আসন্ন
রমজানে রসে ভরা আনারস বেশি দামে বিক্রি করা যাবে- তাই মৌসুমের আগেই বাজারে আনতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক দিয়ে জলডুগী আনারসে পরিপুষ্টের রূপ দেওয়া হচ্ছে। টাঙ্গাইলের মধুপুরের কয়েকজন অসাধু চাষীরা রাসায়নিক ও হরমোন বিষে
ভরা আনারস আসন্ন রমজানে বাজারজাতের মাধ্যমে অধিক মুনাফার লোভে এসব করছেন।
সূত্র জানায়,
আগে থেকে নির্ধারিত বাগানে সদ্য ফোঁটা ফুল, রেণু (গুটি) ও আনারসে প্রতিদিন
পরিচর্যার পাশাপাশি প্রতি সপ্তাহে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ও হরমোন প্রয়োগ
করা হচ্ছে। ফলে ১৮ মাসে পরিপক্ক
হওয়ার আনারস মাত্র পাঁচ থেকে ছয় মাসেই আকারে বড় হয়ে পূর্ণতার
রঙ-রূপ ধারণ করছে।
মধুপুর
গড়াঞ্চলের মাটি সাধারণত দো-আঁশ ও
বেলে দো-আঁশ। উঁচু-নিচু ঢাল থাকায় পানি না জমার কারণে
মধুপুরের মাটি আনরস চাষের জন্য খুবই উপযোগী। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এতদাঞ্চলে প্রতি বছর আনারসের বাম্পার ফলন হয়ে থাকে।
জানা
গেছে, এ এলাকায় সাধারণত
জায়াণ্টকিউ ও হানিকুইন জাতের
আনারসের চাষ বেশি হয়ে থাকে। জায়াণ্টকিউ স্থানীয়দের কাছে ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। হানিকুইন আকারে অনেকটা ছোট, স্থানীয়দের কাছে এটা জলডুগী নামে পরিচিত।
তবে
মৌসুমের কিছুটা পরে আশ্বিন মাসে ফলন হয় বলে ‘আশ্বিনা’
নামে তুলনামূলকভাবে কম স্বাদের আনারসও
আবাদ হয়। এ বছর ফিলিপাইন
থেকে আমদানীকৃত এমডি-২ নামে নতুন
জাতের আনারস চাষাবাদে যুক্ত হয়েছে।
মধুপুরের
আনারস রসালো ও সুস্বাদু হওয়ায়
ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এখানে উৎপাদিত আনারস দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানী করা হচ্ছে। রসে ভরপুর, খেতে সুস্বাদু ব্যাপক সম্ভাবনাময় মধুপুরের আনারস দিন দিন কৃত্রিম রসে পরিণত হচ্ছে।
চারা
থেকে পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে নানা ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক ও হরমোন প্রয়োগে
আনারস দ্রুত পরিপক্ক করার প্রতিযোগিতা চলছে। কৃত্রিমভাবে দ্রুততম সময়ে পাকানো ও দীর্ঘদিন ধরে
সংরক্ষণের জন্য মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর ফরমালিন আনরসে মেশানো হচ্ছে।
প্রতি
বছরের আষাঢ়-শ্রাবণ মাস আনারসের ভরা মৌসুম। এছাড়া আশ্বিন-কার্তিক মাসে তুলনামূলক কম স্বাদের ‘আশ্বিনা’
আনারসের মৌসুম হিসেবে পরিগণিত। তবে ক্ষতিকর রাসায়নিক ও হরমোন ব্যবহার
করে প্রায় সারা বছরই আনারস উৎপাদন করা হচ্ছে।
স্থানীয়রা
জানান, আষাঢ়-শ্রাবণ আনারসের ভরা মৌসুম হলেও এবার চৈত্র মাসে রমজান শুরু হচ্ছে। রমাজনে সাধারণত ফল-মূলের দাম
ও চাহিদা বেশি থাকে।
তাই
আগাম আনারস বাজারে আনতে অনেকেই বাগানে ফরমালিন ও হরমোন প্রয়োগ
করছেন। এজন্য কেউ কেউ আলাদা বাগানও করেছেন। মধুপুর গড়াঞ্চলের সব এলাকায়ই কমবেশি
আনারসের চাষ হলেও মধুপুর ও ঘাটাইল উপজেলায়
সবচেয়ে বেশি আনারসের আবাদ হয়।
সরেজমিনে
মধুপুরের আউশনারা, ইদিলপুর, আলোকদিয়া, অরণখোলা, বেরিবাইদ, জলছত্র, সুবকচনা, হাগুরাকুড়ি, হরিণধরা, জামগাছিয়া, বানরিয়া এলাকার আনারস চাষী, আদিবাসী, মহাজন ও স্থানীয়দের সাথে
কথা বলে জানা যায়, মধুপুর গড়াঞ্চলে নানা প্রজাতির আনারসের চাষাবাদ হয়। এখানকার উৎপাদিত আনারস স্থানীয় ও দেশীয় চাহিদা
মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়।
মধুপুরের
লটপাড়ার আনারস চাষী শফিকুল ইসলাম, হাগুরাকুড়ির আবুল কালাম, জমির ডাক্তার, আলম মিয়া, তোতা মিয়া, নওগাইলের খোকন মিয়া, রাঘামারীর সাইদুল ইসলাম, হরিণধরার হায়দার আলী মেম্বার, সুবকচনার মোঃ ইব্রাহিম হোসেন, সাইদুল আলম, জামগাছিয়ার রেহান উদ্দিন সহ অনেকেই জানান,
মধুপুর এলাকার আনারস আবাদের ভূমিগুলো মূলত বন বিভাগের।
আদিবাসীরা
বনের জায়গা দখল করে প্রথমে নিজেরা আবাদ শুরু করে। পরে ওই জমি ২,
৩, ৫ ও ১০
বছরের জন্য বাঙালিদের কাছে বর্গা দেয়। কেউ কেউ বেশি টাকা পেয়ে ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তির মাধ্যমে বিক্রিও করে দেয়। সেই সব জমিতে বাঙালি
মুসলমানরা চাষাবাদ শুরু করে কেউ কেউ বাসিন্দা বনে যান।
তারা
জানান, অতি মুনাফালোভীরা আসন্ন রমজানকে সামনে রেখে আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করেছে। সাধারণত আনারস পরিপক্ক হতে অন্তত ১৮ মাস সময়
লাগে। বেশি লাভের আশায় ৫-৬ মাসের
মধ্যে রমজানে বাজারজাত করতে আনারস বাগানে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ও হরমোন ব্যবহার
করা হচ্ছে।
তাদের
দেওয়া তথ্যমতে, অল্প সময়ে আনারস বড় ও পাকানোর
জন্য কয়েকটি ধাপে মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক ও হরমোন প্রয়োগ
করা হয়। এরমধ্যে আনারসে ফুল এলেই বেনসালফিউরণ মিথাইল ও এসিটাক্লোর সমন্বয়ে
গ্রোথ হরমোন স্প্রে করা হয়। প্রকৃতিগতভাবে গাছে ৫৬-৬০ পাতা
হওয়ার পর সাধারণ নিয়মে
আনারস ফল পাওয়া যায়।
অথচ
গাছে ২৮ পাতা হওয়ার
পরই দ্বিতীয় দফায় এক ধরণের ক্ষতিকর
হরমোন ব্যবহার করে অপরিণত গাছ থেকে একপ্রকার কৃত্রিমভাবে ফুল ধরার ব্যবস্থা করা হয়। এ অবস্থাকে স্থানীয়
চাষীরা গাছকে ‘গর্ভবতী’ বলে থাকেন। আনারস গাছে ফুল থেকে রেণু বা গুটি হওয়ার
পর ইথোফেন বা রাইপেন নামক
রাসায়নিক স্প্রে করা হয়। দ্বিতীয়বার ইথোফেন বা রাইপেন স্প্রে
করার মাত্র ৩-৪ দিনেই
আনারস পরিপূর্ণ আকৃতি পায়।
তথ্যমতে,
ইথোফেন বা রাইপেনের সঙ্গে
পটাশ, ফরমালিন, শ্যাম্পু, সিঁদুর, স্পিরিট সহ বিভিন্ন রাসায়নিক
পদার্থ স্প্রে করা হয়। মানব দেহের জন্য বিপজ্জনক এসব রাসায়নিক প্রয়োগের ফলে পতঙ্গ, শিয়াল-কুকুর, বনের বানর-হনুমানও আনারস বাগানের কাছে ঘেঁষতে পারেনা।
অল্প
সময়ে আনারসে রঙ আনার জন্য
তৃতীয় দফায় গাছে ক্ষতিকারক ক্রপকেয়ার, ফ্লোরা, ভিটামিন পিজিআরগোল্ড সহ বিভিন্ন ওষুধ
স্প্রে করা হয়। ১৬ লিটার পানিতে
দুই মিলিলিটার রাসায়নিক মেশানোর নিয়ম থাকলেও ১০০ মিলিলিটার রাসায়নিক প্রয়োগ করা হচ্ছে। সব শেষে বিষাক্ত
ফরমালিন স্প্রে করা হয়। এতে আনারস মনলোভা রঙ ও আকর্ষনীয়
আকার ধারণ করে। তৃতীয় বার স্প্রে করার ১-২ দিনের
মধ্যে বাগান থেকে আনারস কাটা হয়।
বার
বার বাগানে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ও হরমোন প্রয়োগে
আনারসের স্বাদ ও উপকারিতা নষ্ট
হওয়া সম্পর্কে চাষীদের অধিকাংশের কোন ধারণাই নেই। ওষুধ প্রয়োগ নীতি না জেনে তারা
নিজেদের ও অন্যের জীবনকে
ঝুঁকিতে ফেলছেন। কেউ কেউ জেনে-বুঝে অতিলোভে বগানে ওষুধ প্রয়োগ করছেন।
আনারস
চাষীদের মতে, চারা রোপনের পর গাছ থেকে
ফুল বের হওয়ার আগে প্রথম রাসায়নিক দিতে হয়। এর ২০-২২
দিন পর আবার স্প্রে
করতে হয়। রেণু বা গুটি হওয়ার
পর দ্বিতীয়বার এবং এর দেড় মাস
পর ফল পাকানোর জন্য
রাসায়নিক স্প্রে করতে হয়।
আনারস
বড় করার জন্য তারা সাধারণত প্লানোফিক্স, সুপারফিক্স, ক্রপসকেয়ার সহ বিভিন্ন রাসায়নিক
প্রয়োগ করে থাকেন। পাকানোর জন্য রাইফেন, হারবেস্ট, প্রমোট, সারাগোল্ড, ইটিপ্লিস, অ্যালপেনসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দেন। দফায় দফায় রাসায়নিক দেওয়ায় অপরিপক্ক হলেও আনারস আকারে বড় হয় ও
হলুদ রঙ হয়ে পেকে
যায়।
মাত্রাতিরিক্ত
রাসায়নিক প্রয়োগকারী চাষীরা নাম প্রকাশ না করে জানায়,
তারা আগে রাসায়নিকমুক্ত আনারস চাষ করে লোকসান গুনেছেন। ভোক্তা পর্যায়ের ক্রেতারা দেখতে রসালো, মনলোভা হলুদ রঙের আনারস বেশি কিনে থাকে।
রাসায়নিকমুক্ত
আনারস অনেকটা কাঁচা-কাঁচা ধূসর রঙের হয়- দেখতে রসালো দেখায়না। তাই ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। ক্রেতাদের মনতুষ্টি করতে তারা বাধ্য হয়ে রাসায়নিকযুক্ত আনারস চাষ করে থাকেন।
কৃষি
বিভাগ জানান, চলতি বছর মধুপুর উপজেলায় পাঁচ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে আনারসের আবাদ করা হয়েছে। এরমধ্যে হানিকুইন বা জলডুগী, জায়াণ্টকিউ
আনারসের আবাদ সবচেয়ে বেশি। আশ্বিনা জাতের আনারস জায়ণ্টকিউ জাতের চারা বা পরে রোপনকৃত
জলডুগীর চারা থেকেও হয়ে থাকে। জায়াণ্টকিউ জাতের আনারস স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ৭ দিন সংরক্ষণ
করা যায়।
অন্যদিকে
এমডি-২ (সুপার সুইট)
আনারস ২৮ দিন সংরক্ষণে
থাকে। এ কারণে ফিলিপাইনের
আনারস সারাবিশ্বে রপ্তানি করা সম্ভব হয়। সুপার সুইট নামে পরিচিত এমডি-২ আনারস অন্য
আনারসের চেয়ে তিন গুণ বেশি মিষ্টি ও পুষ্টি রয়েছে।
কৃষি
মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এক লাখ চারা
এনে মধুপুর গড়ের ১৭ জন আনারস
চাষীকে দেওয়া হয়েছে। ১৪ থেকে ১৮
মাসের মধ্যে এ জাতের আনারসের
ফলন আশা করছে কৃষি বিভাগ।
টাঙ্গাইল
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আহসানুল
বাশার জানান, মধুপুরের রসেভরা আনারসের কদর বিশ্বব্যাপী। এ বছরে সুপার
সুইট (এমডি-২) নামে নতুন
জাতের আনারস মধুপুরের আনারস চাষে যুক্ত হয়েছে।
প্রকৃতার্থে
রাসায়নিক ব্যবহারের বিষয়টি ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের উপর নির্ভর করে। অতিমাত্রায় রাসায়নিক ও হরমোন প্রয়োগ
বন্ধে নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এসব ওষুধের ক্ষতিকারক দিকগুলো কৃষকদের মাঝে তুলে ধরা হচ্ছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh