× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

বাংলাদেশ কি গণতন্ত্রের অভিভাবককে হারালো?

ড: তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব, দাউদ ইব্রাহিম হাসান

৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬:২৪ পিএম

ছবি: ফাইল।

"হে অকুতোভয় জননী, তুমি কি কেবল একটি নাম? না, তুমি এই মানচিত্রের হৃদস্পন্দন, তুমি শৃঙ্খলিত গণতন্ত্রের সেই বিদ্রোহী আর্তনাদ যা অন্ধকার চিরে আমাদের পথ দেখাত; তোমার বিদায় মানে আকাশের ধ্রুবতারা নিভে যাওয়া নয়, বরং একটি জাতির ছাদহীন হয়ে পড়া—আজ বাংলার মাটিও ডুকরে কাঁদছে তোমার শূন্যতায়!"

আজ ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫। শীতের এই বিষণ্ণ সকালটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে কোনো সাধারণ দিন নয়, বরং এক অনন্ত বিরহের মহাকাব্য। যে সংবাদটি শোনার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না, সেই চরম সত্যটি আজ আমাদের কানে বিঁধছে মারণাস্ত্রের মতো—আমাদের প্রিয় নেত্রী, তিনবারের সাবেক সফল প্রধানমন্ত্রী এবং এই প্রজন্মের সবচেয়ে বড় বিদ্রোহী কণ্ঠস্বর বেগম খালেদা জিয়া আর আমাদের মাঝে নেই। রাজধানীর সেই নিভৃত কেবিনে যখন তাঁর ক্লান্ত চোখ দুটি চিরতরে বুজে গেল, তখন মনে হলো বাংলাদেশের মানচিত্রের এক বিশাল অংশ যেন মুহূর্তেই ধূসর হয়ে গেল। ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জলপাইগুড়ির মাটিতে যে মহীয়সী নারীর জন্ম হয়েছিল, আজ তাঁর বিদায়বেলায় পুরো জাতি যেন এক এতিম সত্তায় পরিণত হয়েছে।

আমরা যদি ইতিহাসের সেই ধূলিমলিন পাতাগুলো উল্টাই, তবে দেখব এক সাধারণ গৃহবধূর অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প। বাবা ইস্কান্দার মজুমদার আর মা তৈয়বা মজুমদারের সেই ছোট্ট মেয়েটি শৈশব কাটিয়েছেন দিনাজপুরের শান্ত স্নিগ্ধতায়। ১৯৬০ সালে সেনাসদস্য জিয়াউর রহমানের সাথে ঘর বাঁধার পর তাঁর জীবন ছিল এক নিভৃতচারী নারীর। কিন্তু ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের সেই অভিশপ্ত ভোর তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। স্বামীহারা এক নারী শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি হাতে তুলে নিলেন রাজনীতির ঝাণ্ডা। ১৯৮৪ সালের ১০ মে যখন তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির চেয়ারপারসন হলেন, তখন থেকে শুরু হলো এক হার না মানা সংগ্রামের দীর্ঘ পথ। সেই যে ঘর ছেড়ে রাজপথে নামলেন, এরপর দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সাতবার গৃহবন্দি আর কারান্তরীণ হয়েও তিনি এক চুল নড়েননি তাঁর আদর্শ থেকে। বাঙালি জাতি সেদিন তাঁর কাছ থেকেই প্রথম শিখেছিল—মাথা নত না করাই হলো আসল স্বাধীনতা।

প্রামাণ্য তথ্যগুলো আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়, ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ তিনি যখন বাংলাদেশের প্রথম এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন, তখন থেকেই আধুনিক বাংলাদেশের প্রকৃত বুনন শুরু হয়। আজ আমরা যে সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বলি, তার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছিল তাঁরই হাত ধরে। ১৯৯৩ সালে যখন তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করলেন এবং ছাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষার পথ খুলে দিলেন, তখন তিনি আসলে এ দেশের কয়েক কোটি নারীর ভাগ্যের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। আজ যে মেয়েটি সমাজের উঁচু পদে আসীন, তাঁর সেই সাফল্যের মূলে রয়েছে বেগম জিয়ার সেই দূরদর্শী শিক্ষা নীতি। এখান থেকে জাতি লাভ করল এক অনন্য মেরুদণ্ড, যা আজ বিশ্বের বুকে আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করছে।

কিন্তু নিয়তির কি নিষ্ঠুর পরিহাস! যে নারী সারাজীবন মানুষের গণতন্ত্রের জন্য লড়লেন, জীবনের শেষ এক দশকে তাঁকে লড়তে হলো চরম অবমাননা আর একাকিত্বের সাথে। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি যখন তাঁকে নির্জন কারাগারে পাঠানো হলো, তখন থেকেই শুরু হয়েছিল এক অমানবিক যন্ত্রণার অধ্যায়। সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর, তারপর আবার ৭ বছর—এই সংখ্যাগুলো আসলে তাঁর শরীরের ওপর নয়, বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ওপর চালানো নিষ্ঠুরতার প্রতীক। এভারকেয়ার হাসপাতালের কেবিনে যখন তিনি লিভার সিরোসিস আর হার্ট ব্লকের যন্ত্রণায় ছটফট করতেন, তখনও তাঁর চিন্তা ছিল দেশ আর দেশের মানুষকে নিয়ে। তাঁর দুই সন্তান তারেক রহমান আর আরাফাত রহমান কোকোর নির্বাসন এবং ২০১৫ সালে কোকোর অকাল মৃত্যু তাঁর মাতৃহৃদয়কে যে কতটা ক্ষতবিক্ষত করেছিল, তা ভাবলে আজও প্রতিটি বাঙালির বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। বাঙালি জাতি তাঁর এই ব্যক্তিগত ত্যাগের বিনিময়ে লাভ করেছে এক অবিচল অভিভাবক, যিনি শিখিয়েছেন দেশপ্রেমের জন্য কত বড় মূল্য দিতে হয়।

২০১৫ থেকে ২০২৫ সালের এই দীর্ঘ কালখণ্ডে বাংলাদেশ হারিয়েছে তার প্রাণস্পন্দন। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার যে জোয়ার বইছিল, তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন এই একা এক নারী। ২০২৫ সালের এই বিদায়বেলায় দাঁড়িয়ে আমরা অনুভব করছি, তাঁর সময়ে যে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আর সামাজিক নিরাপত্তার বুনন ছিল, তা আজ কেবল স্মৃতি। ২০৩০ বা ২০৪০ সালের যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন আমাদের দেখানো হয়, তার ভিত্তি তো তিনি গেঁথে দিয়েছিলেন ১৯৯১ সালেই, যখন বেসরকারি খাতের শিল্পায়নের জোয়ার শুরু হয়েছিল। পোশাক শিল্পের যে মহীরুহ আজ আমাদের গর্ব, তার প্রথম চারাটি রোপণ করেছিলেন এই জননীই। বাঙালি জাতি তাঁর অর্থনৈতিক দর্শন থেকে লাভ করেছে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার সাহস।

আজকের এই যান্ত্রিক যুগে আমরা যে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল ভোগ করছি, তার সূত্রপাত হয়েছিল বেগম জিয়ার আমলেই—যখন তিনি তথ্যপ্রযুক্তির ওপর থেকে শুল্ক তুলে নিয়েছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে সাবমেরিন ক্যাবল নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার সেই সাহসী পদক্ষেপটিই আজ হাজার হাজার ফ্রিল্যান্সার আর উদ্যোক্তার অন্নের সংস্থান করছে। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে মিশে ছিল মাটির ঘ্রাণ—যমুনা সেতুর সমাপ্তি থেকে শুরু করে পল্লী বিদ্যুতায়ন পর্যন্ত সবখানেই তাঁর হাতের মমতা মাখানো স্পর্শ লেগে আছে। আজ তিনি নেই, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া এই উন্নয়নগুলোই এখন ১৬ কোটি মানুষের অন্ন জোগাচ্ছে।

বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্থান মানে একটি মহাকাব্যের শেষ পাতাটি ছিঁড়ে যাওয়া নয়, বরং একটি অবিনাশী আদর্শের জন্ম হওয়া। তিনি মরেও বেঁচে থাকবেন প্রতিটি জাতীয়তাবাদী হৃদস্পন্দনে। যে মাটি থেকে তিনি উঠে এসেছিলেন, সেই মাটির কোলেই আজ তিনি পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকবেন। তাঁর প্রয়াণে বাংলাদেশ যে অমূল্য এক খনিকে হারাল, তার শূন্যতা পূরণ করার সাধ্য এই মহাকালেরও নেই। হে মাদার অব ডেমোক্রেসি, আপনি শান্তিতে ঘুমান। আপনার অজেয় হাসি ছিল আমাদের ভরসা, আর আপনার নীরবতা ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। আপনি শিখিয়ে গেছেন, শাসক পালালেই ফ্যাসিবাদ যায় না, যদি না মানুষ মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে শেখে।

"শোনো রে বাঙালি, যে মা শিখিয়েছিলেন মাথা নত না করার দম্ভ, তিনি আজ চলে গেলেন এক বুক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে; আমাদের প্রতিটি চোখের জল যেন শপথ হয়ে ফিরে আসে প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, কারণ শহীদের রক্ত আর মায়ের চোখের জল কখনো বিফলে যায় না!"




সংক্ষিপ্ত জীবনী :

 

ডঃ তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব, বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইমপ্যাক্ট গ্রুপে গ্লোবাল কনসালট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন। দাউদ ইব্রাহিম হাসান, বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত থাকার পাশাপাশি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় একজন রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট হিসেবে নিয়োজিত থাকার পাশাপাশি আইডিএলসি ফাইনান্স পিএলসি-তে মার্কেটিং বিভাগে কর্মরত আছেন। 

Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2026 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.