প্রতীকী ছবি।
প্রথমে মেইল পাবেন, এরপর সুবিধাজনক সময়ে নারী কণ্ঠে একটি কল; আপনাকে মোবাইলের ক্ষুদে বার্তা অপশন থেকেও নক করা হবে। বারবার জানতে পারবেন- কিভাবে অতি সহজে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পরিবার নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করা যায়। কিভাবে আমেরিকা বা ইউরোপের স্বপ্নের দেশের হাতছানি আপনাকে প্রলুব্ধ করবে বুঝতেই পারবেন না। সম্প্রতি এমনি এক মহা প্রতারকের খপ্পরে পড়েছে শত শত এমনকি হাজার মানুষ। সব মিলিয়ে ছাড়িয়ে যায় লাখ।
হু হু করে জমা পড়ছে আবেদন। প্রতিটি আবেদনের জন্য ফি হিসেবে নেয়া হচ্ছে ২ হাজার ১০০ টাকা। ‘ইউএসএ ট্যুর ফেয়ার’-এর তথ্য অনুযায়ী, গত ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত দুই লাখের বেশি মানুষ আবেদন করেছেন। এ তথ্য সঠিক হলে অন্তত ৪২ কোটি টাকা জমা দিয়েছেন আবেদনকারীরা।
‘ডিভি লটারির মতোই ‘ইউএসএ লটারি’ ফরমটি সঠিকভাবে ফিলআপ করে সাবমিট করুন এবং আপনার আবেদন সম্পূর্ণ করে আমেরিকায় স্থায়ী বসবাস করুন।’
‘ইউএসএ ট্যুর ফেয়ার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অনলাইনে চালানো হচ্ছে এমন প্রচার। তাদের দাবি, আবেদনকারীদের মধ্যে বিজয়ীদের বেছে নিতে ৩০ এপ্রিল রাত ১০টায় ঢাকায় ওয়েস্টিন হোটেলে অনুষ্ঠিত হবে ড্র। এরপর দুটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হবে আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পাওয়া নির্বাচিতদের তালিকা।
এই ঘোষণায় সাড়া দিয়ে হু হু করে জমা পড়ছে আবেদন। প্রতিটি আবেদনের জন্য ফি হিসেবে নেয়া হচ্ছে ২ হাজার ১০০ টাকা। ‘ইউএসএ ট্যুর ফেয়ার’-এর তথ্য অনুযায়ী, গত ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত দুই লাখের বেশি মানুষ আবেদন করেছেন। এ তথ্য সঠিক হলে অন্তত ৪২ কোটি টাকা জমা দিয়েছেন আবেদনকারীরা।
তবে ঢাকায় আমেরিকান দূতাবাসের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, এ ধরনের কোনো প্রোগ্রাম যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নেই। এভাবে আয়োজিত লটারি জিতে আমেরিকায় স্থায়ী আবাস গড়ারও কোনো সুযোগ নেই। আর ওয়েস্টিন হোটেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে তাদের হল বুকিং বাতিল করা হয়েছে। বুকিং বাতিল হওয়ার পর ‘ইউএসএ ট্যুর ফেয়ার’ তাদের ফেসবুক পেজে আগের ঘোষণায় পরিবর্তন এনে অনলাইনে লটারির ফল ঘোষণার কথা জানিয়েছে।
ইউএসএ ট্যুর ফেয়ার নামের ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের লটারির প্রচার চালানো হচ্ছে। ওয়েবসাইটে ঢুকলে লটারিতে অংশ নিতে একটি অ্যাপ ডাউনলোড করতে বলা হয়।
গুগল প্লে স্টোরে ‘ইউএসএ ট্যুর ফেয়ার’ নামেই অ্যাপটি রয়েছে। ইউএসএ ট্যুর ফেয়ারের ফেসবুক পেজের তথ্য অনুযায়ী, ১২ এপ্রিল পর্যন্ত ২ লাখ ১৯ হাজার ৮৪৮ বার ডাউনলোড হয়েছে অ্যাপটি। এই অ্যাপের মাধ্যমে পূরণ করতে হয় আবেদন ফরম। এরপর সাবমিটের সময় ফি হিসেবে নেয়া হচ্ছে ২ হাজার ১০০ টাকা।
আবেদনের যোগ্যতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, এসএসসি বা দাখিল পাস, বয়স ১৮ থেকে ৫০ বছর এবং বাংলাদেশের স্থায়ী নাগরিক।
ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে প্রতিষ্ঠানটি দুটি ঠিকানা ব্যবহার করছে। একটি নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশ প্লাজা, অন্যটি ঢাকার এলিফ্যান্ট রোড।
ঢাকায় ইউএসএ ট্যুর ফেয়ারের যে ঠিকানা দেয়া হয়েছে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সেটি ‘ট্রাস্ট ট্যুর ট্রাভেলস অ্যান্ড কনসালটেন্সি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এলিফ্যান্ট রোডের কাঁটাবন মোড়ের কাছে খাইরুন নেসা ম্যানশনের তৃতীয় তলায় একটি কক্ষে পার্টিশন দিয়ে তিনটি জায়গা আলাদা করা হয়েছে। প্রথম অংশে রিসিপশন, মাঝেরটিতে গ্রাহকদের সঙ্গে আলোচনার জায়গা, আর অন্য অংশ প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টরের জন্য নির্ধারিত।
প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ মিজানুর রহমান কিাছে দাবি করেন, লটারির বিষয়টি পুরোপুরি দেখভাল করছে আমেরিকান প্রতিষ্ঠান ‘ইউএসএ ট্যুর ফেয়ার’। বাংলাদেশ থেকে আবেদনকারীদের সুবিধার্থে ট্রাস্ট ট্যুর ট্রাভেলস অ্যান্ড কনসালটেন্সির সঙ্গে ইউএসএ ট্যুর ফেয়ারের চুক্তি হয়েছে। ছয় মাস আগে এই চুক্তি হয়। তিনি বলেন, ‘যারা তথ্য জানতে আসছে, আমরা শুধু তাদের তথ্য দিয়ে সহায়তা দিচ্ছি। পুরো মেকানিজম রয়েছে আমেরিকায়।’ কত আবেদন পড়ল- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গত ১৮ এপ্রিল আমরা জানতে পেরেছি ইতোমধ্যে দুই লাখের বেশি মানুষ আবেদন করেছেন।’
তিনি দাবি করেন, ‘ইউএসএ ট্যুর ফেয়ার’ বহু বছর ধরেই এভাবে লটারির মাধ্যমে বাংলাদেশি নাগরিকদের আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ দিচ্ছে।
ট্রাস্ট ট্যুর ট্রাভেল অ্যান্ড কনসালটেন্সি লিমিটেডের ডিরেক্টর জাহিদ হোসাইন দাবি করেন, ইউএসএ ট্যুর ফেয়ার সাত বছর ধরে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
‘ইউএসএ ট্যুর ফেয়ার’-এর ওয়েবসাইটের ডোমেইন কেনা হয় গত জানুয়ারিতে তবে যাচাই করে দেখা গেছে, ইউএসএ ট্যুর ফেয়ারের ওয়েবসাইটটি গত জানুয়ারিতে তৈরি। ওয়েবসাইটের ডোমেইন কেনা হয় ১৬ জানুয়ারি। আর যে ফেসবুক পেজ থেকে প্রচার চালানো হচ্ছে সেটি তৈরি হয়েছে ২২ জানুয়ারি। আবেদনের অ্যাপটি গুগল প্লে স্টোরে উন্মুক্ত হয় ১৩ ফেব্রুয়ারি।
আমেরিকা থেকে লটারির পুরো কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার দাবি করা হলেও ফেসবুক পেজে দেখা গেছে, যে চার ব্যক্তি পেজটি পরিচালনা করছেন তাদের অবস্থান বাংলাদেশে।
‘ইউএসএ ট্যুর ফেয়ার’-এর অ্যাপ ২ লাখের বেশি ডাউনলোড হয়েছে। আমেরিকার বাংলাদেশ প্লাজায় অফিসের ঠিকানা ব্যবহার করেছে ‘ইউএসএ ট্যুর ফেয়ার’।
ট্রাস্ট ট্যুর ট্রাভেল অ্যান্ড কনসালটেন্সি লিমিটেডের ডিরেক্টর জাহিদ হোসাইনের দাবি, ঢাকায় তাদের প্রতিষ্ঠানও সাত বছর ধরে ভিসা প্রসেসিংয়ের কাজ করছে।
একই মালিকানায় ইউএসএ ট্যুর ফেয়ার পরিচালিত হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চারজন আছেন মালিকানায়। আমিও আছি। বাকিদের মধ্যে ওখানকার আইনজীবী ও অন্য পেশায় জড়িত ব্যক্তি আছেন।’
জাহিদ হোসাইন বলেন, ‘আবেদনকারীদের মধ্যে যারা লটারিতে বিজয়ী হতে পারবেন না তারা ২ হাজার ১০০ টাকা ফেরত পাবেন। তবে সেটা সরাসরি ক্যাশে নয়। ট্রাস্ট ট্যুর ট্রাভেল অ্যান্ড কনসালটেন্সি লিমিটেড থেকে সেবা নিতে হবে। ওই সেবার যে ফি আসবে, সেখান থেকে ২ হাজার ১০০ টাকা ছাড় দেয়া হবে।
‘আমরা ভিসা প্রসেসিংয়ের কাজ করে থাকি। আবেদনকারীদের কেউ ভিসা প্রসেসিংয়ের কাজ করালে যে ফি আসবে সেখান থেকে লটারির আবেদন ফি ২ হাজার ১০০ টাকা ছাড় দেয়া হবে।’
‘ট্রাস্ট ট্যুর ট্রাভেলস অ্যান্ড কনসালটেন্সি’র কর্মকর্তারা জানান, ৩০ এপ্রিল রাতে রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে লটারির ড্রয়ে বিজয়ী ১০০ জনকে বেছে নেয়া হবে। তাদের মধ্যে ১০ জন আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পাবেন। বাকি ৯০ জন বিজয়ীকে বিভিন্ন দেশে ঘুরিয়ে আনা হবে।
তবে হোটেল ওয়েস্টিন ক্যাটারিং সেলস বিভাগের সহযোগী পরিচালক মুনিরুল কবির জানান, তারা ‘ইউএসএ ট্যুর ফেয়ার’-এর বুকিং বাতিল করেছেন। তিনি শনিবার বলেন, ‘লটারি দিয়ে আমেরিকা নিয়ে যাবে, এমন একটি ইভেন্টের রিজার্ভেশন ছিল। তবে ইভেন্টটির বিষয়ে খোঁজখবর নেয়ার পর হোটেলের সুনাম রক্ষার্থে আমরা তা বাতিল করেছি।’
অন্যদিকে ঢাকায় আমেরিকান দূতাবাসের এক কর্মকর্তা জানান, এভাবে লটারিতে বিজয়ী হয়ে আমেরিকায় স্থায়ীভাবে থাকার কোনো সুযোগ নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ডিভি লটারি থেকে বাংলাদেশের নাম অনেক আগেই বাদ পড়েছে। আর ইউএসএ লটারি নামে আমেরিকান সরকারের কিছু নেই। প্রতারণার উদ্দেশ্যে অনেকে এ ধরনের নাম ব্যবহার করে।’
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh