× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা জামায়াত বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

কালপুত্র

তালুকদার লাভলী

০৭ জুলাই ২০২৩, ১৯:২৪ পিএম । আপডেটঃ ০৭ জুলাই ২০২৩, ১৯:৪১ পিএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মসজিদ হতে আযানের ধ্বনি ভেসে এলো। কার যেন হাঁসগুলো ঘরে ফিরেনি।  তৈ-তৈ করে ডাকছে। গোধূলির রাঙা আলোয় রাঙিয়ে দেয় মনের কোণ। ডানা ঝাপটে রোদের গন্ধ মুছে ফেলে, নীড়ে ফিরে গাংচিল। সাদা বকের সারি শুভ্র হাসির মৃদু রেখা টেনে উড়ে যায় আপন খেয়ালে। দুটো শালিক এখনো মেতে আছে খুনসুটিতে। সন্ধ্যা নেমেছে, তা হয়তো ভুলেই গেছে। নারিকেল গাছে কাকের বাসা। কাকটা সারাদিন  কা-কা করছে। দুষ্টু  ছেলেমেয়েরা কাকের বাচ্চা চুরি করেছে। কচুরিপানার উপর   সারস  পাখিটা ডানা ঝাপটায়। সন্ধ্যার মৌনতারও যে এতো রূপ! দ্বীপ আগে কখনো দেখেনি। পল্লীর পরতে-পরতে এতো রূপ! এতো শোভা! এতো মায়া!

দ্বীপ গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়ায় উঠানে।!দেবী ধূপদানিতে ধূপ সাজাতে ব্যস্ত। আবছা আধাঁরেও বোঝা যায় ওর পরনে সাদা শাড়ি, লালপাড়। কপালে লাল টিপ। চোখাচোখি হওয়া মাত্র দুজনেই কিছুক্ষণ নির্বাক! পরম মুগ্ধতায় দুুজন দুজনকে দেখে। হঠাৎ দ্বীপ নড়েচড়ে ওঠে। আমি অসময়ে এসেছি! ঘোর কেটে যায়, চলে আসতে উদ্যত হলে।

দেবী বলে, আপনি এখন যেতে পারবেন না। খেজুর পাতার পাটি এনে পরম যত্নে বিছিয়ে বসতে দেয়। দ্বীপ কোন কথা না বলে বাধ্য ছেলের মতো বসে। জ্বেলে দেয় মাটির পিদিম। উলু শাঁখের ধ্বনিতে বেচারা সন্ধ্যা বিদায় নিতে বাধ্য। বউ ঝিরা সান্ধ্য পূজায় ব্যস্ত। ঢাক ঢোলের সুর কানে পৌছতেই রমণীরা আসতে শুরু করছে। একে একে দেবীর সামনে ভক্তি করে মা-দূর্গার আশির্বাদ গ্রহণ করছে যুবতী-রমণী, বৃদ্ধা, শিশু-কিশোরীরাও জীবনের সকল পাপ, অভিশাপ মোচন করে আশির্বাদ নেয় আঁচল ভরে। সবার চোখে মুখে দেবী বরের পরম তৃপ্তি। সকালের মাঝে আনন্দের উত্তেজনা। কেউ বলছে খুড়ি আমাগো বাড়ি যাইবা। কেউ বলছে, জ্যাঠিমা, চৌধুরীবাড়ির ঠাকুর অনেক ভালা। আবার কেউ বলে, ময়রা বাড়ির প্রতিমার নাকটা এটু চিকন করলে ভালা হইত। সবাই নতুন কাপড় পরে সাজগোজ করেছে। সকলের মধ্যেই উচ্ছাস আর ব্যস্ততা। কাঁশির শব্দ! ঢোলের বাড়ি! ধূপের গন্ধ! থেকে থেকে উলুধ্বনি ! এ যেন মহা মিলনমেলায় মেতেছে সবাই। উঠানের এক কোণে দেবীর কালো গাই বাঁধা।  বাচ্চাটি মা’র কাছ ঘেঁষে আদর খাচ্ছে। কি নিবিড় মমতায় মা গরু বাচ্চাকে আদর দিচ্ছে। উঠানের চারদিকে গোল করে পাটি বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাচ্চা গরুটি কখনো কখনো মাকে ছেড়ে পাটির উপর এসে লাফায়। সবার সাথে বাচ্চা গরুটিও আনন্দে মেতেছে। পূজার সময় যে বাড়িতে পূজা হয় সে বাড়িতে খাবার ফ্রি। মা- দূর্গার উৎসবে কেউ না খেয়ে গেলে মা অসন্তুষ্ট হয়। সকলেই তাই সারাবছরের আয় থেকে পূজার জন্য টাকা জমায়। পূজার সময় অকৃপণ হাতে ধূমধাম করে মা দূর্গাকে খুশি করে। লোকজন সারি সারি বসে খাওয়ার জন্য। তুলসীদাস কলাপাতায় দই ও চিরা ঢেলে দেয়। দ্বীপও সাথে সাথে সাহায্য করে।  পেটপুরে খেল সকলে। 

ভাইয়া, তুমি এইখানে! আর আমি তোমারে খুঁইজা খুঁইজা অস্থির! 

দেবী বলে, চকলেট বস। আমি খাবার নিয়ে আসি। সে ঘরে প্রবেশ করতে যেয়ে আবার ফিরে এসে বলে, তা শহুরে বাবু, কি খাবেন? চিড়াদই, ঢ্যাপের মোয়া, খইয়ের নাড়ু, উড়ুমের নাড়ু কোনটা?

ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে দ্বীপ বলে, একটু থামলে ভালো হয়। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝকঝকে কাঁসার থালা ভর্তি মুড়ি মুড়কি নিয়ে হাজির দেবী। চকচকে কাঁসার ঘটিতে জল রেখে দেবী বলে, শুরু করুন শহুরে বাবু। 

দ্বীপ তাকে বসতে বলে, 

সে শুধু না-না করে। কেন মুসলমানের সাথে খেলে জাত যাবে?

লজ্জায় রাঙা হয়ে মুখ নিচু করে দুর্বা বলে, কি যে বলেন। আমি ওসব মানি না। সবাই মানুষ। এটাই আসল পরিচয়। কিন্তু এদেশের মানুষরা ভাবে আমরা পরদেশি। এটাই দুঃখ! অথচ ইসলামে ধর্মবর্ণ নিবিশেষে সকল মানুষই সমান। আর আমাদের হিন্দুধর্ম তো  পৈতৃক সম্পত্তি। কথায় কথায় জাত  যায় ধর্ম যায়।

শরতের স্নিগ্ধ বিকেলের হাতছানিতে প্রকৃতির সাথে মিতালি গড়ে দ্বীপ। আসমানের নীল ভাঁজে দেবীর লাবণ্যময়  দীপ্ত মুখের উঁকিঝুকি । কোথা থেকে চকলেট এসে দ্বীপের হাত ধরে বলে, ভাইয়া আস, টুংগিবাড়ি (ডাংগুলি) খেলমু। একটা লম্বা লাঠি নিয়ে  টানতে টানতে নিয়ে এলো,খেলার জায়গায়। ভাইয়া তুমি খাড়াও। আমি বাড়ি দিমু, চকলেট একটি গর্ত খুরে এক বিঘার মতো। সেই গর্তের উপর ৬/৭ ইঞ্চি একটি লাঠির টুকরো আড়াআড়ি করে রাখে। এরপর লম্বা লাঠি দিয়ে ছোট লাঠিটার নিচ দিয়ে উচু করে বাড়ি দেয়। লাঠিটা বেশ দুরে গিয়ে  পড়ে। এরপর বড় লাঠি দিয়ে গুনে দেখে, যতোদুর পর্যন্ত ছোট লাঠিটি গিয়েছে, সে পর্যন্ত কয় ডাং নিতে পেরেছে। প্রতিপক্ষ একই নিয়মে খেলবে। যে যতো বেশি দূর লাঠি নিতে পারবে সে জিতবে।

কি-রে, আংকু, টুংগিবাড়ি খেলবি? আংকু পাশের বাড়ির ক্ষিতিশের নাতি। আংকু লাফ দিয়ে ওঠে। 

দ্বীপ বলে, তোরা খেল, আমি বাগানে গিয়ে বসি।

কৃষ্ণচূড়ার ডালে বসে দুটি ঘুঘু ছোটাছুটি করছে। মনে হচ্ছে লুকোচুরি খেলছে।  শালিকটি একাকী অসহায় ভাবে বিরসবদনে বাগানের বেড়ার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো ওর সাথী অন্য শালিকের সাথে জুটি বেঁধেছে। এই একাকীত্ব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেকটা সাথী খুঁজে নিয়েছে। পুকুর ঘেঁষে  বড় তালগাছ। তাতে অনেক বাবুই বাসা বুনেছে। কি সুন্দর নিপুণভাবে গড়া! কিন্তু অনেক সময় প্রকৃতি এদের সাথে বৈরিতা করে। ঝড় বৃষ্টি হলেই নিপুণ ঠোঁটে গড়া স্বপ্নের সাজানো ঘরটি উড়ে যায়। বাচ্চাগুলি ছিটকে পড়ে। বাঁচার জন্যে আপ্রাণ চেষ্ঠা করে, যন্ত্রণায় মা পাখিটা ছটফট করে, নিজের চোখের সামনে সন্তান ধূকে ধূকে মারা যায়। মা পাখিটার গলা ছেড়ে আর্তনাদ  ছাড়া কিছুই করতে পারে না। দ্বীপ আর ভাবতে পারে না। চোখ বন্ধ করে থাকে কিছুক্ষণ। মাথায়  মাটির ঢিল পড়তেই চোখ মেলে। সামনে চৌদ্দ পনের বছরের কিশোরী। মাথায় ছোট ছোট চুল। পরনে ছেঁড়া লম্বা ফ্রক। খিলখিলিয়ে হাসছে। হাতের মুঠোয় কয়েকটি মাটির ঢিলা। এই মেয়ে শোন! দ্বীপকে ভেংচি কাটে মেয়েটি। একটু দূরে গিয়ে আরেকটি ঢিল ছুঁড়ে খিলখিল করে হাসে। 

চকলেট দেখতে পেয়ে চটে ওঠে। এই তেলাপাগলী, ঢিল মারিস ক্যা? গেলি, আসলে কিন্তু তোর খবর আছে। যা-গা। তেলাপাগলী দৌড়ে চলে যায়।

 চাঁদনি রাত! চারিদিকে নিরব! গাঁয়ের মানুষগুলি গভীর ঘুম! দ্বীপ ঘাটে বাঁধা ডিঙি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে।  চারদিকে থইথই পানি। ডিঙিটা ঝিলের মাঝে এনে ছেড়ে দেয়। যা তোর যেদিকে ইচ্ছে। চাঁদের আলোয় রূপার মতো চিকচিক করছে জল। এ যেন কতো যুগযুগান্তরের গল্পের দেবী। যার রূপে মুগ্ধ হয়ে টলমলে জল তাকিয়ে আছে স্বচ্ছ চোখে। চাঁদ তার রূপে লজ্জিত হয়ে ক্ষণে ক্ষণে মুখ লুকায় মেঘের আলে। দুজন-দুজনকে দেখে পরম মুগ্ধতায়। কোথাও কেউ নেই। চারিদিকে সুনসান নিরবতা! হাওয়া ফিসফিসিয়ে অভিবাদন জানায় এই  যুগলকে। ডাহুকের গলা শোনা যায়। আশেপাশেই হয়তো বাসা। শস্যের সুবজ মাঠ পানিতে ভর্তি। দিন রাত ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়। সকালের চিরচেনা এই ঝিলের রূপ এক রকম! মধ্য

দুপুরে আরেক রকম! বিকেলে লাবণ্য স্নিগ্ধ আধারমাখা ঝিলটা মনকে ফুরফুরে আমেজে ভরে তোলে। ঝিলে মায়াবী মৌনতার দোলা। আর নিশুতি চাঁদনি রাতের রূপ যে এতো সরল মায়াবী। চাঁদনি রাতের সমস্ত মৌনতা ভেংগে অবচেতন মনে প্রশ্ন করে।

তুমি যে একা আমার সাথে এলে। ভয় করে না তোমার? দেবী খিলখিল করে হেসে ওঠে। কি ব্যাপার! অমন করে হাসছ যে, ঝিঁঝিরাঁ চলে আসবে।

হাসব না। তুমি কি বাঘ !  না -ভাল্লুক! যে ভয় করবে! ঠোঁট ফুলিয়ে বলে দেবী।

ঠিক বলেছ দেবী। তুমি আমার অনেক দিনের চিরচেনা আপনজন। তাই তো মনের অজান্তেই তুমি বলে ফেলেছ। 

দেবী  জিভে কামড় দিয়ে বলে, হায় ভগবান! এটা কি হলো বলে দু’হাঁটুর নিচে মুখ লুকায়। 

দ্বীপ মুখটা তুলে ধরে , লজ্জা কিসের! যেদিন তোমায় প্রথম দেখেছি। সেদিন থেকেই হৃদয়ের কোটরে ঠাঁই দিয়েছি। সেদিন থেকেই হৃদয়ের পরতে পরতে শুধু তোমারই ছবি আঁকছি। তোমার দেওয়া প্রথম শরতের ঝরা শিউলিগুলো বড় যতনে রেখেছি আজও। তোমাকে  দেখে আমার সমস্ত ভাবনা এলোমেলো হয়ে গেছে, চিবুক ধরে আলতো হাতে, ইস! বিধাতা বুঝি পৃথিবীর সমস্ত রূপ তোমার মাঝে ঢেলে দিয়েছে। তোমার রূপে চাঁদ হেরে গিয়ে লজ্জায় কেমন করে। দেখো! মেঘের আড়ালে মুখ লুকাচ্ছে বার বার। দেবী লাউয়ের ডগার মত নেতিয়ে পড়ে দ্বীপের বুকে। দুটি প্রাণ এক হয়। দু’জনই পরস্পরের হাত দুটো চেপে ধরে।

দেবী, তোমার ছোঁয়ায় এতো সুখ! এতো আনন্দ! এতো রহস্য! তুমি যে আন্দময়ী! সুখময়ী! রহস্যময়ী দেবী! দেবীর ঠোঁটে ঠোঁট রাখে

‘‘তোমায় নিয়ে ভাসাব ভেলা

সাত সাগরের বুকে।

যদি সংকুচিত হও

তৃষিতার মতোন প্রসারিত হবো

হৃদয়ের নোনাজলে।

হারিয়ে যাব গহীন গাঙে

হৃদয় পাল তুলে।

সাত আসমানে মেলব ডানা

মেঘের ঢেউ ভুলে।’’

উচ্ছাস ভরা রক্তিম ঠোঁট দুটো নেড়ে, বলে দ্বীপ, বাহ্ ! দারুণ! তুমি তাহলে কবিও!

তোমাকে এতো কাছে পেয়ে কবিতারা জড়িয়ে ধরল আপনা-আপনি। দেখ, সব কথামালা কাব্যমালা, ভিড় জমিয়েছে আজ এই গোপন জলসায়। আমার জিম্বায় উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ কবিতা হযে ঝরছে তোমার উষ্ণ কাব্যের পরশে। দ্বীপ আরো ঘনিষ্ঠ হয়। 

বিজন রাতে মানব যুগল ভালবাসার মাতাল হাওয়ায় মেতেছে। জলের উপর ছোট ছোট ঢেউ আকুলি-বিকুলি করে প্রেমের সুর ছড়ায়। বাতাসের সুনসান আওয়াজ ফিসফিস করে আমন্ত্রণ জানায় ভালবাসার সুধা ঝরাতে। চাঁদ তার সামিয়ানা টেনে দেয় ভাল লাগার কাব্য রচনা করতে। দ্বীপ দুর্বার হাতে হাত রেখে পরশ ভুলায়। কোমল গাল দুটি ছুঁয়ে দেয়। মাথায় দু’একটি এলোচুল আলতো করে ছড়িয়ে দেয়। দুষ্টুছলে উড়িয়ে দেয় বুকের বসন। আকাশের লাল রঙ এনে রাঙিয়ে দেয় পা দু খানি। মেঘের তীর থেকে অঞ্জন এনে একেঁ দেয় ডাগর দুটি চোখে। চাঁদ যেমন পৃথিবীর আলিঙ্গনে মিতালি গড়ে। তেমনি মানব-মানবী যুগল পাখনা মেলে রক্তে রক্তে স্পন্দন জাগায়। তিরতির করে কাঁপন ধরে শরীরে শরীরে। ঢেউগুলো প্রবল গতিতে হৃদয়ে আছড়ে পড়ছে নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে। নিঃশ্বাসও ঘন হয়ে আসে। প্রবল কালবৈশাখীর তাণ্ডবে। শরীরের সমস্ত বান একাকার হয়ে যায়। ধীরে ধীরে ঝড় থেমে আসে। নিথর দুটি দেহ চাঁদের রঙ মেখে পড়ে থাকে। চোখে চোখ রেখে দুজনে কতো কথাই যে বলে যায় অবিরাম। পাখির ডাকে চোখ মেলে দ্বীপ। তাহলে এতক্ষণ বিভোর ছিলাম সুখ স্বপ্নে!  মৃদু হেসে মনে মনে বলে, এমন স্বপ্ন যেন প্রতি রাতে দেখি। দিনটা ভালোই যাবে। 

আজ অষ্টমী পূজা। এই দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজ কেউ মাছ-মাংস খাবে না। সবাই নিরামিষ খাবে।  তুলসী দাস ব্যস্ত ব্যঞ্জন কাটতে। 

দেবী সকাল-সকাল ঘুম থেকে ওঠেছে। কামরাঙার ডালে   দোয়েল শিষ দিয়ে যায়। রঙিন টিয়া পাকা কামরাঙায় ঠোঁট বসায়। সারারাতের ক্ষুধার্ত টিয়া তৃপ্তি সহকারে কামরাঙা ঠোকরাচ্ছে। অন্যদিন হলে একটা ঢিল ছুড়ত। আজ কেন জানি টিয়াটার জন্যে মায়া হচ্ছে। আজ গাছের সমস্ত কামরাঙা খেয়ে ফেললেও কিছু বলবে না। শরতের স্বচ্ছ আকাশ। তুলার মতো ভাসছে সাদা সাদা মেঘ।  দেবী আকাশের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়। আজ এতো ভাল লাগছে। জীবনে আর কোনদিন এত ভালো লাগেনি। বার বার আকাশের ভিতর উঁকি মারে দ্বীপের স্বপ্নদ্রষ্টা মুখটা। কোন কল্প লোকের রূপকথার রাজপুত্র যেন সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে হাতছানি দেয়।

“এস এস উষার মতোন প্রদীপ জ্বেলে

ভাসব দু’জন নীলাচলে

হারিয়ে যাব গহীন গাঙে।

কথা কব, কথা কব

নিথর নিরালায়

রক্তিম ঠোঁটে ঠোঁটে ভেজাব

শিশিরের সিক্ততায়’।

মা, এক ঘড়া জল নিয়া আয়। বাবার ডাকে জাগতিক জগতে ফিরে আসে দেবী। মেয়ের দিকে তাকিয়ে রঘুনাথের মনটা বিষাদে ভরে যায়! মনে মনে বলে, গরীব ছোটজাত আমরা। ম্যায়াডার জন্য কতজনেই হুমকি দেয়। হায় ভগবান! দেশের অবস্থাও ভালা না। পাকিস্তানীরা দেশটারে জ্বালাইয়া খাইতাছে। ম্যায়াডা নিয়া আতংকের মধ্যে আছি। হে ভগবান আমার মা’র জন্য শিবের মতোন একটা বর দিও, বলতে বলতে কাজে বেরিয়ে যায়। 

সকালে শরতের মিঠে রোদে বসে গরম গরম ভাপা পিঠা খাচ্ছে দ্বীপ আর চকলেট।  দারুণ! ভাপ উঠা পিঠা ।  চাচী, গ্রামের পরিবেশ এতো সুন্দর! অথচ বাবাÑমা কখনো আমাকে গ্রাম দেখায় নি। এই বার সত্যিকার গ্রামকে উপভোগ করছি। 

দ্বীপের কথা শেষ না হতেই, চকলেট বলে, মা, ভাইয়া মনে হয় আমাগো গাঁয়ে থাইক্যা যাইবো। 

সত্যি কথা বলছিসরে। ইচ্ছে করছে সারাটা জীবন গ্রামে কাঁটিয়ে দিই। গাঁয়ের মানুষগুলি কতো সহজ সরল! অল্পতেই কাছে টেনে নেয়।

আজ বিজয়া দশমী, দেবী মহাব্যস্ত সাজগোজ নিয়ে। আয়নায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আর ভাবছে। ঠিক তখনই দ্বীপের মুখটা ভেসে ওঠে আয়নায়। পেছন ফিরে তাকাতেই দ্বীপের কণ্ঠ, খুব সুন্দর লাগছে! ঠিক যেন টিয়াপাখি! দুর্বা মুখ তুলে তাকায়। দ্বীপ তুমি কোথায়! নিজেই লজ্জায় লাল হয়ে যায় । সব কিছুই মনের ভূল।

 দেবী বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে দূর্গা পূজা। পূজা মন্ডপের সামনে দর্শক সারিতে দ্বীপ। দেবী দূর্গার গুণকীর্তন। পুরোহিত একটি ধূপদনিতে ধূপ জ্বেলে মা দূর্গাকে অভিবাদন জানিয়ে মায়ের পায়ে ভক্তি দেয়। বাটিতে চন্দ্রন বাটা। নারী-পুরুষেরা মা দূর্গার চরণধূলি নিয়ে কপালে চন্দনের চিহৃ এঁকে, এক এক করে বের হচ্ছে। দেবীও মা দুর্গার সামনে নুয়ে পড়েছে। ওর পরণে লালপেড়ে শাড়ি, সবুজ শ্যামল মাঠের মাঝে যেন লাল সূর্য।

দেবীর সামনে হাতজোড় করে মনে মনে বলে, হে দূর্গা, মহামায়া তুমি তো সব জানো। তুমি আমাকে একটি মাত্র বর দাও। আমি যেন আমার প্রাণের দেবতার পায়ে ফুল দিতে পারি। দেবী কপালে চন্দনের টিপ দিল এবং এক ফোটা এনে চকলেট ও দ্বীপের কপালে লাগিয়ে দেয়।

শুরু হল আরতি। দেবী ও তার সখিরা ধূপ হাতে নাচছে । থেকে থেকে উলুধ্বনি দিচ্ছে উপস্থিত মহিলারা। অপূর্ব নৃত্যের তালে তালে গান গাইছে সমবেত কয়েকজন নারী-পুরুষ- 

“নূপুর পরা আলতা পায়,

নাচে আমার সোনার গাঁয়।

মাথায় চাঁদি, হাতে চুড়ি, নাকেতে নোলক

সোনার কন্যা নাচেরে ঝলকে ঝলক।

উজান থেকে আইল বাতাস বইল গাঙের ঢেউ

ছলাৎ ছলাৎ নাচে কন্যা সোনার বরণ গেও’।

সোনার দেশের সোনার কইন্যা ছলছলইয়া যায়।

যাইতে যাইতে কন্যা কেন পিছন ফিরা চায়।

কইন্যার রূপে চন্দ্র তারা আকাশ থেকে পালায়

চান্দের আলো কইন্যার মুখে ঝিলিমিলি ছড়ায়।”

দ্বীপ বাগানে বসা। সামনে এসে দাঁড়ায় তেলাপাগলী। 

কি-রে তেলা, সারাদিন খেয়ে খেয়ে পেটটা বড় করেছিস! 

তেলার মা শুটকি এসে মেয়েকে ধমকায়, তোরে না কইছি, বাইরে বের অইবি না। শুটকি মেয়েকে টেনে বাড়ি নিয়ে যায়। 

দ্বীপ কিছু বুঝে ওঠার আগেই কয়েকজন মহিলা কি যেন ফিসফিস করে বলাবলি করছে। শুধু তেলাপাগলি নামটা শোনা যায়। একান-ওকান করে তেলাপাগলীর খবরটা সারা গাঁয়ে জানাজানি হয়ে যায় কয়েক দিনের মধ্যেই।

ব্যাপারটা পরিষ্কার বুঝতে পারে তখন, যখন শুটকি কেঁদে-কেঁদে বাকুমিয়ার কাছে ঘটনাটি জানায়। দ্বীপ ভাবে মানুষ কতো জানোয়ার! পাগলা একটা মেয়ের সাথে এমন পশুর মতো আচরণ করতে পারে। কে একাজ করেছে, জানতে পারলে তাকে জীবনের মতো একটা শিক্ষা দেয়া যেত। শুটকি ভেবে পায় না কি করবে। সারা গ্রাম জুড়ে জায়গায়-জায়গায় জটলা বেঁধে লোকজন বলাবলি করছে। কেউ কেউ আফসোস করছে।

দ্বীপ চকলেটকে নিয়ে বড়শিতে মাছ ধরছে। তেলাপাগলী এসে মাচানের ওপর বসে। ফ্রকের ভাঁজে গজা। কুটুস কটুস করে খাচ্ছে আর পা দোলাচ্ছে। দ্বীপ বড়শির ছিপটা রেখে এগিয়ে এসে তেলাকে জিজ্ঞেস করে, কি খাস?

তেলা জামার ভাঁজ খুলে দেখায়, কে দিয়েছে? 

তেলা ইশারায় দেখায়, মাথার টুপি আর দাঁড়ি। দ্বীপের সন্দেহ হয়। খেয়াল করতে হবে। নিশ্চয়ই কেউ লোভ দেখিয়ে একাজ করেছে। দ্বীপ বিকেলে ঘাটে বাঁধা ডিঙিতে ওঠে বসে। ছোট একটি মেয়ে দড়ি লাফ খেলছে।

(চলবে)


Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.