গ মাইল)। এ জেলার পূর্ব পার্শ্বে মাগুরা জেলা, উত্তরে কুষ্টিয়া জেলা, দক্ষিণে যশোর জেলা ও পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগণা, এবং পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগণা ও বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গা জেলা অবস্থিত। এ অঞ্চলের জলবায়ু উষ্ণ প্রকৃতির ও সমভাবাপন্ন। 

প্রশাসনিক এলাকাসমূহ

এই জেলা ৬টি উপজেলা, ৬৭টি ইউনিয়ন, ৯৪৫টি মউজা, ১১৪৪ টি গ্রাম, ৬টি পৌরসভা, ৫৪ টি ওয়ার্ড এবং ১৩৬ টি মহল্লা নিয়ে গঠিত। ঝিনাইদহ জেলার ৭টি নদ-নদী প্রবাহিত এ জেলার মধ্যদিয়ে: বেগবতী, ইছামতী, কোদলা, কপোতাক্ষ নদ, নবগঙ্গা নদী, চিত্রা নদী ও কুমার নদী। এ অঞ্চলের জলবায়ু উষ্ণ প্রকৃতির ও সমভাবাপন্ন। উপজেলাগুলো হলো: কালীগঞ্জ উপজেলা, কোটচাঁদপুর উপজেলা, ঝিনাইদহ সদর উপজেলা, মহেশপুর উপজেলা, শৈলকুপা উপজেলা, হরিণাকুন্ডু উপজেলা।

ইতিহাস

ঝিনাইদহ যশোর জেলার একটি মহকুমা ছিল। ঝিনাইদহ জেলাটি ১৮৬২ সালে মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৮৪ সালে এটি একটি পৃথক জেলা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝিনাইদহ জেলা ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। 

জনসংখ্যা

বাংলাদেশের আদমশুমারি ও গৃহগণনা-২০১১ অনুযায়ী, ঝিনাইদহ জেলার জনসংখ্যা হলো ১৭,৭১,৩০৪ জন। জনসংখ্যার ঘনত্ব হলো ৯০১.৫ জন/বর্গ কিমি। পুরুষ হল জনসংখ্যার ৫০.০৪% এবং মহিলা ৪৯.৯৬%। ঝিনাইদহে সাক্ষরতার হার ৪৮.৪%।

অর্থনৈতিক অবস্থা

ঝিনাইদহের অর্থনীতি সাধারণত কৃষির উপর নির্ভরশীল। ৬৬.৫০% বাড়িতে নানা ধরনের ফসল ফলিয়ে থাকেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ধান, পাট, আখ, গম, শাকসবজি,মসলা, ডাল। এছাড়াও ফলমুলের মধ্যে রয়েছে আম, পেয়ারা, কাঁঠাল, কলা, লিচু, নারকেল, খেজুর, তাল ইত্যাদি। এছাড়াও অন্য খাত যেমন প্রবাসী, সরকারি চাকরিজীবী, গার্মেন্টস কর্মীরাও এখানকার অর্থনীতিতে অনেক অবদান রাখছে। প্রধান ফসল ও ফলমূলঃ

ধান, পান, পাট, গম, আখ, সরিষা,মরিচ, রসুন, পেঁয়াজ, বিভিন্ন ধরনের ডাল শাকসবজি হলো এই এলাকার প্রধান ফসল।

উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব

লতিফুর রহমান - বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা; খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর ; - ইসলামি ব্যক্তিত্ব ও অধ্যাপক আল-হাদিস বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া, গোলাম মোস্তফা - কবি; বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান - বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বীরশ্রেষ্ঠ; লালন শাহ - বাউল সাধক, গায়ক, গীতিকার; মুস্তফা মনোয়ার - চিত্রশিল্পী; পাগলা কানাই সাধকসহ আরো অনেকে.

মুক্তিযুদ্ধ..ঝিনাইদহ জেলা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। সর্বশেষ প্রকাশিত সরকারি গেজেট মতে,এ জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা-২০৮৩ জন।

ঝিনাইদহ জেলার উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানসমূহঃ

নলডাঙ্গা রাজবাড়ী, সাতগাছিয়া মসজিদ, বারবাজারের প্রাচীন মসজিদ, গাজীকালু চম্পাবতীর মাজার, শৈলকূপা জমিদার বাড়ি, খালিশপুর নীলকুঠি, গলাকাটা মসজিদ, জোড় বাংলা মসজিদ, পায়রা দূয়াহ্, শাহী মসজিদ, শিব মন্দির, ঢোল সমুদ্রের দীঘি, মিয়া বাড়ির দালান, পাঞ্জু শাহ'র মাজার ।

(০১) গাজী কালু ও চম্পাবতীর মাজার

গাজী-কালু ও চম্পাবতীর পরিচয় নিয়ে আছে নানা কিংবদন্তি। জনশ্রততিতে পাওয়া যায় বিরাট নগরের শাসক দরবেশ শাহ্ সিকান্দারের পুত্র গাজী। কালু সিকান্দারের পোষ্য পুত্র । কালু গাজীকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং সর্বত্র তাকে অনুসরণ করতেন। বারবাজারের ঐতিহ্য ও দর্শনীয় স্থান হিসাবে গাজী-কালু-চম্পাবতীর মাজার শরীফ দিনে দিনে তার ভক্তশ্রোতা বেড়েই চলেছে। প্রতিবছর এখানে ওরশ শরীফ পালন করা হয়। আর এই ওরশ শরীফে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। মত দ্বৈততা থাকলেও এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, গাজী- কালু ও চম্পাবতীর মাজার বারোবাজারেই অবস্থিত।

গাজীর সাথে ছাপাই নগরের সামন্ত রাজা রামচন্দ্র ওরফে মুকুট রাজার মেয়ে চম্পাবতীর দেখা হয়। গাজী ভুলে গেলেন তিনি মুসলমান, চম্পাবতীও ভুলে গেলেন তিনি হিন্দু রাজার মেয়ে। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠলো। তাদের মিলনের মাঝে দুর্ভেদ্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়াল সামাজিক ও ধর্মীয় বাঁধা। ঘোর যুদ্ধে মুকুট রায়ের সেনাপতি দক্ষিণা রায় পরাজিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে গাজীর অনুসারী হয়। গাজী- কালু ও চম্পাবতীর মাজারের সাথে দক্ষিণা রায়ের মাজার আছে। মুকুটরাজা ঝিনাইদহ, কোটচাঁদপুর, বারোবাজারের পূর্ব এলাকা ও বেনাপোল অঞ্চলের সামস্ত রাজা ছিলেন। এ মুকুট রাজা বা রাজা রামচন্দ্র গাজীর অনুসারী বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে চম্পাবতীকে নিয়ে তার প্রধান বাড়ি ঝিনাইদহের বাড়িবাথানে চলে আসেন। গাজীও তাকে অনুসরণ করেন। ঝিনাইদহে গিয়ে গাজী, রাজার সেনাপতি গয়েশ রায়ের প্রমোদ ভবন জালিবল্লা পুকুরের পাড়ে বদমতলীতে ছাউনি ফেলেন। এখানেও গাজীর মাজার দেখতে পাওয়া যায়। জয়দিয়ার বাওড় একসময় ভৈরব নদের অংশ ছিল। বাওড়ের পূর্ব পাড়ে ছিল রাজার বাড়ি। দক্ষিণ পাশে বাওড়ের কুল ঘেষে তমাল গাছের নিচে আজও গাজীর দরগা বিদ্যমান। হয়তো প্রেমের টানে গাজী এখানেও ছুটে এসেছিলেন সঙ্গী কালুকে নিয়ে। অবশেষে গাজী অনুসারীদের নিয়ে বহু খন্ড যুদ্ধের পর রাজা রামচন্দ্রের কাছ থেকে চম্পাবতীকে উদ্ধার করে বারোবাজার ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু গাজীর পিতা শাহ্ সিকান্দার বিষয়টা মেনে নেননি। মুকুট রাজা শাহ্ সিকান্দারের প্রতিবেশী। হিন্দু সমাজের অসন্তষ্টির কারণে তিনি গাজীকে বাড়ী উঠতে দেননি। বাধ্য হয়ে গাজী দরবেশ বেশে চম্পাবতীকে নিয়ে বাদাবনে বেরিয়ে পড়লেন। সঙ্গী হলো কালু ও দক্ষিণা রায়। সুন্দরবনের বাদাবন বেশী দূরে ছিল না। নাভারণ, বেনাপোল, সাতক্ষীরা, বনগাঁ বাদাবন অঞ্চল ছিল। অসীম সাহসী গাজী আস্তানা গাড়লেন বাদাবনে। গাজী- কালু ও চম্পাবতীর মাজারে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের মানুষ মানত করে। শ্রীরাম রাজার বেড় দীঘির দক্ষিণ পাশে ৩টি পাশাপাশি কবরের অবস্থান । মাঝখানে বড় কবরটি গাজীর, পশ্চিমেরটি কালুর এবং পূর্বের ছোট কবরটি চম্পাবতীর বলে পরিচিত। মাজার সন্নিহিত দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি প্রাচীন বটগাছ আছে। এই বটগাছের তলদেশে একটি শূণ্যস্থান দেখা যায়। এটিকে অনেকে কূপ কিংবা অন্য কোন কবর বলে মনে করেন। ১৯৯২ সালে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসন কবর তিনটি বাঁধাই করে বেষ্টনি প্রাচীর নির্মাণ ও খাদেমদের থাকার জন্য সেমিপাকা টিন শেড তৈরী করেছেন। গাজী কালু চম্পাবতীর সাথে দক্ষিণা রায়ের কবরও এখানে রয়েছে।

(০২) শৈলকূপা জমিদার বাড়ি 

ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপায় জমিদারদের জমিদারি নেই। আছে সে যুগের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র কলের গান আর বেশ কিছু প্রাচীন প্রত্ন নিদর্শন। শৈলকুপার আবাইপুরে রামসুন্দর শিকদারের শিকদার স্ট্রিট জমিদারির পতন হয়েছে অনেক আগে। ৪শ’ বিঘা জমির উপর নির্মিত জৌলুসপূর্ণ রাজ প্রাসাদের ভাঙাচোরা (ধ্বংসাবশেষ) দালানের এক কোণে এখন বাস করেন জমিদার রামসুন্দর শিকদারের বংশধররা। চরম অভাব-অনটনের মধ্যেও তারা সযত্নে আঁকড়ে রেখেছেন সে যুগের একটি বৃহৎ গ্রামোফোন (কলের গান), পাথরের তৈরি হুক্কা, একটি তরবারি, প্রাচীন আমলের শ্রীমদ্ভাগবত, বাদ্যযন্ত্র এসরাজ, শাল কাঠের তৈরি পুরাতন দু’টি মন্দির ও রূপার তৈরি জরির নকশা করা বেনারসি শাড়ির অংশবিশেষ।

 বাংলা ১২শ’ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে অবিভক্ত ভারতবর্ষের যশোর জেলার আবাইপুর এলাকায় শিকদার স্ট্রীট এর জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন জমিদার রামসুন্দর শিকদার। বংশটির আদি উপাধি ছিল তিলিকুণ্ডু সম্প্রদায়। রামসুন্দর শিকদারের ঠাকুর দাদা কার্তিক চন্দ্র শিকদার ছিলেন চাল ব্যবসায়ী। তৎকালীন সময়ে চালের ব্যবসা করে তিনি প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক হন। ব্যবসার সফলতার কারণে মুর্শিদাবাদের নবাব দরবার থেকে তিনি শিকদার উপাধি লাভ করেন। রামসুন্দর পৈত্রিক নিবাস শৈলকূপার আবাইপুরে প্রায় ৪শ’ বিঘা জমির উপরে গড়ে তোলেন বিশাল এক প্রাসাদ। জমিদার বাড়িরচারিদিকে ঘোরানো দালানে কক্ষ ছিল প্রায় সাড়ে ৩শ’। তৎকালীন সম এখানে সাব-রেজিস্ট্রার অফিস স্থাপনসহ একটি বড় বাজার গড়ে তোলেন তিনি। অজপাড়া গাঁয়ে স্থাপন করেন থিয়েটার হল এবং এখানেই তিনি তার জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। যা ইতিহাসে শিকদার স্ট্রীট নামে পরিচিতি লাভ করেন। অবশ্য ১৯২৪ সালে সাব রেজিস্ট্রার অফিসটি উঠে যায়।

রামসুন্দরের বংশধরঃ বাংলা ১২৭০ সালের ২৫  বৈশাখ পরলোকগমন করেন জমিদার রামসুন্দর শিকদার। মৃত্যুকালে তিনি ৭ পুত্র সন্তান রেখে যান। তারা হলেন- মীরমাধব, বেণীমাধব, যাদব, অক্কুর চন্দ্র, ক্ষেত্র, দ্রুব ও বীরসুম্ভার। রামসুন্দরের রেখে যাওয়া জমিদারি ও ব্যবসা তার ছেলেরা দেখাশুনা করতে থাকেন। বাংলা ১৩০৪ সালে পাটের ব্যবসা শুরু করে তারা আরো প্রতিষ্ঠা পান। তৎকালীন সময়ে কলকাতায় শিকদার অ্যান্ড কোম্পানীর নামে তারা পাটের ব্যাবসা শুরু করেন। ১৩১৯ সালে কোম্পানীটির ট্রেডমার্কের পাট বিলেতের ডান্ডিতে পৃথিবীর মধ্যে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা পায়। রামসুন্দর শিকদারের মৃত্যুর ২৫ বছর পর আবাইপুরে রামসুন্দর ইনস্টিটিউট নামে একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন তার পুত্ররা। এরপর কালের বিবর্তনে আবাইপুরের শিকদার স্ট্রীট ধ্বংস হয়ে যায়। বিলুপ্ত হয় জমিদারি।

রামসুন্দরের পৈতৃক ভিটার বর্তমান অবস্থাঃ

শৈলকুপা উপজেলা শহরের ১৭ কিলোমিটার পূর্বে মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলা সীমান্তঘেঁষা এলাকা আবাইপুর। যেখানে রামসুন্দরের পৈতৃক ভিটা দ্বিতল রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ আজও রয়েছে। দখলবাজরা রাজবাড়ির অনেকাংশ ভেঙে ভেঙে একটি থেকে একটি আলাদা করে ফেলেছে। লুট হয়ে গেছে বাড়ির সরঞ্জামাদি (লোহা ও কাঠের তৈরি)। বিশাল এই রাজবাড়িটির উত্তর দিকের একটি ভবনে ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কার্যক্রম চলে। আর পশ্চিম দিকের একটি ভবনের একাংশে বসবাস করছেন জমিদার রামসুন্দর শিকদারের ৫ম পুরুষ অভিভূষণ শিকদার, রাজকুমার শিকদার ও অনিমেষ শিকদার। তারা পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া জমি-জমিদারি প্রাসাদ ধন-সম্পদ রক্ষা করতে না পারলেও বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন কিছু মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। 

ঢোল সমুদ্র দীঘি 

ঝিনাইদহে রাজা মুকুট রায় নামে এক প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন। রাজা মুকুট রায়ের অনেক সৈন্য সামন্ত ছিল। কথিত আছে তিনি ১৬ হল্কা হাতি, ২০ হল্কা  অশ্ব  ও ২,২০০ কোড়দার না নিয়ে বের হতেন না। খাঁন জাহান আলী (রাঃ)  এর মতো তিনিও জলাশয় প্রতিষ্ঠায় যত্নবান ছিলেন। রাস্তা নির্মাণ  ও জলাশয় খনন করতে করতে তিনি  অগ্রসর হতেন। ঝিনাইদহে তাঁর এমনি একটি  অমর  কীর্তি ঐতিহ্যবাহী পাগলা কানাই ইউনিয়নের ঢোল সমুদ্র দীঘি।  প্রায় ৫২ বিঘা জমির উপর অবস্থিত এ দীঘি ঝিনাইদহের সর্ববৃহৎ দীঘি। দীঘিটি শতাব্দী পরিক্রমায় পানীয় জলের অফুরন্ত আধার হিসেবে কাজ করেছে এবং একজন পরাক্রমশালী রাজার রাজকীয় স্থাপনা সমূহের একটি স্মৃতি হিসেবে আজও টিকে আছে। ঝিনাইদহ শহরের পূর্বে বিজয়পুর ছিল রাজা মুকুট রায়ের রাজধানী। বাড়ীবাথানে রাজার প্রকান্ড গোশালা ছিল। বহু সংখ্যক গাভী ছিল বলে লোকে তাকে বৃন্দাবনের নন্দ মহারাজ বলত। বেড়বাড়ীতে রাজার উদ্যান ছিল। ঢোল সমুদ্র দীঘিটি ঝিনাইদহের একটি আকর্ষণীয় বিনোদন স্থান। ঢোল সমুদ্র দীঘি খননের পেছনে একটি লোকশ্রততি আছে-রাজা মুকুট রায়ের রাজত্বকালে একবার জলকষ্ট দেখা দেয়। বিল, বাওড়, নদী দীঘি- কোথাও জল ছিল না। অনন্যোপায় হয়ে রাজা দীঘি খননের সিদ্ধান্ত নেন। অগণিত লোকের দিন রাত পরিশ্রমে দীঘি গভীর হতে গভীরতর এবং চতুর্দিকে প্রশস্ত হতে লাগল। কিস্তু পুকুরে জল উঠল না। হতাশ রাজা একদিন স্বপ্ন দেখলেন যে, রাণী যদি পুকুরে নেমে পূজা দেন, তবে পুকুরে জল উঠবে। এ কথা জেনে প্রজাহিতৈষী রাণী পূজার নৈবেদ্য নিয়ে পুকুরে নামলেন। রাণী পুকুরের তলদেশে উপস্থি হয়ে ইষ্টদেবতাকে নিবেদন  করলেন পূজার অর্ঘ্য। জল ওঠা শুরু হলো। প্রার্থনা পূর্ণ হওয়ায় রাণী উপরে উঠতে শুরু করলেন। জল দেখে উদ্বেলিত পাড়ের সহস্র প্রজার উৎসব-আনন্দ আর বাদ্য-বাজনার মধ্যে অলক্ষ্যে রাণী অথৈ জলরাশির গভীরে তলিয়ে গেলেন। গভীর শোকে শোকাভিভূত প্রজাগণ রাজাকে রাজপুরীতে যেয়ে এই দুঃসংবাদ জানালেন। সেই স্মৃতি স্মরণে আজও লোকজন এ দীঘিকে ঢোল সমুদ্র দীঘি বলে জানে। রাজা মুকুট রায় বাড়ি বাথানের যুদ্ধে নবাবের ও পাঠান সৈন্যের মিলিত শক্তির কাছে পরাজিত হন। নবাব সৈন্যরা রাজা মুকুট রায়কে বন্দী করে রাজধানীতে নিয়ে যায়। রাজার পরিচয় জেনে নবাব তাঁকে মুক্তি দেন। কিন্তু রাজার পরিবারের সদস্যগণ রাজার অনিবার্য পরিণতি, মৃত্যু ভেবে সবাই আত্মহত্যা করেন। তাঁর কন্যার আত্মহত্যার স্থানকে কন্যা দু’রাণীর আত্মহত্যার স্থানকে দুসতীনের, রাজ জ্যোতিষীর  আত্মহত্যার স্থানকে দৈবজ্ঞদহনামে অভিহিত করা হয়েছে, যা আজও এ নামেই পরিচিত।

 কে,পি, বসুর বাড়ি

জগদ্বিখ্যাত গণিতবিদ অধ্যাপক কালীপদ বসু ১৯০৭ সালে নিজের জম্মস্থান ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হরিশংকরপুর গ্রামে নবগঙ্গা নদীর তীরে ১ একর জমির উপর ১৭ কক্ষ বিশিষ্ট এক প্রাসাদোপম দ্বিতল ভবন নির্মাণ করেন। বাড়িটি এখনও বসবাসযোগ্য এবং সুদৃশ্যই বলা যায়। কালীপদ বসু (কে,পি বসু) (১৮৬৫-১৯১৪) বাংলার বিখ্যাত গণিতবিদ অধ্যাপক কালীপদ বসু (কে,পি বসু) ১৮৬৫ সালে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হরিশংকরপুর গ্রামে জম্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মহিমা চরণ বসু। কে,পি বসুর শিক্ষা জীবনের সূচনা হয় নিজ গ্রামের পাঠশালায় মেধাবী শিক্ষক নছিমউদ্দিন মন্ডলের কাছে। কে,পি বসুর গণিতমনস্কতা সৃষ্টিতে তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। তিনি ১৮৯২ সালের দিকে ঢাকা কলেজে গণিত শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এবং আমৃত্যু ঐ কলেজের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কে,পি বসু স্বগ্রামের মেঘমালা ঘোষকে বিয়ে করেন। ব্যক্তিগত জীবনে এ মহান গণিতবিদ অত্যন্ত সদালাপী, অমায়িক ও অনাড়ম্বর ছিলেন। শিক্ষকতা জীবনে তিনি পাঠদানের মধ্যেই নিজের কর্মকান্ডকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। ১৮৮২ সালে হান্টার কমিশনের সুপারিশকৃত ইউরোপীয় সংস্করণ ‘আধুনিক এলজাবরা’বইটির অধ্যয়ন ও অনুশীলনের পথকে সুগম, প্রাঞ্জল ও সহজ করে তোলেন। অসংখ্য নতুন অংক উদ্ভাবন করে এ শাস্ত্রের কলেবর বৃদ্ধি ও উৎকর্ষ সাধন করেছেন। অধ্যাপনার সাথে সাথে তিনি এ্যালজাবরা ও জ্যামিতি শাস্ত্রের উপর গবেষণা চালিয়ে যান। তাঁর ঐকান্তিক সাধনায়”এলজাবরা মেড ইজি’ “মডার্ণ জিওমেট্রি’ “ইন্টারমিডিয়েট সলিড জিওমেট্রি’ প্রভৃতি গ্রন্থপ্রণীত হয়। প্রকাশনা শিল্পের প্রতিও তার মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। তিনি কলকাতায় কে,পি বসু পাবলিশিং কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করেন। মেধা, অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের বলে তিনি প্রতিষ্ঠা অর্জন ও প্রভূত অর্থের মালিক হয়েছিলেন। ১৯০৭ সালে তিনি স্ব-গ্রামে প্রাসাদোপম এক ভবন নির্মাণ করেন। তিনি ১৯১৪ সালে পার্নিসাস ম্যালেরিয়া জ্বরে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃতদেহ ঝিনাইদহ এসে পৌঁছালে ঝিনাইদহের সকল অফিস আদালত বন্ধ হয়ে যায়। শোকাভিভূত হাজার হাজর মানুষ তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নবগঙ্গা নদীর তীরে উপস্থিতত হয়। ঝিনাইদহ শহরে তার নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে।

যেভাবে যাবেনঃ

ঝিনাইদহ হতে স্থানটির দুরত্ব ২৮-৩০ কিঃ মিঃ। ঝিনাইদহ হতে বাসযোগে সড়ক পথে বারবাজার যেতে হবে। এরপর বারবাজার হতে হতে( পূর্ব দিকে) ভ্যানযোগে গাজীকালু চম্পাবতীর মাজারে যেতে হবে। বারবাজার হতে মাজারের দুরত্ব ১ কিঃ মিঃ । বারবাজার মেইন ষ্ট্যান্ড থেকে পূর্ব দিকে ৯নং ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই অবস্থতি এই মাজার শরীফ। মাত্র ৫ টাকা ভ্যান অথবা করিমন ভাড়া দিয়ে আপনি যেতে পারেন।


Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.