× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

প্রত্যন্ত অঞ্চলে অসাধারণ এক জাদুঘরের যাত্রা শুরু

মাহফুজার রহমান মাহফুজ, ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম)

০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৪:৫৩ পিএম

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা গ্রামের সৈয়দ হক মঞ্চের পাশে অবস্থিত বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর। মঞ্চের পাশেই ২০২৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর সৈয়দ হকের ৮৮তম জন্মদিনে কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হকের হাত দিয়ে জাদুঘরটির উদ্বোধন হয়।

বাংলাদেশে বেশকিছু জাদুঘর থাকলেও লেখক জাদুঘর সর্বপ্রথম স্থাপিত হয় ২০১১ সালে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসে। সে সময়ের একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান এর গোঁড়া পত্তন করেন। এরপর স্থাপিত হলো এই বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর। সে দিক থেকে এটা দেশের দ্বিতীয় লেখক জাদুঘর। 

জাদুঘরে যা সংরক্ষিত আছে 

এ জাদুঘরের ৫টি গ্যালারিজুড়ে রয়েছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দুই শতাধিক প্রয়াত কবি লেখকের তথ্য সম্বলিত সুদৃশ্য ছবি। চার দেয়ালে লাগানো ছবিগুলোর নিচে রয়েছে লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। বাংলা সাহিত্য ও বাংলা চলচ্চিত্রের অসংখ্য বিলুপ্ত পত্র-পত্রিকা। এমন কিছু দুর্লভ পত্রিকা রয়েছে যেগুলোর নাম শুনে থাকলেও অনেকের পক্ষে তা চোখেরদেখা হয়নি। 

এ জাদুঘরেই দেখা মিলবে ১৪০ বছর পূর্বের অর্থাৎ ১২৮৯ সালের বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকা এবং ১১০ বছর পূর্বের ১৩২১ সালের প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত পত্রিকা 'সবুজ পত্র'।  মোহাম্মদ আকরাম খাঁ সম্পাদিত ১৯৩৬ সালের মাসিক 'মোহাম্মদী'পত্রিকা। কালীশ মুখোপাধ্যায়ের ১৯৪৫ সালের 'রূপ-মঞ্চ' এবং শ্রীদিলীপ সেন গুপ্ত সম্পাদিত ১৯৫৫ সালের 'সচিত্র ভারতী' পত্রিকা।   

১৯৫৯ সালের সাপ্তাহিক 'পাকিস্তানী খবর' আছে আনোয়ার হুসাইন সম্পাদিত এবং ১৯৫৯ সালের সাপ্তাহিক 'পাক-সমাচার' আছে জয়নুল আবেদীন সম্পাদিত। ধর্মীয় পত্রিকা মাসিক 'নেয়ামত' দেখা যাবে ১৯৬২ সালের, মোহাম্মদ আব্দুস ছালাম সম্পাদিত। সুবোধচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত ১৯৬৩ সালের 'নব-কল্লোল' রয়েছে ফাল্গুন সংখ্যা।  জিনিয়া হোসেন সম্পাদিত 'মাসিক ললনা' দেখা যায় ১৯৬৭ সালের জানুয়ারি ও সেপ্টেম্বর সংখ্যা। ১৯৬১ সালের 'সমকাল' আছে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত। এটি রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী সংখ্যা। ১৯৬৬ সালের 'পূবালী' পত্রিকাসহ 'বেগম' পত্রিকার সংখ্যা আছে পাকিস্তান আমলের বেশ কয়েকটি। আব্দুল কাদির সম্পাদিত ১৯৬৬ সালের মাসিক 'মাহে-নও' সাহিত্য পত্রিকা আছে। আকবর উদ্দীন সম্পাদিত নজরুল একাডেমি পত্রিকার ১৯৬৯ সালের প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যাটি আছে। 'কালি ও কলম' পত্রিকা আছে ১৯৬৮ সালের বিমল মিত্রের এবং ১৯৬৮ সালের দ্বিমাসিক 'পরিক্রম' জুলাই-আগস্ট সংখ্যা আছে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত। আরও আছে ১৯৬৮ সালের রবীন্দ্র ভারতী পত্রিকা, ১৯৬৯ সালের বিশ্বভারতী পত্রিকা এবং ১৯৭০ সালের কবীর চৌধুরী সম্পাদিত বাংলা একাডেমি পত্রিকা। 

রেডিও পাকিস্তানের পাক্ষিক পত্রিকা 'এলান' রয়েছে ১৯৭১ সালের জানুয়ারি ১ম পক্ষের। সত্তুরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর ভোট প্রদানের ছবি দিয়ে সাদাকালো প্রচ্ছদ  দেখা যাবে। 

দুই বাংলার সিনেমার পত্রিকাও রয়েছে অনেক। ১৯৬০ সালের মার্চ সংখ্যা মাসিক 'মৃদঙ্গ'। এম. মুস্তফা সম্পাদিত এ সংখ্যায় জহির রায়হান ও সালাউদ্দিনের অটোগ্রাফ সম্বলিত ঈদের শুভেচ্ছা আছে পাঠকের জন্য। ক্ষিতীশ সরকার সম্পাদিত ১৯৬১ সালের 'জলসা' পত্রিকা আছে । আবু জাফর সম্পাদিত ১৯৬৩ সালের 'সন্দেশ' পত্রিকা, রয়েছে। ১৯৬৫ সালের 'উল্টোরথ' পত্রিকা দেখা যায়  এবং গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ১৯৬৮ সালের 'সচিত্র সন্ধানী' পত্রিকাও রয়েছে।  

একুশের সংকলন রয়েছে বেশ কয়েকটি। এর মধ্যে ১৯৬৯ সালের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগের সংকলন হাবীবুল্লাহ সিরাজী সম্পাদিত 'প্রদাহ'দেখা  যায়। এমন আরও অসংখ্য  মাসিক সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকা রয়েছে যা একজন লেখককে বাংলা সাহিত্যের সুদূর অতীতের মধ্যে ভাসিয়ে নেবে।

'যে জাতি অতীতকে স্মরণ করে না, সে জাতি ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারে না'। -নুরলদীনের সারা জীবন' কাব্যনাট্যের ভূমিকা থেকে নেয়া সৈয়দ হকের এ উক্তিটি দেখতে পাওয়া যায় জাদুঘরের দরজার ঠিক উপরে লেখা। জাদুঘর প্রতিষ্ঠার সার্থকতা সৈয়দ হকের এ উক্তিটি বহন করে।

এবার জাদুঘরে সংরক্ষিত কিছু পুরনো দৈনিক পত্রিকার খবর দেই। দৈনিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯৬৫ সালের ২৭সেপ্টেম্বর তারিখের দৈনিক পাকিস্তান। পাক-ভারত যুদ্ধ নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনাম। 'সারারাত্রি লড়াই: পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক কয়েকটি ঘাটি পুনদখল'।

দৈনিক ইত্তেফাক রয়েছে ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭০ সালের। ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন নিয়ে ১ম পৃষ্ঠার শিরোনাম করা হয়েছে। 

১৯৭০ সালের ১৮ই নভেম্বরের দৈনিক সংবাদ রয়েছে। সেখানে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ের ছবি দিয়ে শিরোনাম।  'কেবল ভোলাতেই দুই লক্ষাধিক লোকের মৃত্যু'।

১২ই জানুয়ারি ১৯৭০ সালের রয়েছে দৈনিক পাকিস্তান। প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনাম, 'আওয়ামী লীগের সভা উপলক্ষে গতকাল পল্টন ময়দানে সমবেত জনসমুদ্রের একাংশ'। সত্তুরের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার ৯ই ডিসেম্বর সংখ্যা রয়েছে। প্রথম পৃষ্ঠায় রয়েছে এক নজরে ফলাফল। দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার আরও কপি রয়েছে ৪ঠা মার্চ ১৯৭১ সালের। শিরোনাম ইয়াহিয়ার প্রস্তাব : মুজিবের প্রত্যাখান। ২০শে মার্চ ১৯৭১ দৈনিক পূর্বদেশে আছে মুজিব ইয়াহিয়া বৈঠক নিয়ে শিরোনাম। স্বাধীনতার যুদ্ধকালীন সময়ের ২৪শে নভেম্বরের দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকা আছে প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের সারাদেশে জরুরি অবস্থা জারির খবর ৮ কলাম জুড়ে। 

১৯৭২ সালের দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার দুটি ঐতিহাসিক বিশেষ সংখ্যা দেখা  যায়। একটি ১৭ই মার্চ অন্যটি ১৯শে মার্চ। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম জন্মদিন ১৭ই মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশে প্রথম সফর উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা।  ৮ কলাম জুড়ে শিরোনাম, 'এসো নির্মল এসো নির্ভয়, তোমারি হোক জয়'। আরেকটা শিরোনাম হলো, 'শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল'।  দ্বিতীয় বিশেষ সংখ্যাটি হলো,১৯শে মার্চ ইন্দিরা গান্ধীর বিদায় নিয়ে। এ দিনেও রোববারের পূর্বদেশ বের হয়। বিদায় জানাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা। শিরোনাম, 'হোক সুন্দর তব বিদায়ের ক্ষণ'। এ ছাড়াও রয়েছে আরও অনেক দৈনিক। 

জাদুঘরে ৫ নম্বর গ্যালারিতে চোখে পড়ে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সাপ্তাহিক 'হক-কথা' বের হতো টাঙ্গাইল থেকে।

আরও দেখা যায় ১৯৫১ সালে প্রকাশিত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ রচিত ৭ম ও ৮ম শ্রেণির ব্যাকরণ পরিচয়। সুবলচন্দ্র মিত্র সম্পাদিত ১০০ বছরের পুরনো 'সরল বাঙ্গালা অভিধান'। এ ছাড়াও একশ বছর আগে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি বই। কতিপয় লেখকের হাতের লেখা এবং মধ্যযুগের পুঁথি পুস্তকের পৃষ্ঠার ছায়ালিপি।

জাদুঘর সূত্রে জানা গেছে, এমন আরও অসংখ্য পত্র-পত্রিকা তাদের সংগ্রহে আছে, যা জায়গার অভাবে আপাতত প্রদর্শন করানো সম্ভব হচ্ছে না।

জাদুঘর গড়ে ওঠার গল্পটা

জাদুঘরের সাথেই রয়েছে জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা তৌহিদ-উল ইসলামের গ্রামের বাড়ি। বাড়ির পাশে নিজের জমিতে নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেছেন এ জাদুঘর। তিনি একজন শিশুসাহিত্যিক এবং বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের বিশিষ্ট গীতিকার। পেশায় শিক্ষক। বর্তমান কর্মস্থল লালমনিরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। শিক্ষকতা পেশায় সাফল্যের জন্য ২০২২ সালে পেয়েছেন 'আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা'। এ সম্মাননায় পাওয়া দুই লক্ষ টাকায় শুরু করেন এ জাদুঘর নির্মাণের কাজ। তারপর নিজের ব্যক্তিগত আরও কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয় করে এ জাদুঘরটি দাঁড় করান। তিনি জাদুঘর নির্মাণ ছাড়াও নিজের জমিতে এ এলাকায় দুটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছেন। স্থাপন করেছেন সৈয়দ হকের নামে মঞ্চ ও কালচারাল ক্লাব। ২০২১ সাল থেকে চালু করেছেন সৈয়দ শামসুল হক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, যার অর্থমূল্য কুড়ি হাজার টাকাসহ যাবতীয় ব্যয়ভার তিনি ব্যক্তিগত ভাবেই বহন করে আসছেন।  শিশুসাহিত্যিক ফারুক নেওয়াজ, স. ম. শামসুল আলম, রমজান মাহমুদ ও দিলরুবা নীলা ইতোমধ্যে এ পুরস্কার পেয়েছেন। সৈয়দ হকের জন্মদিনে এ পুরস্কারের সাথে জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দিয়ে থাকেন 'গুণিজন সম্মাননা' এবং  পাঠাগারের 'সেরাপাঠক' পুরস্কার। এলাকার কয়েকশত শিক্ষার্থীদেরকে করেছেন তিনি পাঠাগারমুখী। বইয়ের সাথে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেন চকলেট। প্রতি শনিবার পাঠাগার ও জাদুঘর খোলা থাকে। পাড়লে আপনিও একবার ঘুরে আসুন। একজন লেখকের মৃত্যুর পর দেশের কোথাও জায়গা না হলেও এ জাদুঘরে তার জায়গা হবে, স্থান পাবে তার ছবিটি। সুতরাং জীবদ্দশায় সে জায়গাটা একবার দেখে আসলে আপনার মন আনন্দে ভরে ওঠবে।

এ জাদুঘরে পুরাতন দুর্লভ পত্র-পত্রিকার যে মূল কপিগুলো সংরক্ষিত আছে সেগুলো বাংলা একাডেমির লেখক জাদুঘরেও নেই। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে এ জাদুঘরের ঐতিহাসিক মূল্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। এ ব্যাপারে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা একান্ত জরুরি।

Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.