সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে বাংলাদেশে এসে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহম্মদ ইউনূসের বিচারকার্যক্রম পর্যবেক্ষণের অনুরোধ জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ খুরশীদ আলম খান। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে দুদক আইনজীবী বলেন, শ্রম আদালতে এলেই বুঝতে পারবেন ড. ইউনূস শ্রমিকদের সঙ্গে কি করেছেন। না দেখে সমালোচনা করাটা আমাদের সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমি কথা দিচ্ছি আপনি (হিলারি ক্লিনটন) এলেই সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো। আপনি যে কাগজপত্র চাইবেন সব দেবো। শ্রম আদালত এবং হাইকোর্টের রায়ের কপি দেখাবো আপনাকে। সব কিছু দেখে পর্যবেক্ষণ করে আপনি আলোচনা-সমালোচনা করুন। না বুঝলে আপনি দুজন এক্সপার্ট নিয়ে আসুন। তারপর আপনার সিদ্ধান্ত দেন। দুদকের আইনজীবী আরও বলেন, কোনো কিছু না জেনে শুধুমাত্র আবেগের বশবর্তী হয়ে পর্যবেক্ষণ দেওয়া আমি মনে করি আপনার মতো একজন বিশ্বনেত্রীকে মানায় না। এর আগে মঙ্গলবার এক টুইট বার্তায় ড. ইউনূসের পাশে দাঁড়াতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানান হিলারি ক্লিনটন। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো ১৬০ জনের বেশি বিশ্বনেতার বিবৃতিটি সংযুক্ত করেন।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বর্তমান বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত ও সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রী বরাবর ১০০ জনেরও বেশি নোবেল বিজয়ীসহ ১৬০ জনেরও বেশি বিশ্বনেতা একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। এর আগে গত মার্চ মাসে, ৪০ জন বিশ্বনেতা একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন যাতে প্রধানমন্ত্রীকে তাদের ভাষায় সবচেয়ে দক্ষ এবং প্রশংসিত নাগরিকদের একজনের বিরুদ্ধে এই বিবেকহীন প্রচারণা বন্ধ করতে বলা হয়। ৩১ আগস্ট ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচারিক কাজ শুরু হওয়ার কারণে ১০০ জনেরও বেশি নোবেল বিজয়ীসহ ১৬০ জনেরও বেশি বিশ্ব নেতা একটি নতুন চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। ২৭ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি সমর্থন জানিয়ে চিঠি লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তার একদিন পরই ১৬০ জন বিশ্ব নেতার চিঠি নিয়ে আবারও আলোচনায় ড ইউনূস ও আসন্ন নির্বাচন।
এর আগে চলতি বছরের মার্চ মাসে বাংলাদেশ সরকারের আচরণের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে চলতি বছরের মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে খোলাচিঠি লিখেছিলেন রাজনীতি, কূটনীতি, ব্যবসা, শিল্পকলা ও শিক্ষাক্ষেত্রের ৪০ জন বিশ্বনেতা। ওই খোলাচিঠির ধারাবাহিকতায় এবার ১৬০ জন বিশ্বনেতা ফের চিঠি পাঠালেন। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় আগের ৪০ জনের বিৃবতি সংগ্রহ ও আদায় করার জন্য ২ মিলিয়ন (২২) লাখ টাকা নিয়েছিলেন একটি কোম্পানী এবার সেই খরচ গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২০ মিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশী টাকায় ২২ কোটি টাকারও বেশি (১১০ টাকা=১ ডলার)।
১৬০ জন বিশ্ব নেতার মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস-হোর্তা প্রেসিডেন্ট, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুনের মতো ব্যক্তিত্ব। ওই চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের একজন, রেজাল্টস অ্যান্ড সিভিক কারেজের প্রতিষ্ঠাতা স্যাম ডেলি-হ্যারিস এক বিজ্ঞপ্তিতে চিঠিটি প্রকাশ করেছেন।
চিঠির শুরুতে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’ সম্বোধন করে লেখা হয়েছে- আমরা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, নির্বাচিত কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের নেতার পাশাপাশি বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে লিখছি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে আপনাদের জাতি যেভাবে প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে আমরা তার প্রশংসা করি।
কিন্তু, সম্প্রতি বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি যে হুমকি দেখেছি তাতে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা বিশ্বাস করি, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া এবং নির্বাচনে প্রশাসন দেশের সব বড় দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগের দুটি জাতীয় নির্বাচনে বৈধতার অভাব ছিল।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে মানবাধিকারের প্রতি যে হুমকি আমাদের উদ্বিগ্ন করে তা হলো- নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের মামলা। আমরা উদ্বিগ্ন, সম্প্রতি তাকে টার্গেট করা হয়েছে। এটা ক্রমাগত বিচারিক হয়রানি বলেই আমাদের বিশ্বাস। এর আগে ৪০ জন বিশ্বনেতা তার নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে আপনার কাছে যে আবেদন করেছিলেন এই চিঠিটি তার ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলারই চেষ্টা।
আমরা বিনীতভাবে অনুরোধ করছি, আপনি অবিলম্বে অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে বর্তমান বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত করুন। তারপর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইন বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা রাখার সুযোগসহ আপনার দেশের মধ্য থেকে নিরপেক্ষ বিচারকদের একটি প্যানেল দ্বারা অভিযোগের পর্যালোচনা করা হবে। আমরা নিশ্চিত, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতিবিরোধী এবং শ্রম আইনের মামলাগুলোর যে কোনো পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার করলে তিনি খালাস পাবেন। আপনি জানেন, ‘কীভাবে সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ আন্তর্জাতিক অগ্রগতির জন্য একটি শক্তি হতে পারে’- এ নিয়ে প্রফেসর ইউনূসের কাজ আমাদের সবার জন্য অনুপ্রেরণামূলক।
চিঠির সমাপ্তি টানা হয়েছে এভাবে ‘আমরা আশা করি, আপনি এই আইনি সমস্যাগুলোর সমাধান একটি সমীচীন, নিরপেক্ষ এবং ন্যায়সংগত পদ্ধতিতে নিশ্চিত করবেন। এর পাশাপাশি আসছে দিনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন এবং সব ধরনের মানবাধিকারের প্রতি সম্মান (প্রদর্শন) নিশ্চিত করবেন। সামনের দিনগুলোতে কীভাবে এই বিষয়গুলোর সমাধান করা হয় তা ঘনিষ্ঠভাবে নজরে রাখার জন্য আমরা বিশ্বের লাখ লাখ উদ্বিগ্ন নাগরিকদের শিবিরে যোগ দেব’।
ইউনূসের বিচার স্থগিত চাওয়ায় বিশিষ্টজনের প্রতিবাদ করেছেন আমাদের সচেতন সমাজ
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান বিচার প্রক্রিয়া স্থগিতের দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের লেখা খোলা চিঠির প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশের ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ৮৬৬ জন শিক্ষক, ৫০ জন সম্পাদক, ১৭১ জন বিশিষ্ট নাগরিক ও ১৩টি জাতীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন। পৃথক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ চিঠি দেশের সার্বভৌমত্ব ও বিচার বিভাগের ওপর হুমকি। একই সঙ্গে বেআইনি ও অনভিপ্রেত বক্তব্য। এই ‘অযাচিত হস্তক্ষেপে’ উদ্বেগ জানিয়ে এটি দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কি না, তা খতিয়ে দেখার আহ্বান জানানো হয়েছে।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবেদ খান, ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, শিল্পী হাশেম খান, শিল্পী রফিকুন নবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাসান ইমাম, সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত, কবি নির্মলেন্দু গুুুণ, কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন, সাবেক বিচারপতি মমতাজউদ্দিন আহমেদ, বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত, এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক মাহফুজা খানম, অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতসহ দেশের ১৭১ জন বিশিষ্ট নাগরিক, বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের কয়েকজন নোবেলজয়ী, ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের সদস্যেও লেখা খোলা চিঠি তাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ওই খোলা চিঠির বক্তব্য বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীন বিচার বিভাগের ওপর স্পষ্ট হুমকি।
বিবৃতিদাতারা বলছেন, চিঠিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে আদালতে চলমান মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে। দেশের বিবেকবান নাগরিক হিসেবে আমরা বাংলাদেশের বিচার প্রক্রিয়ার ওপর এ ধরনের অযাচিত হস্তক্ষেপে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি।
খোলা চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু আইনি ও নৈতিক প্রশ্ন সামনে চলে আসে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৪(৪) অনুযায়ী বিচারকরা তাদের বিচারিক কাজে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্র পরিচালনায় যুক্ত কারও বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার নেই। উল্লিখিত চিঠির বক্তব্য বাংলাদেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) স্বীকৃত শ্রমিকদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি। এ চিঠিতে ‘নিরপেক্ষ’ বিচারকের মাধ্যমে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বিচারের যে আহ্বান জানানো হয়েছে, তা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে হেয় করার শামিল বলে আমরা মনে করি।
সংবিধান অনুযায়ী সব নাগরিকই আইনের দৃষ্টিতে সমান উল্লেখ করে বিবৃতিদাতারা বলেন, লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত সংবিধানে সবারই আইনি সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিচারকাজও দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ও স্বাধীনভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটে ‘বিচারিক হেনস্তা’র অভিযোগ অমূলক ও অনভিপ্রেত। পাশাপাশি ড. ইউনূস বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে সবসময়ই দেশ-বিদেশে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সব কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন।
খোলা চিঠিতে সই করা ব্যক্তিদের নিজ নিজ দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ উল্লেখ করে বিবৃতিতে প্রত্যাশা করা হয়েছে, বিবৃতিদাতারা তাদের নিজ নিজ দেশের মতো বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকেও নিজস্ব আইন অনুযায়ী চলার সুযোগ দেবেন এবং সম্মান করবেন।
অন্যদিকে, এ চিঠি দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কি না, তা খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ১৩টি জাতীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিবৃতিদাতাদের এখন দায়িত্ব হচ্ছে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে করা ১৬৮টি মামলায় আইনের কোন কোন ধারা লঙ্ঘন করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত তাকে অন্যায়ভাবে অপদস্ত করছেন, তা তুলে ধরা। তারা তা করতে ব্যর্থ হলে ধরে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত হবে যে, বিবৃতিদাতারা প্রকৃত সত্য না জেনে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত হয়ে এ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন।
১৬০ জনের এ বিবৃতির সঙ্গে বাংলাদেশবিরোধী কোনো ষড়যন্ত্র যুক্ত রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য জাতীয়ভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে। বিবৃতিদাতা সংগঠনগুলো হলো সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ, বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ, বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা, বাংলাদেশ গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ যাত্রা শিল্প উন্নয়ন পরিষদ, অভিনয় শিল্পী সংঘ, বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার ও বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট।
তবে উল্লেখ করা প্রয়োজন শ্রম আদালতে বিচারাধীন বর্তমান বিচারিক মামলার অভিযোগকারীরা গ্রামীণ টেলিকমের কর্মী। এখানে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। শ্রমিকরাই মামলা নিয়ে এসেছে এবং এই মামলা নিয়ে তারা কি করতে চায় তা সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার তাদের।
শ্রম মামলাটি, শ্রম আইন লঙ্ঘনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের জন্য শ্রম বিভাগ থেকে করা হয়। প্রফেসর ইউনূসের পক্ষ থেকে অভিযোগগুলো সঠিক নয়, এমন কোনো প্রমাণ আদালতে পেশ করা হয়নি। যা দাবি করা হয়েছে তা হলো তা আইনের আওতায় নয়। তবে এ কথি সত্য কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন।
বাংলাদেশের আইনে বিচারকদের একটি প্যানেল গঠন করে তা পরিবর্তন পর্যালোচনা করার ক্ষমতা কোনো কর্তৃপক্ষের নেই। শ্রম আদালতের সভাপতিত্ব করেন একজন একক বিচারক। প্রফেসর ইউনূস শ্রম আদালতের বিচারকদের একটি প্যানেলের সামনে রায়কে চ্যালেঞ্জ করে আপিল করার সুযোগ পাবেন। তারপরে হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপিল বিভাগের শরণাপন্ন হবেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা এফআইআর অনুযায়ী, আইন অনুমোদিত সংস্থার তদন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে৷ সরকারকে অভিযোগ পর্যালোচনা করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে বিচারকদের একটি প্যানেল গঠন করার অনুমতি দেওয়ার কোনো আইন নেই। যে কোনো কর্তৃপক্ষের যে কোনো অভিযোগ পর্যালোচনার জন্য মূলত আইন লঙ্ঘন অভিযোগের তদন্তের প্রয়োজন হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ঠিক সেটাই করছে।
ড. ইউনূসের পক্ষে বিশ্বনেতাদের বিবৃতি, অবস্থান জানাল সরকার
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনসহ ১৬০ জন বিশ্বনেতা এবং নোবেলজয়ীর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিচার প্রক্রিয়া স্থগিতের বিবৃতির বিপরীতে নিজেদের অবস্থান জানিয়েছে সরকার। সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এই বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে বলেছে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রচারের অজুহাতে কোনো প্রকার পর্দাহীন হুমকি বাংলাদেশের জনগণকে আইনের শাসন বজায় রাখা থেকে বিরত করবে না। ‘নিপীড়ন বা হয়রানির’ অভিযোগগুলি এমন একটি প্যাটার্ন অনুসরণ করে যা মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রকে একটি সমীচীন আবরণ হিসাবে ব্যবহার করে শিকার মানসিকতা থেকে উদ্ভূত বলে মনে হয়। চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পর্কে অযৌক্তিক ইঙ্গিত দেওয়ার পরিবর্তে আইনের সীমার মধ্যে কাজ করার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পরামর্শ দেওয়ার কথাও বলা হয়।
সেখানে বলা হয়, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ একদল আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব এবং কিছু বাংলাদেশি নাগরিক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান বিচারিক কার্যক্রমের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন যা বাংলাদেশ সরকারের নজরে এসেছে। খোলা চিঠিটিতে সুস্পষ্টভাবে তথ্যের সুস্পষ্ট ফাঁক আছে এবং এটি বাংলাদেশের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার অবমাননা। এটি সরকারের কাছে বিস্ময়কর- চিঠিতে স্বাক্ষরকারীরা ইতিমধ্যেই সাব-জুডিস মামলার যোগ্যতা এবং বিচারিক কার্যক্রমের ফলাফল সম্পর্কে তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। সেখানে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বাংলাদেশ দণ্ডবিধি এবং মানি লন্ডারিংবিরোধী আইন, ২০১২-এর সুনির্দিষ্ট বিধানের অধীনে এই মামলা দায়ের করেছে। গ্রামীণ টেলিকম লিমিটেডের শ্রমিক ও কর্মচারীদের লভ্যাংশের অপব্যবহার সংক্রান্ত অভিযোগের তদন্তের ভিত্তিতে মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল। দুদকের তদন্ত দল দেখতে পেয়েছে যে, গ্রামীণ টেলিকম লিমিটেডের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং অন্যান্য বোর্ড সদস্যদের সঙ্গে বন্দোবস্ত চুক্তি জাল করে ২৫২ মিলিয়ন ডলার অপব্যবহার এবং অবৈধভাবে টাকা হস্তান্তর করেছে।
আরও বলা হয়, অন্যদিকে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, ঢাকা বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর অধীনে একটি মামলা দায়ের করে। একাধিক লঙ্ঘনের জন্য মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল। যার মধ্যে রয়েছে শ্রমিক অবদান তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন না করা এবং সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিলে নিট লাভের ৫% ভাগ লভ্যাংশ ২০০৬ সাল থেকে না দেওয়া। আবার একটি কর ফাঁকির মামলায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে হেরে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে আবেদন করেন। হাইকোর্ট বিভাগের আদেশে আপিল বিভাগ কোনো দুর্বলতা খুঁজে না পেয়ে আবেদনটি খারিজ কওে দেয়, যার ফলে ড. ইউনুস জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) বকেয়া কর পরিশোধ করেন। তার বিরুদ্ধে কর ফাঁকির আরও কয়েকটি মামলা রয়েছে।
শ্রমিকদের তাদের ন্যায্য লাভ থেকে বঞ্চিত করার মামলায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস দুই দফায় সর্বোচ্চ আদালতে গিয়েছিলেন, একটি রক্ষণাবেক্ষণকে চ্যালেঞ্জ করে এবং আরেকটি ট্রায়াল কোর্ট কর্তৃক অভিযোগ গঠনকে চ্যালেঞ্জ করে। তার আইনজীবীদের শুনানি করে সর্বোচ্চ আদালত প্রথম মামলাটি সঠিকভাবে শুরু হয়েছে বলে নিশ্চিত করে রায় দেন এবং অন্যটিতে অভিযোগ গঠনকে আইনি ও সঠিক বলে ঘোষণা করেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, এটি দুঃখজনক- চিঠিতে স্বাক্ষরকারীরা সাব-জুডিস মামলাগুলি স্থগিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে বিচার বহির্ভূত কর্তৃত্ব প্রয়োগ করার জন্য অনুরোধ করেছে। তারা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পর্যালোচনার একটি বিকল্প প্রক্রিয়ার সুপারিশ করেছে যেটি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত বিচার ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
সেখানে আরও বলা হয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার সহযোগীরা তাদের অভিযুক্ত বা প্রমাণিত আইন লঙ্ঘনের জন্য আন্তর্জাতিক লবিংয়ের আশ্রয় নেওয়া এই প্রথমবার নয়। গ্রামীণ ব্যাংক সার্ভিস রুলস, ১৯৯৩ অনুযায়ী নির্ধারিত অবসরের বয়স অতিক্রম করলেও গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে তার চুক্তি বাতিল করার প্রসঙ্গে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত ছিল তার।
আরও বলা হয়, দেশের আইনের ঊর্ধ্বে নিজেকে ভেবে নিয়ে একটি সার্বভৌম দেশের নাগরিক হিসেবে বারবার বহিরাগত হস্তক্ষেপ চাওয়াটা অগ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশের জনগণের কাছে এটি এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, কর্পোরেট এবং আয়কর ফাঁকি দিয়ে এবং বছরের পর বছর ধরে কর্মীদের বঞ্চিত করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের বেতনভোগী কর্মচারী- বাণিজ্যিক উদ্যোগে কথিতভাবে অপব্যবহার করেছেন। এবং পাচারকৃত অর্থের একটি বড় অংশ বিনিয়োগ করেছিলেন।
জনগণের উপলব্ধি
সবাই ড. ইউনূসকে সুদ নিয়ে এমন আক্রমণ করছেন যেন, সুদ একমাত্র তিনি ছাড়া আরও কেউ গ্রহণ করেন না। বিষয়টা সুদ নিয়ে নয়। তাঁকে এমন এক বিষয়ে নোবেল সনদ দেয়া হয়েছে, যে বিষয়ে তাঁর ন্যূনতম অবদান নেই। তাঁকে অর্থনীতি বিষয়ে পুরষ্কৃত করা হলে, এ নিয়ে সামান্যতম প্রশ্নের অবকাশ হতো না। আবার, শান্তিতে নোবেল সনদ পাওয়ার পর বিশেষ আমলে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার বাসনা, প্রতিষ্ঠিত দুই নেতৃত্বকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টার সঙ্গে জড়ানো, কর ফাঁকি, শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন থেকে বঞ্চিত করা, অবসরত্তোর সুবিধাদি না দেয়া, শ্রমিক নেতাদের ঘুষ প্রদান, দেশের চাকুরি বিধি উপেক্ষা করে নিজে চাকুরিতে বহাল থাকা, সর্বোপরি পদ্মা সেতুর ঋণ বন্ধের তৎপরতায় যুক্ত হওয়া- এ সব বিষয়ে তাঁকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
আর, তাঁকে সমর্থন করে বিবৃতি দিতে গিয়ে অন্য দেশের বিচারে হস্তক্ষেপ এবং সে দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনকে টেনে এনে নিজেদের বিতর্কিত করেছেন, আজ্ঞাবহ নোবেল লরিয়েটেরা। সুূদ দুনিয়ায় সর্বত্র প্রচলিত। এটা গ্রহণ বা বর্জনে সুনাম ক্ষুণ্নের কিছু আছে বলে আমাদের মনে হয়না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্বোধন করে তাঁরা লিখেছেন যে ‘বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে তাঁরা এই দেশের জনগণের সাহস ও উদ্ভাবনী দক্ষতার প্রশংসা করেন। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মতো তাঁরাও বাংলাদেশে উদ্ভাবিত ও সারা বিশ্বে গৃহীত উদ্ভাবনগুলো দ্বারা অনুপ্রাণিত।’ এতে তো আমাদের খুশিতে গদগদ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। রাজনীতি, প্রথম দফায় কূটনীতি, ব্যবসা, শিল্পকলা ও শিক্ষাক্ষেত্রের ৪০ বিশ্বনেতা আবার দ্বিতীয় হফা ১৬০ বিশ্বনেতা যখন বলেন, ‘বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মতো তাঁরাও বাংলাদেশে উদ্ভাবিত ও সারা বিশ্বে গৃহীত উদ্ভাবনগুলো দ্বারা অনুপ্রাণিত।’ তবে বাংলাদেশের মানুষ তো কেনো জানি স্বাভাবিকভাবেই সিঁদুরে মেঘে একটু ভয় পায়। কারণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের ‘নাক গলানোর’ ইতিহাস যে পুরোনো। সেই স্বভাবতো এখনো খানিকটা আছে বলেই মনে হয়। কারণ কয়লা ধুলে না যায় ময়লা। ১/১১ এর ইতিহাস যে সকলের মনে এখনো দাগ কেটে আছে।
প্রধানমন্ত্রীকে লেখা ১৬০ বিশ্বনেতার এই খোলা চিঠি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপের পর্যায় কিনা তা একটু ভাবলে ভালো হতো। সে যাই হোক। কারণ বাংলাদেশের বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের কোনো রূপরেখা তাঁদের এই চিঠিতে নেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্ব আজ এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী। রিজার্ভের ডলার খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বোঝার মত বাংলাদেশের ওপর চেপে বসে আছে রোহিঙ্গা সংকট। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রোহিঙ্গা সংকট থেকে বিশ্বের মনোযোগ সরে যাচ্ছে। মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক নয়। মিয়ানমার ইতিবাচক সাড়া না দিলেও বাংলাদেশ চায় রোহিঙ্গারা নিজেদের দেশে ফিরে যাক। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই।
কিন্তু রাজনীতি, কূটনীতি, ব্যবসা, শিল্পকলা ও শিক্ষাক্ষেত্রে সফল এই ১৬০ বিশ্বনেতার এই খোলা চিঠিতে এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। তাহলে আমরা কী করে বিশ্বাস করব, যে তাঁরা বাংলাদেশের বন্ধু! তাঁরা বাংলাদেশের জনগণের সাহস ও উদ্ভাবনী দক্ষতার প্রশংসা করেন এ কথা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য! নাকি উল্টো সন্দেহটাই শুধু বাড়ায়। আবার কি অনির্বাচিত সরকার? আবার কি নির্বাসনে যাবে আমাদের পবিত্র সংবিধান! এই দ্বিধা আবারো। নাকি নির্বাচনের মাধ্যমে বেছে নেওয়া হবে আগামী দিনের সরকার।
আবারো কি বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নতুন কৌশল ব্যবহার করেছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বর্তমান সরকারের অন্যায় আচরণের শিকার, এমন অভিযোগ করা হয়েছে। ড. ইউনূস সারা বিশ্বে যে মানবিক কার্যক্রম চালিয়েছেন বা দেশে যে কার্যক্রমগুলো চালাচ্ছেন, সেটি কোথায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিংবা কোথায় কে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানার সুযোগ নেই এটিতে। ড. ইউনূস দেশের বাইরে শত শত জায়গায় যাচ্ছেন, তাঁকে বাধা দেয়া হয়েছে বিমানবন্দরে বা যেতে দেয়া হয়নি এমন কোনো খবর আমাদের গণমাধ্যম দেয়নি। কিভাবে কোথায় কার্যক্রমের ওপর বাধা এসেছে সেটিও দেশবাসীর জানা নেই। জানালে ভালো হতো। ড. ইউনূসের সঙ্গে সরকার এমন কোনো আচরণ কি করেছে যার জন্য খোলা চিঠি, তাও আবার লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ করে বিজ্ঞাপন দিয়ে ছাপাতে হবে। নিউজ আইটেম যখন বিজ্ঞাপন ও খোলা চিঠি আকারে প্রচার করতে হয়, তখন বুঝতে কারো অসুবিধা হবার কথা নয় এর মধ্যে প্রচারিত তথ্য বানোয়াট ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। তার সঙ্গে সরকার এমন কোনো আচরণ করেনি, যা এ ধরনের বিবৃতি দাবি করে। তবে ড. ইউনূস বাংলাদেশে কী ধরনের কার্যক্রমের সাথে জড়িত আছেন, সে বিষয়ে এ দেশের সাধারণ মানুষ ভালোভাবেই অবগত আছেন।
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। এক যুগ আগে নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে গ্রামীণ ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা সরানোর বিষয়ে একটি তথ্যচিত্র সম্প্রচার করা হয়। বর্তমানে ড. ইউনূসের গ্রামীণ টেলিকমের দুর্নীতির অনুসন্ধান চলছে, দুর্নীতি দমন কমিশনে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে শ্রমিকদের অর্থ লোপাট, কল্যাণ তহবিলের অর্থ বিতরণ না করে ৪৫ কোটি ৫২ লাখ ১৩ হাজার টাকা আত্মসাৎ এবং দুই হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে সহযোগী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করার অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে এরই মধ্যে গ্রামীণ টেলিকমের এমডি জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আছেন।
এ ছাড়া ১/১১ সেনাসমর্থিত সরকারের সময় প্রধান দুই দলের নেত্রীকে মাইনাস করে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে চেয়েছিলেন তিনি, ক্ষমতার মধ্যমণি হতে চেয়েছিলেন। সবাই কেবল ক্ষমতায় যেতে চায়। সে সময় গ্রামীণ পার্টি নামে একটি দল করারও ঘোষণা দিয়েছিলেন। পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বাতিলের নেপথ্যে ঘুরেফিরে এসেছে ড. ইউনূসের নাম। ড. ইউনূসের গ্রামীণ টেলিকমের দুর্নীতির অনুসন্ধান চলছে। এ অবস্থায় গত বছরের অক্টোবরে ইউনূসকে হিরো বানানোর তৎপরতা শুরু করে পশ্চিমা লবিস্টরা। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজই তো এটি করা।
বাংলাদেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে সরকারের গৃহীত কর্মসূচী কল্যাণমুখী এবং এর পিছনে মুনাফার কোন অদৃশ্য হাত থাকে না, যা গ্রামীণ ব্যাংকসহ এই ধরনের ঋণদান সংস্থাগুলোর থাকে। সরকারের গৃহীত নানা কর্মসূচীর কারণেই এখন বাংলাদেশের দারিদ্র্য মিউজিয়ামে যাওয়ার পথে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার হচ্ছে দেশ থেকে দারিদ্র্য নির্মূল করা। সরকার তাই করছে।
এসব খবর, এইসব বিবৃতি প্রদানকারী বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। কারণ ড. ইউনূস আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত এবং বিশ্বের বাঘা বাঘা ব্যক্তিরা তাঁর বন্ধু-বান্ধবী বা বেনিফিশিয়ারি। মার্চ ২০১১ সালে, ইউনূসকে দেশের অবসর আইনের লঙ্ঘন করে গ্রামীণ ব্যাংকের সিইও পদ থেকে পদত্যাগ করার অনুরোধ করা হয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছে যে অবসরের বয়স ৬০। ইউনূসের বয়স তখন ৭০ বছর। দেশের সর্ববৃহৎ কাঠামো পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের সরে যাবার পেছনে ড. ইউনূসের হাত ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছিলো। পরবর্তীতে, ২০১৭ সালে কানাডার একটি আদালত কর্তৃক কথিত দুর্নীতির অভিযোগ খারিজ হবার পর বাংলাদেশের সবাই এটিকে একটি ষড়যন্ত্র বলে মনে করে।
আর্ত মানবতার সেবায় নিবেদিত অনেক ব্যক্তিই পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতনের শিকার মানুষ রোহিঙ্গাদের রক্ষায় ড. ইউনূস সামান্যই আগ্রহ দেখিয়েছেন বলে অনেকে মনে করেন। একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে ড. ইউনুসকে অবশ্যই পরিস্থিতি অনুধাবন করতে হবে এবং বাংলাদেশের আইনের পরিপন্থী কোনো বিতর্ক থেকে বিরত থাকতে হবে। ডাউট অব বেনিফিট যেন দেশ মাতৃকার এবং দেশের মানুষের বিরুদ্ধে চলে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের এটিই কর্তব্য। তাহলেই আমাদের দেশের জনগণের মঙ্গল হবে, আন্তর্জাতিক বিশ্বে নিজ মাতৃভূমিকে সম্মানের ও গৌরবের আসনে রাখা যাবে।
হীরেন পণ্ডিত, প্রাবন্ধিক ও গবেষক