তারাই মানুষ, তারাই দেবতা,/ গাহি তাহাদেরি গান,/
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে/ আসে নব উত্থান! /
যাদের শ্রম ঘাম দিয়ে গড়া হল সুরম্য অট্টালিকা, সেই অট্টালিকার
তেতালার উপরে তুমি শুয়ে থাকবে আর আমরা শ্রমিকরা থাকব তার নিচে, আর তুমি ভাববে
তোমারে কেবল দেবতা জ্ঞান করব, সে ভরসা আজ মিছে!
জেনে রেখ তোমার মত এমন ভণ্ড দেবতার থেকে তারাই উত্তম
সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন/ মাটির মমতা-রসে /
এই ধরণীর তরণীর হাল রবে/ তাহাদেরি বশে!/
বিশ্বকবি কাজী নজরুল ইসলাম এভাবেই করেছেন শ্রমজীবী মানুষের বন্দনা।
আজ সেই শ্রমজীবী মানুষেরই একটি দিবস যা বিশ্বে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বজন গৃহীত মহান মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে প্রতি বছর এদিনটি আমাদের সামনে হাজির হয়। হাজির হয় কর্ম বিরতি নিয়ে, জাতীয় ছুটি নিয়ে। আর হাজির হয় শ্রমিকের অধিকারের বার্তা নিয়ে। হাজির হয় যাদের শ্রমে ঘামে তৈরি তৈরি এই মানবসভ্যতা তাদের মানবাধিকার নিয়ে।
সময়টা ১৮৭৫ সাল। পেনসালভানিয়ার কয়লাখনির কিছু শ্রমিক। অসংগঠিতই বলা যায়। সে অবস্থায় তারা জ্বলে উঠল নিজেদের দাবির স্বপক্ষে। তারা উপলব্ধি করল শ্রম ও শ্রমজীবীর মুক্তির জন্য গর্জে ওঠতে হবে নিজেদেরই। তাদের সেদিনের সে স্ফুলিঙ্গ পরিণত হয় দাবানলে। আর তা ছড়িয়ে পড়ল আমেরিকার শিকাগো শহরে। সে দাবানলে পুড়তে থাকল শিকাগোর হ্যা মার্কেটের আভিজাত্যের দম্ভ।পুলিশের গুলিতে নিরীহ শ্রমিকরা আত্মদান করল।
সেটি ১৮৮৬ সালে ১ মে। এরপরের ইতিহাস সারা পৃথিবীর জানা। ১ মে ক্রমান্বয়ে শ্রমজীবী মানুষের দাবি আদায়ের মহান দিবস হিসেবে আবির্ভূত হলো। বিশ্বজুড়ে পালিত হতে থাকল মে দিবস। মে দিবসের সেদিনের আওয়াজ ছিল ন্যায্যতার পক্ষে। মানবিকতার পক্ষে। সেটি শুধু কর্ম ঘন্টা নির্ধারণের দাবি বললে বিষয়টি একপেশে হয়ে যাবে। শ্রমিকদের দাবিটা মূলত ছিল, মানুষের মত বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদাগুলো আদায়ের স্বপক্ষে। মানবিকতার দাবি ছিল দানবের বিপক্ষে, পাষাণের বিপক্ষে।
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শহিদ শ্রমিকদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করতে পালিত হয় এই দিবস। সে দিন দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে শ্রমিকরা হে মার্কেটে জমায়েত হয়। তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি বোমা নিক্ষেপ করে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি। পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। আর পুলিশের এই গুলিতে প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়।
দিবস
১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত শ্রমিক সম্মেলনে ১লা মে শ্রমিক দিবস ঘোষণা করা হয়। আর এ ঘোষণার পরের বছর থেকেই ১ মে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টির বেশি দেশে মে দিবস সরকারি ছুটির দিন। এছাড়া বেশ কিছু দেশে বেসরকারিভাবেও পালিত হয় শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিবসটি।
১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে রক্তাক্ত আন্দোলনে শ্রমিকের ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আত্মাহুতি দেওয়া বীর শ্রমিকদের স্মরণে এ দিনটি ওই বছর থেকে উদযাপন করা হয়।
শ্রমিকের রক্ত-ঘামে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক মে দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় দেশে ও বিদেশে আজও উদযাপন করা হবে। এ বছর মে দিবসের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি।’
মে দিবস উপলক্ষে আলাদা আলাদা বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল শ্রমজীবী মানুষকে শুভেচ্ছা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দিনটি উপলক্ষে গৃহীত সকল কর্মসূচির সফলতা কামনা করেছেন।
এদিকে, বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এবারের মহান মে দিবস পালন করা হবে বলে জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম চৌধুরী। গতকাল মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) সচিবালয়ে মন্ত্রণালয় সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে সেই কর্মসূচি তুলে ধরেন তিনি।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ১ মে বেলা ১১টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মে দিবস ২০২৪ পালন উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
এছাড়াও অনুষ্ঠানে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন ও কেন্দ্রীয় তহবিল হতে দুঃস্থ শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তার চেক প্রদান করা হবে। আলোচনা সভা শেষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। মে দিবসের অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দপ্তর-সংস্থার মাঠ পর্যায়ের কার্যালয়সমূহকে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে এ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মে দিবস পালনে বিভিন্ন সড়কদ্বীপ ব্যানার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড দিয়ে সজ্জিত করা হবে।
মে দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে এবারও একটি তথ্যবহুল এবং দৃষ্টিনন্দন স্মরণিকা প্রকাশ করা হবে। অধিকন্তু মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরার জন্য ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হবে।
কিন্তু এখানে একটা মজার বিষয় হল, যে যুক্তরাষ্ট্রে ‘মে দিবস’ তারাই পালন করে না আন্তর্জাতিক এই দিবস। একই বিষয় কানাডার ক্ষেত্রে। তবে তারা সেপ্টেম্বর মাসে শ্রমিক দিবস পালন করে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় শ্রমিক ইউনিয়ন এবং শ্রমের নাইট এই দিবস পালনের উদ্যোক্তা। হে মার্কেটের হত্যাকাণ্ডের প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড মনে করেছিলেন ১ মে যেকোনো আয়োজন হানাহানিতে পর্যবসিত হতে পারে। সেজন্য তিনি ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে নাইটের সমর্থিত শ্রম দিবস পালনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন।
স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশে মে দিবস সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দিবসটির প্রধান দাবি ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস, সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হলেও বেসরকারি খাতে এখনও ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবসের সুফল পায়নি।
নিম্ন মজুরির ফাঁদে শ্রমজীবী মানুষকে আটকে ফেলা হয়েছে। শ্রমিকরা এখন বাধ্য হয় ওভার টাইম করতে। কারণ তা না করলে সংসার চালানো অসম্ভব।
প্রতি বছর মে দিবসে আমরা সকলেই যেন দিবসটি পালন করি সরকারি ছুটি হিসেবে। শ্রমজীবী মানুষ, শ্রমিক সংগঠনসমূহ মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে অনেকটা দায়সারাভাবে দিবসটি পালন করে থাকে। দেখে মনে হয় এ যেন উৎসব, অধিকার প্রতিষ্ঠার চেতনা এখানে নেই বললেই চলে। ফলে দরিদ্র দরিদ্রই থেকে যায়।
তাইতো কবির ভাষায়,
হে দারিদ্র্যতা
প্রতি মুহূর্তে আমার স্বপগুলো তুমি ভেঙে দাও
বাস্তবতায় আমি যখন ডুব সাঁতারে ভাসতে ভাসতে
স্রোতের কিনারে ডুবতে ডুবতে
যন্ত্রণার নীলগিরিতে ভিড়ায় কোনো নাও
তুমি শকুনি চিলেকোঠা থেকে তখনই আমার সর্বাংশে
দংশনে দংশনে বিষবাষ্পের মহাপ্রলরূপে হাজির হও।
তোমার ঐতিহ্যের মোহময়তায় আমি মজলুম
নিদারুণ দুর্বলে কোণঠাসা এক মানবাত্মা মাছুম।
আর ঐতিহাসিক এই মে দিবসের প্রায় দেড়শ বছর পরেও এ কথা বলতে হচ্ছে যে যে শ্রমিকের রক্তে ঘড়ে ওঠে সুরম্য প্রাসাদ তথা জীবন, জীবীকা ও ধনীর বিলাসীতা সেই শ্রমিকের দিবস পালনের নামে এখন নামসর্বস্ব আনুষ্ঠিকতা ছাড়া যেন কিছুই না। ফলে তথাকথিত দিবসপালন ও উৎসব-অনুষ্ঠানের চাপে দারিদ্র্যের কষাঘাতে চিড়ে চেপটা হচ্ছে মানবাত্মা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মে দিবস পালন এখন শুধুই কালচার ও সংস্কৃতির অংশ। যা পালন করবে সেই ধণীক শ্রেণিই। যেন এখানেও গরিবের নেই কোনো হক। নেই কোনো অধিকার।
মজলুম জনতা এখানে নিপীড়িত, নিষ্পেসিত। আর খেটে খাওয়া এসব মজলুম জনতার কোনো অধিকার নেই বলেই প্রাণঘাতী মহামারি করোনাভাইরাস, ডেঙ্গু আর বর্তমান সময়ে স্মরণাতীতকালে মধ্যে তীব্র রেকর্ড তাপদাহের মধ্যে হাজারো শ্রমিককে চাকরি হারাতে হচ্ছে। খোদ গণমাধ্যমকর্মীরাও এর থেকে দূরে নেই। কলকারখানার শ্রমিকদের মতো সাংবাদিক তথা গণমাধ্যমকর্মীরাও যেন হেই প্রতিপন্ন হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের কাছে। নীরবে, নিভৃতে দারিদ্র্যের কষাঘাতে অসহায়ত্বের জীবনযাপন করছে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের সুখ-দুঃখের কথা তুলে ধরা সেই সংবাদকর্মীরাও। কেননা পরিস্থিতি বিবেচনায় ধনীদের শঠতায় সাংসাদিকেরা এখন দারিদ্র্যের কাতারে নিম্নস্তরে অবস্থান করছে। যেন এই দরিদ্র অবস্থা থেকে বের হবার কোনো উপায় নেই। নেই কোনো দাবি-দাওয়া, অধিকার।
মনে হয় ঘুনেধরা এই সমাজে তথা এই বিশ^চরাচরে শ্রকিদের কোনো অধিকার থাকতে নেই। আর অধিকার নেই বলেই শুধু চাকরি বাঁচানোর জন্য, শুধু বেতনের জন্য, শুধু দুবেলা খেয়ে পরে বাঁচার তাগিদে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে রাজধানীতে থাকতে হচ্ছে। অধিকার নেই বলেই শত স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে তাদের কাজ করতে হয়, শ্রমে ঘামে তৈরি করে যেতে হয় নিষ্ঠুর এ সভ্যতা। এ যেন শ্রমিকের রক্তে লেখা সভ্যতার এক নতুন ইতিহাস।
লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh