ছবিঃ সংগৃহীত
আরেকটি নতুন বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা ফিরে দেখি বিগত বছরের অর্জন, আনন্দ আর প্রাপ্তিগুলো। তবে এই পথচলায় কিছু অপূরণীয় ক্ষতিও আমাদের ভারাক্রান্ত করেছে। ২০২৪ সালে শোবিজ অঙ্গন হারিয়েছে এমন কিছু নক্ষত্রকে, যারা নিজেদের প্রতিভা, কর্ম আর ব্যক্তিত্ব দিয়ে আমাদের জীবনে গভীর প্রভাব রেখেছেন।
তারা ছিলেন বিনোদন দুনিয়ার অনন্য অধ্যায়, যাদের অবদান আমরা কখনো ভুলতে পারব না। নতুন বছরের আগমনের এই মুহূর্তে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সেই তারকাদের, যাঁরা ২০২৪ সালে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু তাঁদের কাজ ও স্মৃতি চিরকাল আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে।
গীতিকবি জাহিদুল হকঃ ১৫ জানুয়ারি মারা যান ষাটের দশকের কবি, গীতিকার জাহিদুল হক। মত্যুকালে তার বয়স ছিল ৭৫ বছর। সঙ্গীত শিল্পী সুবীর নন্দীর কণ্ঠে তাঁর লেখা 'আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়' গানটি দেশজুড়ে বেশ জনপ্রিয়তা পায়।
মঞ্চ, টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্র তিন মাধ্যমেই সমান জনপ্রিয় ছিলেন এই গুণী অভিনেতা। সেলিম আল দীনের ‘ঢাকা থিয়েটার’ থেকে আহমেদ রুবেলের অভিনয় যাত্রা শুরু হয়। তার অভিনীত প্রথম নাটক ‘স্বপ্নযাত্রা’। এরপর ১৯৯৩ সালে ‘আখেরী হামলা’ সিনেমার মাধ্যমে রুপালি পর্দায় অভিষেক হয় আহমেদ রুবেলের।
নির্মাতা শিল্পী চক্রবর্তীঃ নির্মাতা শিল্পী চক্রবর্তী রক্তক্ষরণ জনিত কারণে ৭ মার্চ মারা যান। মৃত্যুকালে নির্মাতার বয়স ছিলো ৭১ বছর। শিল্পী চক্রবর্তী 'বিনি সুতার মালা', 'আমার আদালত', 'তোমার জন্য পাগল', 'সবার অজান্তে', 'চরমপত্র', 'মীমাংসা' সিনেমা নির্মাণ করেছেন।
সংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদঃ প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদ ২০২৪ সালের ১৩ মার্চ মারা যান। অজানা এক অভিমানে আত্মহত্যা করেন এই গুণী সংগীতশিল্পী। সাদি মহম্মদের জন্ম ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর। তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুরে বেড়ে উঠেন। বাবা-মায়ের ইচ্ছায় ১৯৭৩ সালে বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন সাদি। গানের প্রতি প্রবল টান থাকায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে ১৯৭৬ সালে পাড়ি জমান শান্তিনিকেতন। এরপর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্র সংগীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
২০০৭ সালে ‘আমাকে খুঁজে পাবে ভোরের শিশিরে’ অ্যালবামের মাধ্যমে সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সাদি মহম্মদ। তার প্রথম অ্যালবাম ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’। ২০০৯ সালে ‘শ্রাবণ আকাশে’ ও ২০১২ সালে ‘সার্থক জনম আমার’ অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। তার প্রকাশিত অ্যালবামের সংখ্যা ষাটের অধিক। সাদি মহম্মদকে ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র পুরস্কার প্রদান করে।
কণ্ঠশিল্পী খালিদঃ 'হয়নি যাবারও বেলা', 'সরলতার প্রতিমা', 'আবার দেখা হবে'র মতো অসংখ্য গানের শিল্পী খালিদ মারা যান ১৮ মার্চ। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর।
খালিদের কণ্ঠে উল্লেখযোগ্য গানের মধ্য রয়েছে- যতোটা মেঘ হলে বৃষ্টি নামে, আকাশের বুকে সরলতার প্রতিমা', 'কোনো কারণেই ফেরানো গেল না তাকে', 'হয়নি যাবার বেলা', 'যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে', 'তুমি নেই তাই, আকাশলীনা'গানগুলো।
অভিনেতা অলিউল হক রুমিঃ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২২ এপ্রিল মারা যান অভিনেতা অলিউল হক রুমি। ক্যানসার জয় করে আগের মতো অভিনয়ে ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফেরা হয়নি তার।
ব্যান্ড সংগীতশিল্পী তানভীর আহসান পিয়ালঃ এ বছরের ১১ মে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ‘অড সিগনেচার’ ব্যান্ডের ভোকালিস্ট ও গিটারিস্ট তানভীর আহসান পিয়াল। মাত্র ২৬ বছর বয়সেই তিনি চলে যান না ফেরার দেশে।
২০১৭ সালে যাত্রা করেছে অড সিগনেচার, বিশেষ করে তরুণ শ্রোতাদের মধ্যে ব্যান্ডটির বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে। এই ব্যান্ডের ‘আমার দেহখান’ গানটি অড সিগনেচার ব্যান্ডের অনুরাগীদের ছাপিয়ে সাধারণ মানুষের মুখে মুখেও ফেরে। গানটি লিখেছেন মুনতাসির রাকিব।
২০১৯ সালে ব্যান্ডটির প্রথম গান ‘ঘুম’ প্রকাশিত হয়েছে। এর বাইরে ‘প্রস্তাব’, ‘দুঃস্বপ্ন’, ‘মন্দ’ শিরোনামের গানগুলোও শ্রোতাদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে।
অভিনেত্রী সীমানাঃ অভিনেত্রী রিশতা লাবনী সীমানা ৪ জুন সকাল ৬টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। শোবিজে সীমানার পথচলা শুরু হয় ২০০৬ সালে লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। এরপর থেকে তিনি নাটক, বিজ্ঞাপনে নিয়মিত কাজ করছিলেন। দেখা গেছে সিনেমায়ও।
ব্যান্ড তারকা শাফিন আহমেদঃ ২৫ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে মারা যান জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকা শাফিন আহমেদ। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। মত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।
মাইলস ব্যান্ডের ভোকাল ও বেজ গিটারিস্ট শাফিন আহমেদের কন্ঠে শ্রোতাপ্রিয় গানের তালিকায় একক অ্যালবাম ও ব্যান্ডের গানের তালিকায় রয়েছে 'চাঁদ তারা সূর্য', 'প্রথম প্রেমের মতো', 'গুঞ্জন শুনি', 'সে কোন দরদিয়া', 'ফিরিয়ে দাও', 'ধিকি ধিকি' প্রভৃতি।
কণ্ঠশিল্পী জুয়েলঃ কণ্ঠশিল্পী হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল ৩০ জুলাই সকালে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান। সংগীতশিল্পী, নির্মাতা ও সঞ্চালক হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল। ১১ বছর ধরে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন তিনি।
হাসান আবিদুর রেজা জুয়েলের প্রথম অ্যালবাম 'কুয়াশা প্রহর' প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় 'এক বিকেলে', 'আমার আছে অন্ধকার', 'একটা মানুষ', 'দেখা হবে না', 'বেশি কিছু নয়', 'বেদনা শুধুই বেদনা', 'ফিরতি পথে', 'দরজা খোলা বাড়ি' ও 'এমন কেন হলো'। তার 'এক বিকেলে' অ্যালবামটি সবচেয়ে আলোচিত ছিল।
অভিনেতা জামাল উদ্দিন হোসেনঃ একুশে পদকপ্রাপ্ত জামাল উদ্দিন হোসেন টেলিভিশন ও মঞ্চ নাটকের অভিনেতা ১২ অক্টোবর মারা গেছেন। কানাডার ক্যালগিরিতে মারা যান তিনি। মৃত্যুকালে এই অভিনেতার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।
জামাল উদ্দিন হোসেন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় ছেড়ে একসময় প্রতিষ্ঠা করেন নাগরিক নাট্যাঙ্গন অনসাম্বল। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন তিনি।
সুরকার ও সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যামঃ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগীতযোদ্ধা, সুরকার ও সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যাম মৃত্যুবরণ করেন ১৭ অক্টোবর। সংগীতে অবদানের জন্য তিনি ২০১৮ সালে একুশে পদক এবং এর আগে ২০১৫ সালে পান শিল্পকলা পদক।
সুজেয় শ্যাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন। তার করা উল্লেখযোগ্য গানগুলোর মধ্যে আছে- 'বিজয় নিশান উড়েছে ওই', 'রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি', 'রক্ত চাই রক্ত চাই', 'আহা ধন্য আমার জন্মভূমি', 'আয়রে চাষি মজুর কুলি', 'মুক্তির একই পথ সংগ্রাম', 'আহা ধন্য আমার জন্মভূমি', 'আয় রে চাষি মজুর কুলি', 'মুক্তির একই পথ সংগ্রাম'।
কণ্ঠশিল্পী মনি কিশোরঃ চলতি বছর অক্টোবরে মারা যান ৯০ দশকের দর্শকপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মনি কিশোর। ১৯ অক্টোবর রাজধানীর রামপুরার বাসা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ২৪ অক্টোবর কণ্ঠশিল্পী মনি কিশোরের দাফন সম্পন্ন হয়।
মনি কিশোরের উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে আছে—'কী ছিলে আমার বলো না তুমি', 'আমি মরে গেলে', 'ফুল ঝরে তারা ঝরে', 'মুখে বলো ভালোবাসি', 'আমি ঘরের খোঁজে'।
অভিনেতা মাসুদ আলী খানঃ একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রবীণ অভিনেতা মাসুদ আলী খান মারা গেছেন ৩১ অক্টোবর। মৃত্যুকালে মাসুদ আলী খানের বয়স ছিল ৯৫ বছর। মাসুদ আলী খান ১৯৫৬ সালে এ দেশের প্রথম নাটকের দল ড্রামা সার্কেলের সঙ্গে যুক্ত হন। সেই থেকে অভিনয়ে ব্যস্ততা বেড়ে যায়। ৫ দশকেরও বেশি সময় টানা অভিনয় করেছেন তিনি।
মাসুদ আলী খানের অভিনীত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সিনেমা হচ্ছে 'দুই দুয়ারি, দীপু নাম্বার টু, মাটির ময়না। তার অভিনীত আলোচিত কয়েকটি নাটক হচ্ছে কূল নাই কিনার নাই, এইসব দিনরাত্রি, কোথাও কেউ নেই
গীতিকবি আবু জাফরঃ বছরের শেষের দিকে আমরা হারাই বিখ্যাত গীতিকার, সুরকার ও শিক্ষক আবু জাফরকে। তিনি মারা যান গত ৫ ডিসেম্বর। আবু জাফর রাজশাহী ও ঢাকা বেতার এবং টেলিভিশনের নিয়মিত সংগীতশিল্পী ও গীতিকার ছিলেন।
আবু জাফর রচিত উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে 'তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম', 'নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে', 'আমি হেলেন কিংবা মমতাজকে দেখিনি' ও 'তুমি রাত আমি রাতজাগা পাখি।
তার লেখা 'এই পদ্মা এই মেঘনা' গানটি বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০টি গানের মধ্যে স্থান পেয়েছে।
রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ারঃ রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ার ১২ ডিসেম্বর সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থান মারা যান গুণী এই শিল্পী। একুশে পদকজয়ী রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ার। দীর্ঘদিন ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন ।
নাই টেলিফোন নাইরে পিয়ন নাইরে টেলিগ্রাম' গানটি তাকে শ্রোতাদের কাছে আরও বেশি পরিচিত করেছিল। পাপিয়া সারোয়ার ২০২১ সালে একুশে পদক পান।
নির্মাতা সি বি জামানঃ 'উজান ভাটি' খ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সি বি জামান মারা গেছেন ২০ ডিসেম্বর। চলতি মাসে হার্ট অ্যাটাকের পর থেকেই আইসিইউতে ছিলেন তিনি।
সিবি জামান নির্মিত সিনেমার মধ্যে রয়েছে ঝড়ের পাখি, উজান ভাটি, লাল গোলাপ, কুসুম কলি, সুভরাত্রি, দিন যায় কথা থাকে, হিসাব নিকাশ, পুরস্কার।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh