অযত্নে ক্রমশই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে গৌরনদীর প্রাচীন স্থাপত্য। ছবিঃ মাসুদ সরদার
ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার নলচিড়া গ্রামে এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে ইংরেজ বিরোধী পলাশীর যুদ্ধের কামানের ধ্বংশ লীলা। তেমনি কালের স্বাক্ষী হয়ে বংকুরা গ্রামে দাড়িয়ে রয়েছে সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলের কৃতিমাণ পুরুষ ছবি খাঁর হুজরা ও উত্তর শিহিপাশা গ্রামের শতীদাহ মঠ। যুগ যুগ পেরিয়ে গেলেও এসব ঐতিহাসিক নির্দশন রক্ষনা বেক্ষনের জন্য এখনো নেয়া হয়নি কোন উদ্যোগ। আর রক্ষনা-বেক্ষনের অভাবেই ক্রমশই ধ্বংশ হয়ে যাচ্ছে কালের স্বাক্ষী এসব নির্দশনগুলো। রক্ষনা বেক্ষনের মাধ্যমে এসব ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো হতে পারে একটি পর্যটন কেন্দ্র।
বিভিন্ন ইতিহাসবীদের লেখা বই ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১৬’শ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাট আকবরের শাসনআমল থেকে পরবর্তী প্রায় ৬৬ বছর তৎকালীন বাকলার (বর্তমান বরিশাল)’এ মগ সম্প্রদায় যুদ্ধ করেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কথিত মতে তৎকালীন সময়ে মগের জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতনসহ ত্রাসের রাজত্বে বাকলার আকাশে কোন পাখি পর্যন্ত উড়েনি। মোঘল সেনারাও অসংখ্যবার মগের সাথে যুদ্ধ করে পরাজিত হয়। সম্রাট আকবরের পরবর্তী সময় সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে কিংকর ভূঁইয়ার পুত্র মদন মোহন ও ছবি খাঁকে বাকলার ফৌজদার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ছবি খাঁ বাকলার ফৌজদার হিসেবে নিযুক্ত হবার পর নিজের নেতৃত্বে নিজেই গড়ে তোলেন বিশাল সেনা সৈন্যের দল। এক পর্যায়ে তিনি (ছবি খাঁ) মগের বিরুদ্ধে শেষবারের মতো যুদ্ধ ঘোষনা করেন। ছবি খাঁর সেই যুদ্ধে বাকলার থেকে মগদের বিতারিত হতে হয়।
যুদ্ধপরবর্তী সময়ে কৃতিমান পুরুষ বাকলায় ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ করেন। যার প্রেক্ষিতে ছবি খাঁর নামানুসারে অসংখ্য রাস্তা, জাঙ্গাল, পুল, দিঘীসহ ঐতিহাসিক নিদর্শন আজো রয়েছে বিদ্যমান। সূত্রমতে, কৃতিমান পুরুষ ছবি খাঁ শেষ বয়সে আধ্যাত্মিক সাধনা করার জন্য তৎকালীন জনমানব শূণ্য নিরবিছিন্ন বর্তমান বংকুরা গ্রামে হুজরা (ইবাদত খানা) নির্মান করে সৃষ্টিকর্তার অপারধ্যানে মগ্ন ছিলেন। বর্তমানে হুজরাকে সামনে রেখে স্থানীয়রা একটি জামে মসজিদ নির্মান করেছেন। ওই মসজিদের ইমাম স্থানীয় বলেন, কৃতিমাণ পুরুষ ছবি খাঁর হুজরাকে সামনে রেখে আমি মহান সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করছি।
পলাশীর যুদ্ধের কামানের ধ্বংশ লীলাঃ ১৭৫৭ সালে ইংরেজ বিরোধী পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ- উদ-দৌলা শহীদ হবার পর তার পরাজিত সৈন্যরা জমিদার সৈয়দ ইমাম উদ্দিনের পরিচালনাধীন সরিকলের দূর্গে আশ্রয় নেন। অন্যান্য জমিদাররা ইংরেজদের সাথে আতাত করলেও তৎকালীন নাজিরপুর পরগনার (বর্তমান নলচিড়া) জমিদার সৈয়দ ইমাম উদ্দিন ইংরেজদের সাথে আতাত না করে তাদের (ইংরেজদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেন। এক পর্যায়ে সরিকল নদীতে ইমাম উদ্দিনের সৈন্যদের সাথে ইংরেজ সৈন্যদের যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে অনেক ইংরেজ সৈন্য নিহত হয়। পলাশীর যুদ্ধের পরেও মোগল নৌ- সেনাপতি উলফৎ গাজীর বংশধর জমিদার ইমাম উদ্দিন দীর্ঘ ২২ বছর নাজিরপুর পরগনার স্বাধীনতা
টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হন। ১৭৭৯ সালে সরিকল নদীতে ইংরেজ সৈন্যদের সাথে জমিদারের সৈন্যদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে সরিকল দূর্গের পতনের পর ইংরেজ সৈন্যরা নলচিড়া মিয়াবাড়িতে আক্রমনের প্রস্তুতি নেয়। জমিদার সৈয়দ ইমাম উদ্দিনও পাল্টা আক্রমনের প্রস্তুতি নেয়। এক পর্যায়ে গর্ভনর জেনারেল ওয়ারেন হেষ্টিং সৈয়দ ইমাম উদ্দিনকে বন্দি করতে সক্ষম হন। সৈয়দ ইমাম উদ্দিনের সেই যুদ্ধের কামানের ধ্বংশ লীলা আজো কালের স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে।
শতীদাহ মঠঃ হিন্দু ধর্মের বেদ অনুসারে হাজার-হাজার বছর ধরে শতিদাহ প্রথা (স্বামী মারা গেলে তার সাথে জিবীত স্ত্রীকে শ্মশানে পুরিয়ে দেয়া) বিধান প্রচলিত ছিলো। এ প্রথার অবসান ঘটে ১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসনামলে রাজা রাম মোহন রায় ও ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যা সাগরের বিধান বলে। শতীদাহ ঘটনার ঐতিহাসিক নিদর্শন আজো কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বর্তমান আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের উত্তর শিহিপাশা গ্রামে।
কবে কখন কোন শতী স্ত্রীকে স্বামীর সাথে ওই শ্মশানে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, তার কোন সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও স্থানীয়রা জানান, ওই সম্পত্তির পূর্ব দলিল ও কাগজপত্র পর্যালোচনা করে এই বাড়িতে রুহিনী ঠাকুর নামের একজন বসবাস করতেন বলে পাওয়া যায়। তিনি আরো জানান, রুহিনী ঠাকুর অথবা তার পূর্বপুরুষের কেউবা হয়তো শতীদাহ শ্মশানে কারুকার্য খচিত মঠটি নির্মান করেছেন। কারুকার্য খচিত মঠটি অযত্ন অবহেলায় আজ র্ধ্বংশ হয়ে যাচ্ছে।
প্রায়ই দেশের দূর-দুরান্তসহ সূদুর ভারত থেকেও শতীদাহ মঠটি দেখার জন্য লোকজন যাওয়া আসা করছেন। তারা স্থানীয়রা আরো জানান, অতিসম্প্রতি দখলদার শতীদাহ মঠের আংশিক অংশ ভেঙ্গে
ফেলেছেন। ইতিহাস ঐতিহ্য সমৃদ্ধ বৃহতি গৌরনদীবাসী এসব ঐতিহাসিক নির্দশনগুলো রক্ষনা বেক্ষনের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh