× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

সংকটে হাজার কোটি টাকার ফাউন্ড্রি শিল্প

বগুড়া প্রতিনিধি

২৬ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:৪৫ এএম

কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিতে নতুন করে সংকটে পড়েছে ‘মাদার শিল্প’ নামে খ্যাত বগুড়ার ফাউন্ড্রি বা ঢালাই শিল্পের প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা। অতিরিক্ত ব্যয়ে উৎপাদিত এসব পণ্য বাজারে বিক্রি করতে গিয়েও হিমশিম খেতে হচ্ছে ব্যবসায়িদের।  

গত বছরের শেষের দিক থেকে করোনা মহামারীর কারণে লোকসান কাটিয়ে সবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল এই শিল্প। কিন্তৃ বিশ্ববাজারে কাঁচামালের এমন মূল্য বৃদ্ধিতে আবার হুমকির মুখে পড়েছেন জেলার ফাউন্ড্রি মালিকরা। তারা বলছেন, কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে কারখানাগুলো তাদের উৎপাদন প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমাতে বাধ্য হয়েছেন। উৎপাদন বন্ধ থাকলে এই লোকসান আরো বেশি হবে।তাই বাধ্য হয়ে অনেকে কারখানা চালু রেখেছেন।

কারখানা মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছর জাহাজ স্ক্রাব(ভাঙারি) প্রতি টনের মূল্য ছিল ২৮ হাজার থেকে ৩৩ হাজার টাকা। সিলিকনের মূল্য এক লাখ টাকা, কয়লা (বোল্ডার) ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু গত বছরের শেষের দিকে এই কাঁচামালগুলোর দাম বেড়ে গেছে। বর্তমানে জাহাজ স্ক্রাব ক্রয় করতে হচ্ছে প্রতি টন ৫২ হাজার টাকা। আর সিলিকনের মূল্য প্রতি টন ৩ লাখ ও কয়লা ৮৫ হাজার টাকা।

কাঁচামালের এমন দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রভাব পড়েছে উৎপাদনের চাকার ওপর।সব ফাউন্ড্রি মালিকরা তাদের উৎপাদন কমে দিয়েছেন। তবে সংকট এখানেই শেষ নয়। বাজারে নতুন করে পণ্য কোনো ব্যবসায়ী নিতে চাইছেন না। কারণ অতিরিক্ত দামে তারা পণ্য বিক্রি করতে পারবেন না। আবার আগের উৎপাদিত অনেক পণ্য এখনও অবিক্রিত রয়েছে।

আবার কারখানা বন্ধ রাখার খরচ বাঁচাতে গিয়ে মালিকপক্ষ উৎপাদন কর্মকা- চালু রাখছেন। মালিকদের হিসাব মতে, কারখানার কাজ বন্ধ রাখলে গড়ে প্রতিটি ছোট ফাউন্ড্রি প্রতিষ্ঠানের এক লাখ টাকা লোকসান গুনতে হবে।একইভাবে মাঝারি আকারের কারখানাগুলো লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ টাকা। বড় কারখানার এই লোকসানের পরিমাণ আরও বেশি। এ ছাড়া লোহা গলানোর জন্য কয়লার ফার্নেসে উৎপাদন ব্যয় বেশি। এর বদলে বিদ্যুৎচালিত আধুনিক ইনডাকশন মেশিন থাকলে খরচ কম হতো। পুরোনো পদ্ধতিতে উৎপাদন কাজ পরিচালনার জন্য ব্যয়টা বেশি হয়ে থাকে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাসখানেক আগেও সপ্তাহে অনেক কারখানা ৬ দিন ঢালাই কাজ চালু রাখতো। কিন্তু এখন তারা ঢালাই কাজ করছে ৪ দিন। অনেকে দুই দিন করে ঢালাই করছে। গুঞ্জন মেটাল ওয়ার্কশপের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মো. জাকির হোসেন জানান, করোনার পর থেকে কারখানায় ৪ দিন করে ঢালাই কাজ করা হতো। কিন্তু এখন দুই দিন করে ঢালাই হ”েছ। কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছি ।শুধু আমরাই নই সব কারখানার মালিকরাই ঢালাই কমায় দিয়েছেন।

গুঞ্জন মেটাল ওয়ার্কশপের এই কর্মকর্তা জানান, অধিকাংশ ব্যবসায়ীরা নতুন করে পণ্য কিনতে চাইছেন না। এটা আমাদের জন্য এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। একই রকম অনিশ্চয়তার কথা বলেন ফাউন্ড্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এফওএবি) সভাপতি ও মিলটন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিজার রহমান মিলটন। তিনি জানান, কাঁচামালের দামের কারণে কয়েকমাস হলো ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছি ফাউন্ড্রি শিল্প মালিকরা। এর সাথে যুক্ত নতুন করে উদ্ভুত করোনা পরিস্থিতি। এই দাম বৃদ্ধিতে আমরা লোকসানে পড়ে আছি। আবার ফাউন্ড্রি শিল্পের ফিনিসড প্রোডাক্টগুলোর দাম বাড়াতে পারেনি কারখানার মালিকরা।

কারণ হিসেবে মিলটন জানান, বেশি দামে পণ্য ক্রয় করার মতো ক্রেতা এখন নেই।পাইকাররাও নতুন করে পণ্য নিতে রাজি না। ফলে জেলার ফাউন্ড্রি মালিকরা প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ উৎপাদনের পরিমাণ কমে দিয়েছেন।  এই শিল্পের ভবিষ্যত নিয়ে অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বলেন, জেলায় বছরে হাজার কোটি টাকা আয় এনে দেয় ফাউন্ড্রি ব্যবসা। কিন্তু এখনও এটি চলে পুরোনো পদ্ধতিতে। এ জন্য আমাদের উৎপাদনের ব্যয়ও বেশি হয়।

তিনি আরও বলেন, ফাউন্ড্রি শিল্পকে আধুনিকায়ন করতে হবে। তবে সরকারি সহযোগিতা ছাড়া এই আধুনিকায়ন অসম্ভব। আধুনিকায়ন হলে আমাদের উৎপাদন খরচ অনেক কমে আসবে। কাজের মানও উন্নত হবে। বগুড়া থেকেই গাড়ির যাবতীয় যন্ত্রাংশ তৈরি করতে পারবো। দেশের আমদানি নির্ভরতা কমে আসবে।  
    
জেলা বিসিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, শিল্পনগরী হিসেবে বগুড়াকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে ফাউন্ড্রি শিল্প। মূলত পুরনো লোহা আগুনে গলিয়ে ছাঁচে ঢেলে নির্দিষ্ট আকারের যন্ত্র কিংবা যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয় বলেই এ ধরনের শিল্পকে ফাউন্ড্রি বা ঢালাই শিল্প বলা হয়।

বগুড়ার বিসিক এলাকায় প্রায় ৪৬টি ফাউন্ড্রি শিল্প কারখানা রয়েছে। এ ছাড়াও বিসিকের বাইরে জেলার বিভিন্ন জায়গায় ছোট-বড় মিলিয়ে আরও অন্তত ৩০০টি কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় কর্মরত রয়েছেন অন্তত ১০ হাজার শ্রমিক। আর এই শিল্পের সঙ্গে পরোক্ষভাবে নিয়োজিত আছে জেলার আরও ২৫ হাজার মানুষ।
 
এসব ফাউন্ড্রি কারখানাগুলোতে অর্ধশত যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ তৈরি হ”েছ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শ্যালো ইঞ্জিনচালিত পানির পাম্প এবং এর লায়নার, পিস্টনসহ সব ধরনের যন্ত্রাংশ, হ্যান্ড টিউবওয়েল (নলকূপ), সব ধরনের হুইল, পাওয়ার ট্রিলারের বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ, লেদ মেশিনের যন্ত্রাংশ, করাত কল (স' মিল), চিড়া তৈরির কল, অটো রাইস মিলের যন্ত্রাংশ, ফ্লাওয়ার মিলের যন্ত্রাংশ, টেক্সটাইল মিলের যন্ত্রাংশ, মোটরগাড়ির স্প্রিং, ব্রেক ড্রাম, গ্রান্ডিং মেশিন, অয়েল মিল ও জুট মিলের যন্ত্রপাতি। এর মধ্যে পানির পাম্প ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ, ভূটান, মায়ানমারে নিয়মিত রপ্তানি হয়ে থাকে।  বগুড়ার ফাউন্ড্রি কারখানাগুলোতে কৃষি ও সেচ যন্ত্রাংশই সবচেয়ে বেশি তৈরি হয়, যা দেশের মোট চাহিদার শতকরা ৭০ ভাগের জোগান দিয়ে থাকে।

বিসিকের তথ্য মতে, তাদের এলাকায় গড়ে ওঠা ৪৬টি কারখানা থেকে বছরে গড়ে ৩০০ কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন করে। আর বাইরের কারখানা মিলে প্রতি বছর গড়ে এক হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন হয়।

বগুড়া চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের ২০২১ সালের রপ্তানির পরিসংখ্যানে তিনটি ফাউন্ড্রি প্রতিষ্ঠান নাম উল্লেখ রয়েছে। মিলটন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, রনি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ ও আজাদ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ। গত বছর এই তিনটি প্রতিষ্ঠান মিলে প্রায় ৯৪ লাখ টাকার সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প ভারতে রপ্তানি করা হয়েছে।

বগুড়া চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সহসভাপতি মাফুজুল ইসলাম রাজ বলেন, ফাউন্ড্রি শিল্প বগুড়ার গর্ব। এই শিল্পকে বিকশিত তথা আধুনিকায়ন করতে পারলে দেশসহ বিশ্ব বাজারে বগুড়া জেলাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে। পাশাপাশি জেলার আরও অনেক মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে।

জেলা বিসিকের ডেপুটি মহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজুর রহমান বলেন, ফাউন্ড্রিকে বলা মাদার শিল্প। আর দেশের মধ্যে বগুড়ার ফাউন্ড্রি শিল্পের চাহিদা অত্যধিক। কিন্তু কাঁচামালের দামবৃদ্ধির ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে এই দাম বাড়া শিল্পটির জন্য ক্ষতিকর।

আধুনিকায়নের বিষয়ে তিনি জানান, এখানকার কারিগররাও ভৌগলিকভাবে দেশের ভিতরে সবচেয়ে দক্ষ। তবে এটা সত্য যে তারা এখনও মান্ধাতার আমলে রয়েছে। তাদের আধুনিকায়নের লক্ষ্যে আমরা সদা সচেষ্ট। এ জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, প্রণোদনা দিয়ে তাদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি আমরা।






Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.