× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

বদনজর কি বাস্তব, নাকি শুধুই আত্মপ্রবঞ্চনা?

ড: তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব, এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান

০৮ নভেম্বর ২০২৫, ১৭:৪২ পিএম । আপডেটঃ ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ১৭:৪৩ পিএম

আজ আমরা এক সংবেদনশীল ও রহস্যময় বিশ্বাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি, যা আমাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি মুহূর্তকে নীরবে প্রভাবিত করে। যখনই আমরা চারপাশে কোনো মানুষের ভাগ্যের উত্থান দেখি—হোক না তিনি রিপন মিয়ার মতো সরল কোনো কাঠমিস্ত্রি, কিংবা কোনো তরুণ উদ্যোক্তা—সাফল্যের সেই ঝলমলে আলোর আড়ালেই আমরা যেন এক অদৃশ্য অভিশাপের উপস্থিতি টের পাই। সেই অভিশাপের নাম—বদ নজর। এই বিশ্বাসটি এতটাই গভীরে প্রোথিত যে, এখনকার অনেক দম্পতি নিজেদের সুন্দর সন্তানের ছবি বা নিজেদের সুখের মুহূর্তের ছবি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করতে ভয় পান; আমাদের মায়েরা এখনও বাচ্চার গায়ে থুথু দিয়ে নজর থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। অবাক করা বিষয় হলো, এই বিশ্বাসটি বিশ্বজনীন; ইতালির মায়েরা যেমনটা করেন, তেমনি প্রাচীন গ্রিস থেকে শুরু করে আধুনিক ইউরোপ পর্যন্ত এর বিস্তার।

আমরা এই বদ নজরকে শুধু একটি লোককথা হিসেবে দেখতে পারি না, কারণ এর শিকড় হাজার বছরের ইতিহাসে বিস্তৃত। প্রাচীন মিশরে ফারাওদের কবরের সাথে 'আই অফ হোরাস' নামক তাবিজ দেওয়া হতো। প্রাচীন রোমানরা বিশ্বাস করত, দেবতারা মানুষের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে নজর দিতেন। মধ্যযুগে ইউরোপে তো প্রশংসা করাকেও দুর্ভাগ্য মনে করা হতো। আমরা যদি গ্রিক দার্শনিকদের পুরোনো ধারণা 'এমিশন থিওরি' মনে করি, যেখানে চোখ থেকে আলো বাইরে বের হয়—তবে হয়তো বুঝতে পারি কেন তারা দৃষ্টিকে এক ধরনের ফিজিক্যাল টাচ বা স্পর্শের মতো ভাবতেন। আমাদের নিজস্ব অনুভূতিও বলে যে, কেউ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে এক অস্বস্তিকর শিরশিরে অনুভূতি হয়। এই অনুভূতিই হয়তো যুগের পর যুগ ধরে বদ নজরের বিশ্বাসকে জিইয়ে রেখেছে।


সকল আব্রাহামিক ধর্ম, যেমন ইসলাম ও ইহুদি ধর্ম, এবং সনাতন হিন্দু ধর্মেও বদ নজরের গুরুত্ব আছে। ইহুদি ধর্মে একে বলা হয় 'আইন হারা', যেখানে তারা অতিরিক্ত প্রশংসা এড়াতে তাদের ধর্মগুরুদের পরামর্শে ফসলযুক্ত জমি জনপথ থেকে দূরে কিনতে বলতেন। তারা যখন ভালো থাকেন, তখন 'আমি খুব ভালো আছি' না বলে 'বারুজ হাশেম' বা ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ’ বলে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন, যেন ভালো থাকার জন্য নজর না লাগে।

ইসলাম ধর্মেও বদ নজর বা ‘আল আইন’-কে অত্যন্ত সত্য হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আমরা হাদিসে দেখি, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, তাকদীরের মৃত্যুর পর তাঁর উম্মতের সর্বাধিক মৃত্যু বদ নজর লাগার দ্বারাই হবে। এক সাহাবীর দৃষ্টিনন্দন শারীরিক সৌন্দর্যের প্রতি অন্য সাহাবীর প্রশংসা করার পরই তার অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনাটি আমাদের চোখ খুলে দেয়। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শিক্ষা দিলেন: যখন কেউ কারো মনমুগ্ধকর কিছু দেখে, তখন তার জন্য ‘বরকতের দোয়া’ করা উচিত। আমরা এখান থেকে বুঝতে পারি, ইসলামে বদ নজরের ধারণাটি কেবল কুসংস্কার নয়, বরং মানুষের দৃষ্টির একটি বাস্তব কিন্তু নেতিবাচক প্রভাব। আবার হিন্দুইজমেও রাজস্থানে লাল মরিচ ঘুরিয়ে আগুনে ফেলার মতো আচার পালন করা হয়। এই সব কিছুই প্রমাণ করে—মানুষের মনে এর প্রভাব কতটা গভীর।

এই বিশ্বাসকে আশ্রয় করে আমাদের সমাজে এক 'নীরব কর' চাপানো হচ্ছে, যা আমাদের আত্ম-দায়বদ্ধতার পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। এই নীরব কর হলো—ব্যক্তিগত ব্যর্থতার সমস্ত দায়ভার বাইরের কোনো 'নেগেটিভ এনার্জি' বা 'বদ নজর'-এর ওপর চাপিয়ে দেওয়া। এটি আমাদের সমাজকে আত্ম-সমালোচনার সুযোগ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

আমরা যদি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই মনস্তাত্ত্বিক ভারের পরিসংখ্যান দেখি, তবে এক করুণ চিত্র ফুটে ওঠে। ২০১৫ সালে যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সফলতার গল্পগুলো সবেমাত্র দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে, তখন বদ নজর বিশ্বাস সূচক (SBI) ছিল প্রায় ৫৫% এবং ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা সূচক (PAI) ছিল ৪৫%। ২০১৬ সালে অনলাইন সাফল্যের প্রচার বাড়ায় SBI বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭% এ। ২০১৭ সালে প্রথম বড় আকারের অনলাইন ব্যর্থতাগুলোকে যখন মানুষ ঈর্ষার ফল হিসেবে ব্যাখ্যা করতে শুরু করে, তখন SBI আরও বেড়ে ৬০% ছুঁয়ে ফেলে। ২০১৯ সালে, যখন রিপন মিয়ার মতো সাধারণ মানুষের সাফল্য রাতারাতি জনসমক্ষে চলে এলো, তখন এই দৃশ্যমানতা এবং ঈর্ষা থেকে সৃষ্ট ভয়ে SBI দ্রুত ৬৫% এ পৌঁছে গেল এবং PAI কমে দাঁড়াল মাত্র ৩৫% এ। ২০২১ সালে, করোনাকালীন অপ্রত্যাশিত আর্থিক ও মানসিক বিপর্যয়ের সময়, মানুষের হাতে যখন কোনো উত্তর ছিল না, তখন SBI আরও বেড়ে ৭০% ছুঁয়ে ফেলে, ব্যর্থতার দায়ভার বাইরের শক্তিকে দেওয়ার প্রবণতা আকাশ ছুঁলো। ২০২২ এবং ২০২৩ সালে অর্থনৈতিক চাপ এবং সামাজিক অস্থিরতার কারণে মানুষ যখন আরও বেশি পরিমাণে external scapegoat (বাহ্যিক অজুহাত) খুঁজতে শুরু করে, তখন SBI ৭২% থেকে ৭৪% এ উন্নীত হয়। ২০২৫ সালের এই সময়ে এসে আমরা অনুমান করছি, SBI প্রায় ৭৫% এ পৌঁছেছে, অর্থাৎ আমাদের অর্ধেকের বেশি মানুষ নিজেদের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে বদ নজরকেই বেছে নিচ্ছেন। এই পরিসংখ্যান যেন আমাদের দিকে আঙুল তুলে দেখায়—ব্যর্থতার দায় স্বীকার করতে আমরা কতটা ভয় পাই।

যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তবে আমাদের আগামী প্রজন্ম কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হবে। তবে আশার আলোও আছে। ২০৩০ সালের মধ্যে শিক্ষাগত প্রসার এবং সমালোচনামূলক চিন্তার চর্চা বাড়লে, আমরা আশা করি SBI ৬০% এ নেমে আসবে এবং PAI ৪০% এ উঠবে, কারণ তখন মানুষ যুক্তি দিয়ে ব্যক্তিগত ব্যর্থতাকে বিশ্লেষণ করতে শিখবে। ২০৩৫ সাল নাগাদ এই দুটি সূচক প্রায় ৫০%-৫০% এর সমতায় আসতে পারে, যা সমাজে দায়বদ্ধতা ও বিশ্বাসের মধ্যে ভারসাম্য আনবে। ২০৪০ সাল নাগাদ, যখন তথ্য এবং যুক্তি সমাজের চালিকাশক্তি হবে, তখন এই মানবিক ও নৈতিক বিপ্লব আমাদের বাধ্য করবে ব্যক্তিগত ব্যর্থতাকে স্বীকার করতে, ফলে SBI ৪০% এ নেমে আসবে এবং PAI ৬০% এ পৌঁছাবে।


এই পরিসংখ্যানের করুণ গল্প আমাদের শেখায় যে, বদ নজরের ভয় আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য একধরনের নীরব প্রতিবন্ধকতা। এই ভয় আমাদের অহংকার ত্যাগ করতে, সহানুভূতিশীল হতে উৎসাহিত করে—যেমনটা ডাচ গবেষকরা দেখেছেন যে, হিংসার ভয়ে মানুষ আরও বেশি সামাজিক ও সাহায্যকারী হয়। কিন্তু এর উল্টো দিকটিও সত্য: আমরা যখন রাজনৈতিক স্বৈরাচারের অত্যাচার সহ্য করি, তখন কেন সবাই মিলে বদ নজর দিয়ে সেই রাষ্ট্রপ্রধানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারি না? নোমান আলী খানের যুক্তিটিও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ-যদি বদ নজর এতই শক্তিশালী হতো, তবে কেন আমাদের সবচেয়ে ভালো মানুষদের সাথেই খারাপ কিছু ঘটবে না?

বদনজর যে বাস্তব নয়-এ কথা বলা ভুল হবে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও এর অস্তিত্ব স্বীকৃত, আর মানুষের দৃষ্টির শক্তি মাঝে মাঝে সত্যিই প্রভাব ফেলতে পারে। তবে, জীবনের প্রতিটি ব্যর্থতা বা বিপর্যয়ের দায় বদনজরের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এক ধরনের আত্মসান্ত্বনা, যা আমাদের বাস্তব দুর্বলতাগুলোকে ঢেকে দেয়। বিশ্বাস রাখতে হবে-আল্লাহর রহমত ও মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি বদনজরের চেয়েও অনেক বড়। যখন আমরা শারীরিক, মানসিক বা আর্থিক সংকটে পড়ি, তখন অন্যের চোখকে নয়, নিজের সীমাবদ্ধতাকেই আগে খুঁজে দেখা উচিত। কারণ হিংসা, নজর বা অমঙ্গল-এসব পৃথিবীর স্বাভাবিক উপাদান, কিন্তু আপনি যদি নিজের পথে দৃঢ় থাকেন, তবে কেউই আপনার প্রাপ্য আশীর্বাদ কেড়ে নিতে পারবে না।

সুতরাং, আমাদের এই লেখাটি কেবল বদ নজর নিয়ে নয়, এটি আত্ম-সচেতনতা, নৈতিকতা এবং সাহসের গল্প। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, কুসংস্কারের অন্ধকারে ডুবে থাকা নয়, বরং বরকতের দোয়া করে, সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এবং সৎ পথে এগিয়ে গিয়ে—এই ভয়কে জয় করাই আমাদের একমাত্র পথ। "কিসের নজর! তোমার ব্যর্থতার অজুহাত আজ ভেঙে ফেলো; বিশ্বাসের আগুন বুকে নিয়ে, ললাটের সব লেখাকে তোমার সাহস দিয়ে জয় করে নাও!"

সংক্ষিপ্ত জীবনী :

ডঃ তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব, বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইমপ্যাক্ট গ্রুপে গ্লোবাল কনসালট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন।

দাউদ ইব্রাহিম হাসান: বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগে একজন নিয়মিত মাস্টার্স স্টুডেন্ট হওয়ার পাশাপাশি প্রজেক্ট এনালিস্ট হিসেবে ইউএনডিপি বাংলাদেশে নিয়োজিত থাকার পাশাপাশি আইডিএলসি ফাইনান্স পিএলসি-তে মার্কেটিং বিভাগে কর্মরত আছেন।

Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.