ছবিঃ সংবাদ সারাবেলা।
আজ ১৪ এপ্রিল, ১ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ। বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। দিনটি ঘিরে গোটা দেশজুড়ে বইছে উৎসবের আনন্দধারা। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত বাঙালি জাতি আজ এক সুতোয় গাঁথা—সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর ভালোবাসার বন্ধনে।
বাংলা নববর্ষের সূচনার পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে বাংলা সনের প্রচলন হয়। সে সময় হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে খাজনা আদায় করা হতো, যা কৃষিভিত্তিক সমাজের জন্য ছিল বেশ অসুবিধাজনক। এই সমস্যা দূর করতে আকবর হিজরি, সৌর এবং বাংলা সনের সমন্বয়ে এক নতুন পঞ্জিকা প্রবর্তন করেন, যা পরবর্তীতে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিতি পায় এবং ধীরে ধীরে সেটিই হয়ে ওঠে বাংলা বর্ষপঞ্জি। নববর্ষ উদযাপন তখন থেকেই গ্রামীণ সমাজে একটি আনন্দঘন ও অর্থনৈতিক পুনরারম্ভের দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
নববর্ষ বাঙালির জীবনে শুধু একটি তারিখ নয়; এটি আত্মপরিচয়ের বহিঃপ্রকাশ। হালখাতা, পান্তা-ইলিশ, বৈশাখী মেলা, রঙিন পোশাক, বর্ণময় মুখোশ—সব মিলিয়ে এটি হয়ে উঠেছে এক সর্বজনীন উৎসব। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মেতে ওঠে আনন্দে। এটি যেন একদিনের জন্য হলেও বিভাজনের দেয়াল সরিয়ে দিয়ে সবাইকে একত্র করে।
ঢাকার বর্ষবরণ উৎসবের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বর্ণাঢ্য ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। ১৯৮৯ সালে প্রথম এই শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয় চারুকলার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে। উদ্দেশ্য ছিল এক—সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা। শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবনের নানা অনুষঙ্গ, মুখোশ, পাপেট, প্রাণী ও প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি রূপ পায় বর্ণাঢ্য শিল্পকর্মে। এটি আজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো এই শোভাযাত্রাকে ‘মানবতার মৌলিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
আজ সকাল থেকেই চারুকলা অনুষদের প্রাঙ্গণ রঙে রঙিন। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই জমতে থাকে মানুষের ঢল। শুধু ঢাকা নয়—দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে এসেছেন এই আনন্দে অংশ নিতে। ঢাবির উপাচার্য ড. নিয়াজ আহমেদ খান নিজেই শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেন। সঙ্গে ছিলেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষকরা। চারুকলার শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্য, শিশু, কিশোর, বৃদ্ধ—সব বয়সী মানুষের পদচারণায় মুখর পুরো এলাকা।
শোভাযাত্রায় মুখোশ, বাঁশের তৈরি বিশাল বাঘ, পাখি, মাছসহ নানা শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাংলার গ্রামীণ জীবন, প্রকৃতিনির্ভর সংস্কৃতি ও সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। মানুষের পোশাকেও ছিল উৎসবের ছোঁয়া—লাল, হলুদ, সবুজ আর কমলার রঙে সেজেছেন সবাই। নারীদের মাথায় ছিল ফুলের মালা, হাতে রঙিন চুড়ি। শিশুদের মুখে ছিল উচ্ছ্বাস, হাতে পতাকা, মুখে ছোট্ট মুখোশ—সব মিলিয়ে এক অপার আনন্দের আবহ।
এবারের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য—‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। এটি শুধু এক সাংস্কৃতিক বার্তাই নয়, বরং একটি শক্তিশালী সামাজিক উচ্চারণ। শোভাযাত্রাটি চারুকলা থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ, টিএসসি, শহীদ মিনার, দোয়েল চত্বর, বাংলা একাডেমি ঘুরে আবার চারুকলায় এসে শেষ হয়।
নববর্ষ উপলক্ষে শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশেই নেওয়া হয়েছে নানান আয়োজন। রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান দিয়ে শুরু হয় দিনের প্রথম প্রহর। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন, জেলা প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান—সবাই আয়োজন করেছে বৈশাখী মেলা, কবিতা পাঠ, গান, নৃত্য ও নাটকের। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রচার করছে বিশেষ অনুষ্ঠান। রেস্টুরেন্টগুলোতে থাকছে পান্তা-ইলিশের বিশেষ মেনু। পোশাকের দোকানে বৈশাখী কালেকশন নিয়ে রয়েছে বিপুল সাড়া।
এই দিনটিকে ঘিরে ছিল কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থাও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয় নানা ব্যবস্থা, যাতে সবাই নিরাপদে উৎসব উপভোগ করতে পারেন।
বাংলা নববর্ষের এই উৎসব কেবল সময়ের পরিবর্তনের উদ্যাপন নয়—এটি একটি জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐক্যবদ্ধ অস্তিত্বের প্রতীক। প্রতিটি বৈশাখ যেন বয়ে আনে নতুন দিনের আশা, নতুন স্বপ্নের সম্ভাবনা।
শুভ নববর্ষ ১৪৩২। নতুন বছরে হোক জীবন সুন্দর, সমৃদ্ধ ও শান্তিময়।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh