× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

নজরুল-প্রমীলার স্মৃতিধন্য তেওতা গ্রাম

চিন্ময় কুমার মল্লিক

২৯ মে ২০২৩, ০৭:৩৯ এএম

বাংলা সাহিত্যে এক নবযুগের সাহিত্যস্রষ্ঠা হচ্ছেন কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। তিনি তাঁর মহৎ সব সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে সাহিত্যাঙ্গনে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্যজীবনে তিনি নানা বেদনাকে সঙ্গী করে চললেও সাহিত্য ও সমাজে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। তিনি তাঁর সাহসী সৃষ্টিকর্মের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়লেও সব বাঙালির মনে ভালোবাসার স্থানটি দখল করে নিয়েছিলেন নিজগুণে। 

বল্গাহারা নজরুল নবসৃষ্টির আনন্দে মেতে বেড়িয়েছিলেন এপার বাংলা-ওপার বাংলার নানা স্থানে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যেমন পূর্ববঙ্গে আসার পর চিন্তার দ্বার প্রসারিত হয়েছিল তেমনি নজরুলও পূর্ববঙ্গকে ভালোবেসেছিলেন গভীর মমতায়। সেকারণে পূর্ববঙ্গের প্রকৃতি ও মানুষের প্রেমে তিনি মজেছিলেন একনিষ্ঠভাবে। শেষপর্যন্ত এই পূর্ববঙ্গের তেওতা গ্রামের মেয়ে আশালতা সেনগুপ্ত ওরফে প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করে জীবনসঙ্গী করেছিলেন। এই পূর্ববঙ্গের সঙ্গে নজরুলের ছিল গভীর আত্মীক যোগসূত্র। 

পূর্ববঙ্গের নানা স্থানের পথে-প্রান্তরে নজরুল ঘুরেছেন, দেখেছেন, সাহিত্যসৃষ্টি করেছেন। পূর্ববঙ্গের ভ্রমণ সম্পর্কে নজরুল নিজেই লিখেছেন, আট বছর ধরে বাংলাদেশের প্রতি জেলায়, প্রতি মহকুমায়, ছোট-বড় গ্রামে ভ্রমণ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য গান গেয়ে, কখনো বক্তৃতা করে বেড়াতাম। এমনিভাবে পথ চলতে চলতে নজরুলের  একসময়  আগমন ঘটে মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার তেওতাঁ গ্রামে। নজরুল-প্রমীলার স্মৃতিধন্য এই তেওতা গ্রামের একটি ঐতিহ্যও আছে। 

জমিদার কিরণশঙ্কর রায় ছিলেন একজন তৎকালীন উচ্চশিক্ষিত ও সংস্কৃতমনা মানুষ। তিনি তাঁর জমিদার বাড়ির মন্দির প্রাঙ্গনে নিয়মিতই নাটক, গান, কবিতার জলসার আয়োজন করতেন। সেখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসে শিল্পীরা যোগ দিতেন। এমতাবস্থায় জমিদারের আমন্ত্রণে নজরুল প্রথমবারের মতো তেওতাঁ গ্রামে আগমন করেন। নজরুলের এই আগমন একদম ধূমকেতুর মতো নয় বরং প্রকৃতিপ্রেমে আকৃষ্ট হয়ে নিয়মিত সফরের অংশ হিসেবে তেওতা গ্রামে এসেছিলেন।। এই তেওতা গ্রামেই জমিদার বাড়ির প্রাচীর ঘেঁষে ছিল সেনগুপ্ত বংশ অর্থাৎ গিরিবালা দেবীর বাড়ি।  গিরিবালা দেবী ছিলেন তাঁর স্বামী বসন্তকুমার সেনগুপ্তের দ্বিতীয় স্ত্রী। তাঁদেরই একমাত্র কন্যা সন্তান ছিলেন প্রমীলা দেবী (১৯০৮-১৯৬২)। যে প্রমীলা নজরুলের জীবনসঙ্গী হয়ে তাঁর ঘর আলোকিত করে রেখেছিলেন এবং আমৃত্যু পাশে থেকেছিলেন। 

প্রমীলা দেবী ও তাঁর মা গিরিবালা দেবীর জন্মস্থানও হলো এই তেওতা গ্রামের টিনের ঘরে। যেটি আজ অযত্ন-অবহেলায় কালের সাক্ষী হিসেবে নীরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রমীলা দেবীর যখন ১৩/১৪ বছর বয়স তখন তাঁর বাবা ত্রিপুরা রাজ্যের রাজসভায় চাকরিরত অবস্থায় দেহ ত্যাগ করেন। অসহায় গিরিবালা দেবী তখন ছোট প্রমীলা দেবীকে নিয়ে ঠাঁই নেন কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে চাকরিজীবী দেবর ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে। তখন থেকেই তারা কুমিল্লাতে স্থায়ী বসবাস করতে থাকেন। পড়ে থাকে তেওতা গ্রামে সেনগুপ্ত বংশের বাড়িটি। ধীরে ধীরে এই বংশের অন্যান্য সদস্যরাও ভারতে পাড়ি জমান বিভিন্ন সময়। 

তেওতা গ্রামের বাড়িটি নানা ব্যক্তির মাধ্যমে হাতবদল হতে থাকে। যদিও নজরুল-প্রমীলার প্রথম সাক্ষাৎ হয় কুমিল্লার বাড়িতে ১৯২১ সালের মার্চ বা এপ্রিল মাসে। পর্যায়ক্রমে তাদের ভালোলাগা, ভালোবাসা এবং অবশেষে ১৯২৪ সালের ২৪ এপ্রিল কলকাতাতে বিবাহ সম্পন্ন হয়। তৎকালীন হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় হিন্দু-মুসলমানের বিয়ে সম্পন্ন হওয়া কঠিন ছিল তবুও সকল বাধাকে উপেক্ষা করে নজরুল-প্রমীলা চারহাত একসাথে করেন। বিভিন্ন সূত্র ও গবেষণা থেকে জানা যায়, নজরুল একা কিংবা প্রমীলাকে নিয়ে বিয়ের  পরে মিলিয়ে কমপক্ষে পাঁচবার এই তেওতাঁ গ্রামে আসেন।  

মানিকগঞ্জ হলো পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, ইছামতি বিধৌত একটি জেলা। বর্ষায় অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে পরিণত হয় এই জেলা। নজরুল যতবারই পূর্ববঙ্গে এসেছেন ততবারই অপরূপ সৌন্দর্যের অনুসন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তারই অংশ হিসেবে তেওতা গ্রামে ছুটে গিয়েছেন প্রাণের টানে। কখনো তাঁর বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের সাথে নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে, কখনো কবিতা রচনা করে ব্রিটিশ সরকারের রোষানল থেকে আত্মগোপনে যেতে গিরিবালা দেবী ও প্রমীলার সাথে আশ্রয় গ্রহণ, কখনো স্বদেশি আন্দোলনের অংশ হিসেবে নেতাজি সুভাষ বসুর সাথে গমন আবার কখনো জমিদারের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতেও নজরুল এই গ্রামে আসেন। 

জনশ্রুতি অনুসারে, নজরুল এই গ্রামের জমিদার বাড়ির নবরত্ন মন্দিরের দোল উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন,পুকুরঘাটে বসে আপনমনে বাঁশি বাজাতেন এবং এখানে বেশ কিছু সাহিত্যকর্মও সৃষ্টি করেছিলেন। নজরুলের দু’একটা লেখায় তেওতা গ্রামের সাক্ষ্যও মেলে। নজরুল-প্রমীলা স্মৃতিধন্য এই তেওতা গ্রাম হতে পারে নজরুল গবেষণার এক অনন্য স্থান।

নজরুল ও প্রমীলার স্মৃতির সাক্ষর এই জমিদার বাড়ি ও সেনগুপ্ত বংশের অরক্ষিত বাড়িটিকে সরকার অধিগ্রহণের মাধ্যমে গবেষণার এক চারণভূমি করে তুরতে পারে। এই মহৎ কাজ করার মাধ্যমে তেওতা গ্রামও হয়ে উঠতে পারে এক বিশেষ পর্যটন স্থান। নজরুলকে ধারণ করতে হবে চিন্তায়-চেতনায়-মননে ও বিশ্বাসে। তাঁর সৃষ্টিকে ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্বমাঝে। জাতীয় কবির এই স্মৃতিময় বাড়িগুলো সংরক্ষণের মাধ্যমে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মরা তাঁর সৃষ্টিশীলতা সম্পর্কে আরও জানতে পারবে। তেওতা গ্রাম হয়ে উঠবে নজরুল-প্রমীলার স্মৃতিধন্য এক পূণ্যভূমি। 

Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.