বক্তব্য রাখছেন অতিথিরা। ছবি: সংবাদ সারাবেলা
সত্তর ও আশির
দশকের প্রতিভাবান সাতজন শিল্পীর শিল্পকর্ম নিয়ে রাজধানীর ধানমন্ডিতে গ্যালারি চিত্রকে
চলছে ‘মনোমন্থন’ শীর্ষক প্রদর্শনী। প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী উদীয়মান চিত্রশিল্পীরা
হলেন- সুলেখা চৌধুরী, মাহমুদুর রহমান দীপন, আশরাফুল হাসান, ফারজানা রহমান ববি, এ এইচ
ঢালি তমাল, অনুকূল চন্দ্র মজুমদার ও ইমরান হোসেন পিপলু।
এই সাত শিল্পীর
সাম্প্রতিক আঁকা চিত্রকর্মের সম্মিলনে সজ্জিত হয়েছে এবারের শিল্পায়োজন। তাদের সাম্প্রতিক
এসব চিত্রকর্ম নানা মাধ্যমে চিত্রিত বিবিধ বিষয় উঠে এসেছে তাদের ক্যানভাসে। সে সব ছবিতে
দেখা মিলেছে নিসর্গের সঙ্গে নারীর সম্পর্কের রসায়ন থেকে জীবনের নানা অধ্যায়। উঠে এসেছে
গ্রাম-বাংলার প্রতিচ্ছবি থেকে শহর ঢাকার জীবনচিত্র কিংবা খাল-বিলের সঙ্গে সম্পর্কিত
কারও শৈশবের স্মৃতি। কেউ বা মেলে ধরেছেন একাত্তরের স্মৃতি জাগানিয়া যশোর রোডের চিত্রকল্প।
শিল্পীদের
মধ্যে ছয়জনের জন্ম গত শতকের সত্তরের দশকে, আর একজনের আশির দশকে। তাই বলা যায়, তারা
তাদের কর্মযজ্ঞের মধ্য পর্যায়ে অবস্থান করছেন। শিল্পী হিসেবে তাদের পরিচিতিও রয়েছে।
অনেকেই দু'দশকের অধিককাল শিল্পচর্চায় নিয়োজিত। তাই প্রদর্শনীর অধিকাংশ শিল্পীর কাজেই
তাদের প্রতিষ্ঠিত শিল্পভাষার খোঁজ পাওয়া যায়। নতুন শিল্পভাষার খোঁজ করেছেন দু'জন
শিল্পী- মাহমুদুর রহমান দীপন আর ইমরান হোসেন পিপলু। প্রদর্শনীর সব কাজই দ্বিমাত্রিক।
এর মাধ্যমে এখানে দৃশ্যগত ঐক্যের সন্ধান পাওয়া যায়।
অনুকূল চন্দ্র
মজুমদারের কাজে অভিজ্ঞতার বয়ান বর্ণিত হয়েছে। মোট চারটি চিত্রকর্মের মধ্যে দুটি তার
স্মৃতিবিজড়িত বাগেরহাট অঞ্চলকেন্দ্রিক আর একটি বর্তমান ঢাকার অভিজ্ঞতাকে চিত্রিত করে।
অপর কাজটির বিষয় মা ও শিশু। অনুকূল তার চিত্র পরিসরে শূন্যতার গুরুত্ব হারাতে দেন না।
তাই এই শূন্য স্পেসকে তিনি অধিক জোরালোভাবে উপস্থাপনে মনোযোগী হন বিষয় চিত্রণের সমান্তরালে।
বিষয়ে প্রবেশের জন্য হয়তো তিনি দর্শকে কিছুটা দৃশ্যগত বিরাম দিতে চান। বাগেরহাটের গল্প
শিরোনামের কাজ দুটিতে একই প্রকৃতির দুই রূপকে দেখা যায়। উষ্ণ আর শীতল বর্ণের ব্যবহারে
শিল্পী দুই ভিন্ন সময়ের ভিন্ন ভিন্ন আবহ উপস্থাপন করেছেন। কাঠকয়লার সংবেদনশীল উপাদান
গুণ তিনি চমৎকারভাবে ব্যবহার করেন। বিষয়বস্তুর মেজাজ বুঝে তিনি রেখার চরিত্র নির্মাণ
করেন। বিশেষভাবে প্রকৃতিনির্ভর কাজ দুটিতে কাঠকয়লার নানা গতিপথে অনায়াস বিচরণ যেন তার
আবহের আলো-হাওয়ার পরিপূরক হয়ে ওঠে। অপরদিকে নগর চিত্রণে তিনি ব্যবহার করেন অধিকতর দৃঢ়
আর রুক্ষ রেখার।
আশরাফুল হাসানের
চিত্রকর্মে বৃক্ষ আর মানব অবয়ব একাকার হয়ে এক নব অস্তিত্বের সৃষ্টি করে। দীর্ঘদিন যাবৎ
তিনি প্রকৃতি আর পরিবেশের নানা সংকটকে বৃক্ষমানবের প্রতীক মূর্ত করে তুলেছেন। এবারের
প্রদর্শনীতেও এ ধরনের চারটি কাজ প্রদর্শিত হচ্ছে যেখানে সরাসরি অস্তিত্ব সংকটে কাতর
বৃক্ষের আহাজারি চিত্রতল ছাড়িয়ে দর্শকের কান অবধি পৌঁছে যায় হয়তো। অসাধারণ অঙ্কন দক্ষতায়
তিনি দর্শককে এক রূঢ় বাস্তবের জগতে নিয়ে যান; যা দৈনন্দিন বাস্তবকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ
জানায়। প্রকৃতি শীর্ষক দুটি কাজে আমরা নির্মল প্রকৃতিকেই অবলোকন করি। আর এ ধরনের কাজের
মধ্যে শেষ কাজটি শেকড়-৭ ঐতিহ্যের শিল্পীর চেতনার জানান দেয়। লাল ফিতা-৯ আর কথোপকথন-৩
চিত্রকর্ম দুটির কেন্দ্রীয় চরিত্র সংবাদপত্র। সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা-
এ স্বাধীনতার নানা স্তর, তা নিয়ে দ্বিধা আর দ্বন্দ্ব, তর্কবিতর্ককে এক দৃশ্যগত ভিন্নমাত্রায়
অনুধাবনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে এ চিত্রকর্ম দুটি।
ফারজানা রহমান
ববির কাজেও প্রকৃতিই প্রধান উপজীব্য, তবে তা আশরাফুল হাসানের চিত্রকর্মের মতো কোনো
সরাসরি সংকটের বয়ান উপস্থাপন করে না। বরং প্রকৃতির বিমূর্ত সত্যকেই ববি মূর্ত করতে
চান তার মিশ্র মাধ্যমের কাজগুলোতে। ববির চিত্রকর্মগুলোর নির্মিত হয়ে ওঠার গল্পটিও যেন
তার চিত্রকর্মে উপস্থিতি থাকে। মাটি, হাওয়া, জলকে যেমন শুধু দৃশ্যগত উপাদান দ্বারা
অনুভব করা সম্ভব না, তেমনি এ চিত্রকর্মগুলোও অনুভূতির এক বিশেষ চাহিদার দাবি জানায়।
মিশ্র মাধ্যম অপেক্ষা ছাপচিত্রগুলোর গড়ন বেশ সুদৃঢ় আর সুস্পষ্ট। মিশ্র মাধ্যমের কাজগুলোতে
নানা ধরনের করণকৌশলের সমাহার ঘটেছে। মাটির গভীরে যেমন বৃক্ষ তার শেকড় বিস্তার করি,
ববির অনেক কাজেই এ বিস্তারের অনুভূমিক রূপ পরিলক্ষিত হয়।
এ প্রদর্শনীর
অন্যতম আকর্ষণ মাহমুদুর রহমান দীপনের কাজ। কারণ নব্বইয়ের দশকের চারুকলা অনুষদের বিখ্যাত
ছাত্র দীপন দীর্ঘদিন পর তার নতুন কাজ নিয়ে হাজির হয়েছেন দর্শকের সামনে। 'বিখ্যাত' এ
অর্থে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ছোট পুকুরটির মাঝে যে 'ত্রিভু' শীর্ষক
ভাস্কর্যটি রয়েছে তার নির্মাতা মাহমুদুর রহমান দীপন। 'ত্রিভু' নির্মাতা দীপন সম্ভবত
এবার তার চারকোলে করা নতুন চিত্রকর্মের জন্যও আলোচিত হবেন। দীপন এক অস্থির আঁধারের
গল্প বলেন আমাদের। এ অস্থিরতা তার অঙ্কনশৈলীর গুণে আরও তীব্রতা পেয়েছে। দীপনের চারকোলের
ব্যবহার অনুকূলের মতো কাব্যিক নয়। তিনি অনুসন্ধান করেন কাঠকয়লার নিকষ কালো সম্ভাবনার।
এ প্রদর্শনীর অন্যতম শক্তিশালী কাজ দীপনের ভয় নিকষ কালো এক বাক্সবন্দি অবয়ব যেন নিজের
জালে নিজেই বন্দি। বন্দির চোখ দুটো দেখে আমরা চমকে উঠতে বাধ্য- ভয়, অস্তিত্ব সংকট,
আজাহারি, আর্তি, আহ্বান বা অন্য কোনো অবর্ণনীয় বার্তা বাহক যেন ঐ দুটি চোখ। নানাবিধ
ব্যক্তিগত, সামাজিক, বৈশ্বিক সংকটের জালে আবদ্ধ যে কেউ হয়তো এ নিকষ আঁধারেও নিজের প্রতিবিম্ব
দেখে আঁতকে উঠতে পারেন। রসগোল্লা আর ভন ভন করা মাছি কাজটিও প্রতীকের গুণে সমকালীন বাস্তবতাকে
শক্তিশালীরূপে উপস্থাপন করে। যশোর রোড কাজটিও এক ঐতিহাসিক বাস্তবতার খোঁজ দেয়। তবে
এতসব শক্তিশালী চিত্রকর্মের পাশে দু’তিনটি চিত্রকর্ম কম প্রদর্শিত হলে হয়তো তা শিল্পীর
সার্বিক উপস্থাপনকে অধিক পরিশীলিত রূপ দান করত।
সুলেখা চৌধুরীর
চিত্রকর্ম বরাবরের মতো এবারও আখ্যানধর্মী। এ আখ্যানের কেন্দ্রীয় চরিত্র নারী। পাশাপাশি
প্রকৃতির সহাবস্থানও ঘটেছে শিল্পীর উপস্থাপনে। তবে প্রতীকায়নে তথাকথিত 'ঋণাত্মক অর্থদ্যোতক'
উপাদানসমূহ গতানুগতিক আরোপিত অর্থে ব্যবহূত হয়নি এখানে। দর্শকের গভীর পর্যবেক্ষণ এ
নতুন সত্য উন্মোচিত হবে হয়তো। কারণ কাক, সাপ এসব তথাকথিত অলক্ষণে, দুষ্ট প্রাণীকে তিনি
প্রকৃতির অংশ হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন, তাইতো সাপের মুখেও আমরা ফুল কিংবা দেয়াশলাইয়ের
কাঠি দেখতে পাই।
যারা ইমরান
হোসেন পিপলুর কাজের সঙ্গে পূর্বপরিচিত তাদের কাছে শিল্পীর নতুন কাজের আবেদন অধিক তীব্রতর
হবে বলে মনে হয়। 'মনোমন্থনে' এসে এক নতুন পিপলুর খোঁজ পাওয়া যায়। করোনাকালীন সময় সবার
জীবনে যে অপ্রত্যাশিত নানা পরিবর্তন এনে দিয়েছে তা দৃশ্যগত দলিল পিপলুর কাজ। ভাস্কর্য,
স্থাপনা কিংবা পারফরম্যান্স এ প্রকাশ ভঙ্গিগুলোর মাধ্যমেই তিনি শিল্পপরিসরে অধিক পরিচিত
ছিলেন। কিন্তু লকডাউনে প্রত্যাশিত শিল্প উপকরণের দুর্লভ্যতা তাকে ধাবিত করেছে গৃহ অভ্যন্তরে
সহজলভ্য ক্যানভাস আর গ্রাফাইট ব্যবহারে। লকডাউনে বিলাসিতা শীর্ষক পাঁচটি চিত্রকর্মে
নানা প্রতীকের সমারোহে তিনি নতুন বাস্তবতা হাজির করেছেন।
প্রদর্শনীতে
অংশ নেয়া প্রত্যেকেই চারুকলার ভুবনে রেখে চলেছেন মেধার স্বাক্ষর। নিরবচ্ছিন্নভাবে রং-তুলির
আঁচড়ে রাঙিয়ে তুলেছেন ক্যানভাস। রেখায় কিংবা কম্পোজিশনেও নিজস্বতার সাক্ষ্য দেয় তাদের
চিত্রপট। ক্রমাগত শিল্প-সৃষ্টির তাড়নায় সময়ের প্রগতিশীল এমনই সাত চিত্রকর যূথবদ্ধ হয়েছেন।
করোনাকালের বিবর্ণ সময়কে পাশ কাটিয়ে পুনরায় গতিময় হয়েছে তাদের শৈল্পিক পথচলা। আর সেই
সৃষ্টিসম্ভারকে তারা মেলে ধরেছেন এক আঙিনায়।
গত ১৪ মে
এই প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব মাসুদ বিন মোমেন। এসময় তিনি
বলেন, ‘শিল্পীদের প্রত্যেকেই হৃদয় থেকে উৎসারিত আবেগের আশ্রয়ে রাঙিয়েছেন ক্যানভাস।
প্রত্যেকেই নিজস্ব অনুভূতিকে মেলে ধরেছেন চিত্রপটে। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে এঁকেছেন বিচিত্র
বিষয়ের ছবি। আবেগের সমান্তরালে প্রতিটি কাজেই রয়েছে যত্নের ছোঁয়া। সব মিলিয়ে বৈচিত্র্যে
ভরপুর এই প্রদর্শনী। শিল্পকলার মূল কাজটি দর্শক কিংবা শিল্পরসিকের হৃদয়ে প্রশান্তি
ছড়িয়ে দেয়া। এই শিল্পীরা সেই কাজটিই দারুণ দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন। তিনি আরও
বলেন, সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের সম্প্রীতির এই বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে
বারংবার বিনষ্ট করছে অপশক্তি। সমাজ ও রাষ্ট্রে বিস্তার ঘটছে মৌলবাদের। রাজনৈতিক তৎপরতার
পাশাপাশি শিল্পের আশ্রয়ে এই অশুভ শক্তির মোকাবেলা করতে হবে। মানুষের মননশীলতা বিকাশের
মাধ্যমে সম্প্রীতি ও মুক্তচিন্তার সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।’
গ্যালারি
চিত্রকের নির্বাহী পরিচালক চিত্রশিল্পী মো. মনিরুজ্জামান জানান, এ্যাক্রেলিক, মিশ্র
মাধ্যম, ছাপচিত্র, চারকোলসহ নানা মাধ্যমের বিচিত্র বিষয়ের প্রায় ৭০টি চিত্রকর্ম উপস্থাপিত
হয়েছে এবারের আয়োজনে। প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রদর্শনী দর্শনার্থীদের
জন্য উন্মুক্ত। ১২ দিনব্যাপী এই প্রদর্শনী চলবে ২৫ মে পর্যন্ত।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh