আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুসহ জোড়া খুনের ঘটনায় আদালতে চার্জশিট দিয়েছে মামলার তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবি। চার্জশিটে মোট ৩৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। বিস্তারিত নাম-ঠিকানা না পাওয়ায় অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এক্সেল সোহেল নামে এক যুবককে। চার্জশিটে হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত পরিকল্পনা, অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ, খুনি ভাড়া করাসহ সকল তথ্য উঠে এসেছে।
তবে টিপুর স্ত্রী ফারাজানা আক্তার ডলি অভিযোগ করেছেন, চার্জশিটে মূল পরিকল্পনাকারীদের নাম প্রথম দিকে না রেখে পেছনের দিকে রাখা হয়েছে। এতে আসামিরা আদালত থেকে প্রিভিলেজ নিতে পারে। এছাড়া তারা প্রকাশ্যে ঘুরলেও অনেককে গ্রেফতারও করা হয়নি। অবশ্য তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা তদন্তে যা পেয়েছেন, সেই অনুযায়ী আদালতে লিখিত আকারে জমা দিয়েছেন।
যেভাবে হত্যার পরিকল্পনা হয়
চার্জশিটে বলা হয়েছে, জাহিদুল ইসলাম টিপু একসময় বৃহত্তর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। একই এলাকার আরেক আওয়ামী লীগ নেতা রিয়াজ উদ্দিন মিল্কি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় টিপুর নাম আসলে তিনি দলীয় পদ হারান। পদ হারানোর পরও তিনি একাই মতিঝিল এলাকায় টেন্ডার, ফুটপাত, কাঁচা বাজার, ডিস ব্যবসা, ঠিকাদারি, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে ভর্তি এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। এ কারণে দলীয় পদে থাকা বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে তার বিরোধ ও দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। দলীয় বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা টিপুর কাছ থেকে কোটা ভিত্তিতে আধিপত্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুই শীর্ষ পলাতক সন্ত্রাসী জিসান ও ফ্রিডম মানিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও মতিঝিল এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে।
চার্জশিটে বলা হয়েছে, আসামি গোলাম আশরাফ তালুকদার, মারুফ আহমেদ মনসুর, কামরুজ্জামান বাবুল ওরফে বাবুল তালুকদার, আবুল হোসেন মোহাম্মদ আরফান উল্লাহ, ইমাম খান ওরফে দামাল, নাসির উদ্দিন মানি, সুমন শিকদার ওরফে মুসা, মাহবুবুর রহমান টিটু, জুবের আলম খান ওরফে রবিন ওরফে রেলওয়ে রবিন, আরিফুর রহমান সোহেল ওরফে ঘাতক সোহেল, খাইরুল ইসলাম মাতবর ওরফে খোকা, সোহেল শাহরিয়ার, মারুফ রেজা সাগর, শামীম হোসেন ওরফে মোল্লা শামীম, মোহাম্মদ মারুফ খান ও হাফিজুল ইসলাম ওরফে হাফিজ তাদের সহযোগী মাসুম মোহাম্মদ ওরফে আকাশ, সেকান্দার শিকদার ওরফে আকাশ, ইসতিয়াক আহম্মেদ জিতু, ইমরান হোসেন জিতু, রাকিবুর রহমান ওরফে রাকিব, তৌফিক হাসান বাবু ওরফে বিডি বাবু, আমিনুল ইসলাম ওরফে হাবিব, রিফাত, নাসির উদ্দিন ওরফে কিলার নাসির, ওমর ফারুক, মোরশেদুল আলম পলাশ, আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ, মশিউর রহমান ওরফে ইকরাম, ইয়াসির আরাফাত সৈকত, রানা মোল্লা, সামসুল হায়দার ওরফে উজ্জল ও এক্সেল সোহেলদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে আন্ডারওয়ার্ল্ডের পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহম্মেদ মন্টি ও জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিকের সঙ্গে ভিডিও কলে যোগাযোগ করে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার জন্য বিভিন্ন গোপন বৈঠক করে।
চার্জশিটে বলা হয়েছে, আসামিরা সর্বশেষ পুরানা পল্টনের বায়তুল ভিউ টাওয়ারের বার্ডস আই রুফটপ রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড কনভেনশন হলে বৈঠক করে। ভিডিও কনফারেন্স ও সরাসরি ওই বৈঠকে সবাই জাহিদুল ইসলাম টিপুর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে। প্রথমে সেখানে মতিঝিল এলাকার ঠিকাদারি ও স্কুলে ভর্তি নিয়ে কথা শুরু হয়। ডিস ব্যবসায়ী সাগর বলে তার লোকজন এলাকায় ডিসের সংযোগ দিলে টিপুর লোকজন মারধর করে। সিনিয়রদের প্রতি রাগান্বিত হয়ে সাগর বলে আপনাদের রাজনীতি করে লাভ নাই। আমরা এলাকা ছেড়ে যাবো। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের ভর্তির কথা উঠলে সোহেল শাহরিয়ার বলে টিপু ভাই টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে কিন্তু আমাদের হিসাব দেয় না। জিসান ও মানিক ভাই একশ ছাত্র ভর্তি করাতে বলেছিল, কিন্তু তার কী হলো বলে জানতে চান তিনি। তখন মনসুর জানান, তিনি বিষয়টি নিয়ে টিপুর সঙ্গে কথা বলেছিলেন, কিন্তু টিপু ভর্তির বিষয়ে কথা বলতে চাননি। এক পর্যায়ে সোহেল শাহরিয়ার রিফাতের মোবাইল দিয়ে মানিককে ফোন দিয়ে জিসানকেও কনফারেন্সে নেয়।
অস্ত্র ও অর্থের যোগান
আসামি সুমন শিকদার ওরফে মুসার আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বরাত দিয়ে চার্জশিটে বলা হয়েছে, বৈঠকে টিপুকে হত্যার জন্য ঘাতক সোহেল ৩ লাখ, সাগর ৫ লাখ, রবিন দুই লাখ, বাবুল ৩ লাখ ও টিটু ৫ লাখ টাকা দেবে বলে আলোচনা হয়। এই টাকাগুলো টিপু হত্যাকাণ্ডের জন্য ব্যবহার করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
চার্জশিটে বলা হয়েছে, ওই বৈঠকের এক সপ্তাহ পর বেইলি রোডের ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি দোকানে আরেকটি বৈঠক হয়। সেখানে মুসা, সোহেল শাহরিয়ার, মোল্লা রানা, ঘাতক সোহেল, আমিনুর, শামীম ও রিফাত ছিল। সেখানেও রিফাতের ফোন দিয়ে সোহেল শাহরিয়ার ফ্রিডম মানিককে ফোন দিয়ে অস্ত্রের কথা বলে। মানিক শামীমের কাছে একটা (অস্ত্র) আছে এবং জিসান একটা দেবে বলে জানায়। জিসানকে ফোন দিলে সে তার ছোট ভাই জিতুর অস্ত্রটা শামীমকে দেওয়ার জন্য বলে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয় টিপুকে কলোনিতে (মতিঝিল এজিবি কলোনি) মারা যাবে না। কারণ কলোনিতে মারলে আশরাফ ও মনসুর ফেঁসে যাবে। সিদ্ধান্ত হয়, ওয়ার্ডের বাইরে কাজ করতে হবে। আমিনুল ও ঘাতক সোহেলকে তথ্য সংগ্রহ করে শামীমকে জানানোর জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। রানা মোল্লা, উজ্জল ও এক্সেল সোহেলকে দায়িত্ব দেওয়া হয় মির্জা আব্বাস কলেজের আশেপাশে থাকার জন্য। রিফাতের দায়িত্ব শাহজাহানপুর আমতলা থেকে টিপুর বাসা পর্যন্ত রেকি করা। রিফাতের সঙ্গে সোহেলের লোকজনও থাকবে বলে জানায়। এ সময় সোহেল শাহরিয়ার শামীমকে মোটরসাইকেল কেনার জন্য এক লাখ ও খরচের জন্য এক লাখ টাকা, রানা মোল্লা, আমিনুল ও রিফাতকে খরচের জন্য এক লাখ টাকা করে দেয়।
হত্যাকাণ্ডের সমন্বয় করে মুসা
চার্জশিটে বলা হয়েছে, টিপু হত্যার পরিকল্পনা, অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহের পর হত্যাকাণ্ডটি সমন্বয় করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় সুমন শিকদার ওরফে মুসাকে। মুসা এই হত্যাকাণ্ডটি সুচারুভাবে সম্পাদনের জন্য শামীম হোসেন ওরফে মোল্লা শামীমের সঙ্গে পরিকল্পনা করে। শামীম তার দীর্ঘ দিনের বন্ধু মাসুম মোহাম্মদ আকাশকে শুটার হিসেবে নির্বাচন করে এবং নিজেও সরাসরি থাকার নিশ্চয়তা দেয়।
চার্জশিটে বলা হয়েছে, মুসা জিসানের নির্দেশনা অনুযায়ী ইশতিয়াক আহম্মেদ জিতুর কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল ও একটি ম্যাগাজিন শামীমের কাছে সরবরাহ করে। আরেক আসামি আর্মস মিউজিয়ামের সত্ত্বাধিকারী ইমরান হোসেন জিতু জিসানের নির্দেশে ১৫ রাউন্ড গুলি মারুফ রেজা সাগরকে দেয়। সাগর সেসব গুলি পৌঁছে দেয় শামীমের কাছে। এছাড়া সুমন শিকদার মুসা তার ভাগিনা ইয়াসির আরাফাত সৈকতের মাধ্যমে আরেকটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন ও ১৩ রাউন্ড গুলি সংগ্রহ করে সেকান্দারের মাধ্যমে শামীমের কাছে পৌঁছে দেয়। হত্যাকাণ্ডের পুরো পরিকল্পনা সাজিয়ে ঘটনার ১২ দিন আগে সে দুবাই চলে যায়।
যেভাবে হত্যাকাণ্ড সম্পাদন করে মাছুম ও শামীম
চার্জশিটে বলা হয়েছে, ঘটনার দিন (২৪ মার্চ ২০২২) বিকাল থেকে মাসুম মোহাম্মদ আকাশ ও মোল্লা শামীম তাদের নতুন কেনা মোটরসাইকেল অ্যাপাচি আরটিআর নিয়ে এজিবি কলোনির কাঁচা বাজারে অবস্থান নেয়। টিপুর অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার জন্য তারা রেকি করতে থাকে। এ সময় বিদেশে বসে মুসা মোবাইল ফোনে দিক নির্দেশনা দেয়। মুসা কিলার নাসিরকেও টিপুর অবস্থান নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেয়। কিলার নাসির তার সহযোগী ইকরামকে নিয়ে টিপুর অবস্থান নিশ্চিত করে মুসাকে জানায়। মুসা তা আবার মোল্লা শামীমকে জানায়। টিপু এ সময় তার মালিকানাধীন এজিবি কলোনির গ্র্যান্ড সুলতান হোটেলে অবস্থান করছিলেন। রাত ১০টার দিকে টিপু তার সহযোগীদের নিয়ে মাইক্রোবাসযোগে শাজাহানপুরের বাসার দিকে রওয়ানা দেন। এ সময় মোল্লা শামীম ও মাছুম মোটরসাইকেলযোগে তার পিছু নেয়। টিপুকে বহনকারী মাইক্রোবাসটি উত্তর শাহজাহানপুরের মানামা ভবনের সামনে জ্যামে আটকা পড়লে মোটরসাইকেল থেকে মাছুম নেমে গিয়ে মাইক্রোবাসের কাছে যায়। টিপু মাইক্রোবাসের চালকের পাশের আসনে বসা ছিলেন। মাথায় হেলমেট ও হাতে অস্ত্র নিয়ে মাছুম মাইক্রোবাসের জানালার কাছে গিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করতে শুরু করে। চালক মাইক্রোবাস নিয়ে সামনের দিকে আগানোর চেষ্টা করে। কিন্তু জ্যামের কারণে গাড়িটি আগাতে পারেনি। এলোপাতাড়ি গুলি করতে করতে মাছুম পালিয়ে যায়। তার গুলিতে ঘটনাস্থলে রিকশা আরোহী প্রীতি নামে এক তরুণীও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
যা বললেন টিপুর স্ত্রী
আলোচিত এই খুনের মামলার বাদী ও নিহত টিপুর স্ত্রী ফারাহানা ইসলাম ডলি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যারা দেশে বসে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছে, তাদের অনেককেই পুলিশ গ্রেফতার করেনি। তাদের জন্য দলের লোকজনই তদবির করেছে। আমার স্বামীও আওয়ামী লীগের একজন কর্মী ছিলেন। কিন্তু তারপরও দলের সিনিয়র অনেক নেতার কর্মকাণ্ডে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি।
ফারাহানা ইসলাম বলেন, বিদেশে যারা আছেন, তাদের তো বিচারের মুখোমুখি করা কঠিন। আমি চাই এখন দেশে যারা আছেন, তাদের দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা হোক। কেউ যেন কোনও অনৈতিক সুবিধার মাধ্যমে কোনোভাবে ছাড় না পায়। আমি চাই আসামিদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের প্রথম থেকেই মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ তালুকদার ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর মনসুরের বিষয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে তদবির আসতে থাকে। এছাড়া সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সোহেল শাহরিয়ারকে গ্রেফতার না করতেও উচ্চ পর্যায়ের তদবির করা হয়। অবশ্য সোহেল শাহরিয়ারকে শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হলেও আশরাফ তালুকদার ও মনসুর এখনও অধরা রয়েছেন। জানা গেছে, আশরাফ ও মনসুরের বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের তদবির ও সোহেল শাহরিয়ার একজন পুলিশ কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার কারণে চার্জশিটে তাদের নাম পেছনের দিকে দেওয়া হয়েছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh