ছবি: সংবাদ সারাবেলা।
নারীরা কোন ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই, তাঁরা নিজ যোগ্যতায় এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ঘরে বাইরে সব পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করছে। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোক্তা। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে অনলাইন ব্যবসায়ের প্রবর্তনের ফলে নারীরা আরও বেশি পরিমাণে সফল উদ্যোক্তায় পরিণত হচ্ছে। বলছি কক্সবাজারের চকরিয়া হস্তশিল্প ও দেশীয় পণ্য উৎপাদন মুখী সমবায় সমিতি'র (সিএইচডিইউএস) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শারমিন জন্নাত ফেন্সি'র কথা।
অনেক তরুণ-তরুণী অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে হয়েছেন উদ্যোক্তা। নিজে স্বাবলম্বী হয়ে আয় করছেন লাখ লাখ টাকা। নিজ ও পরিবারের আর্থিক চাহিদা পূরণ করে সঞ্চয় করছেন, বাড়িয়েছেন ব্যবসার পরিধিও। ক্ষুদ্র উদ্যোগকে কাজে লাগিয়ে হয়েছেন সফল উদ্যোক্তা। এমন এক অদম্য নারী শারমিন জন্নাত ফেন্সি। নিজে সফল হওয়ার পাশাপাশি স্বপ্ন দেখেন উদ্যোক্তা তৈরির। এতেও সফল তিনি। বলা যায়, নারী উদ্যোক্তা তৈরির দক্ষ কারিগর এই শারমিন জন্নাত ফেন্সি। ২০২০ সালে চকরিয়া হস্তশিল্প এসোসিয়েশন নামে ফেসবুক গ্রুপ খুলে ভাগ্য খুলেছেন শত শত নারীর।
তিনসন্তানের জননী শারমিন জন্নাত ফেন্সি, জন্ম ও শ্বশুরবাড়ির সূত্রে তিনি কক্সবাজারের চকরিয়ার বাসিন্দা। চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠ থেকে মাধ্যমিক পাশ করে চকরিয়া মহিলা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যায়নরত অবস্থায় পারিবারিক ভাবে হয়ে যায় তার বিয়ে। শ্বশুর বাড়িতে বড় বউ হওয়ায় তার উপর চলে আসে সংসারের ঘানি। দেওয়া হয়নি নিয়মিত ভাবে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। পরবর্তীতে বাংলাদেশ উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) এর অনুমোদিত ক্যাম্পাস চকরিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও কক্সবাজার সরকারি কলেজ থেকে বিএসএস (পাস) ডিগ্রি অর্জন করেন। বিয়ের পর যখন ঘরবন্দি হয়ে পড়েন তখনই তার মাথায় ভিড় করে ভিন্ন চিন্তা। অন্যদের মতো চাকরির পেছনে না ছুটে নিজে কিছু করবেন এই ভাবনা ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হওয়া শারমিনের। তিনি স্কুলজীবনে থাকতেই একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন সবসময়।
সফল নারী উদ্যোক্তা শারমিন জন্নাত ফেন্সি বলেন, 'বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের নারীরা অনেক পিছিয়ে আছে। কুসংস্কার ও পারিবারিক নানান বাঁধা বিপত্তি তাদের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। সমাজের এসব কুসংস্কার থেকে বের হতে হলে নারীদের অবশ্যই সচেতন এবং স্বাবলম্বী হতে হবে। এই চিন্তা ধারায় আমি প্রথম দিকে বুটিকস, নকশী কাঁথা সেলাইয়ের কাজ শুরু করি। এভাবে পার হয় আমার সংগ্রামের প্রথম ছয় মাস। নিজে স্বাবলম্বী ও সফল হয়ে থেমে থাকিনি। উদ্যোগ নিই তৃণমূল নারীদের স্বাবলম্বী করার। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে নির্যাতিত নারীদের আইনি সহায়তা দিতে শুরু করি। পাশাপাশি নারীদের আয়বর্ধনমূলক কাজে সম্পৃক্ত করতে উদ্যোগ নিই। গ্রামের অসচ্ছল পরিবারের অনেক মেয়ে যৌতুক দিতে না পারার কারণে যাদের বিয়ে হচ্ছিল না, এমন ২৫ জন নারীকে আয়বর্ধনমূলক কাজ করতে উৎসাহ প্রদান করি। পরবর্তীতে চকরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা ৮০ জন নারী উদ্যোক্তাদের একত্রিত করে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু করি ই-কমার্স ভিত্তিক সংগঠন চকরিয়া হস্তশিল্প ও দেশীয় পণ্য উৎপাদন মুখী সমিতি। চকরিয়ার ক্ষুদ্র মহিলা উদ্যোক্তাদেরকে সঠিক একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেওয়ায় ছিল আমার মূল লক্ষ্য। ২০২১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধন লাভ করি। বর্তমানে আমাদের উদ্যোক্তা সংখ্যা পাঁচশত ছাড়িয়েছে। এছাড়াও গ্রামেগঞ্জে অনেক নারী আছেন যারা হস্তশিল্পের কাজ করেন। আমি চেয়েছিলাম তাদের কাজ গুলোকে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের কাছে তথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে। এ লক্ষ্যে গঠন করা আমাদের অনলাইন গ্রুপে বর্তমানে ৬০ হাজারের বেশি নারী-পুরুষ সংযুক্ত রয়েছেন।
নারী উদ্যোক্তা সংগঠক শারমিন জন্নাত বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের পরামর্শ ও সহযোগিতার পাশাপাশি তিনি নিজে বেকিং ট্রেনিং সেন্টার ও ফেন্সী কেক শপ নামের ব্যবসা চালু করেন। হোম মেইড কেক তৈরিতে চকরিয়া তথা কক্সবাজার জেলায় অদ্বিতীয় প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছেন ফেন্সী কেক শপকে।
নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি এই অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া নারীদের কথা চিন্তা করে সিএইচডিইউএস এর একটা প্রোফাইল তৈরি করেন শারমিন জন্নাত ফেন্সি। এরই মাঝে সিএইচডিইউএস এর প্রোফাইল নজরে আসে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা -(আইওএম ইউএন মাইগ্রেশন) এর। ২০২৩ সালে আইওএম এর সহিত পার্টনারশিপ চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। সিএইচডিইউএস এর পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন সংগঠনের সভাপতি শারমিন জন্নাত ফেন্সি। দীর্ঘ একবছর আইওএম এর কাছ থেকে দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ লাভ করেন পুরো সিএইচডিইউএস টীম। শারমিন জন্নাত ফেন্সির হাতধরে নারী উদ্যোক্তা সমিতিটি ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়ে যায় একটি এনজিও তে। শারমিন জন্নাত ফেন্সির নেতৃত্বাধীন স্থানীয় এনজিও সিএইচডিইউএস ২০২৫ সালে জাতিসংঘের সংস্থা আইওএম এর অর্থায়নে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থিত ৮টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করার সুযোগ পায় এবং তা সফল ভাবে বাস্তবায়ন করেন। ফলে আইওএম এর পক্ষ থেকে আইপি পার্টনারশিপ সনদ অর্জন করেন সিএইচডিইউএস।
নিজের উদ্যোগের বিষয়ে শারমিন জন্নাত ফেন্সি বলেন, 'সমাজের অনেক নারীই উদ্যোক্তা হতে চান, কিন্তু উদ্যোগ থাকলেও সুযোগ হচ্ছে না। আমি তাদের উদ্যোগকে ছড়িয়ে দিতে চাই। এ কারণেই আমার স্বপ্ন নারী উদ্যোক্তা তৈরি করা, যারা সফল হয়ে অবদান রাখবেন দেশের অর্থনীতিতে। বর্তমানে বেকারত্ব বেড়েই চলছে। তবে আমি কিছুটা সফলও হয়েছি। আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার মাধ্যমে অনেক নারীর আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটাই আমার কাছে চরম পাওয়া।' উদ্যোক্তা তৈরির স্বপ্ন দেখা এ নারী উদ্যোক্তা বলেন, 'একজন নারী উদ্যোক্তা হওয়ার পাশাপাশি অন্য নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর পরিসরে কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছি। অনেক নারী আছেন যারা কোনো একটি পণ্য ভালো তৈরি করতে পারেন। সেটা নিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নও দেখেন। এমন ছোট ছোট উদ্যোগ নিয়ে নারীদেরও সহযোগিতা করার চেষ্টা করে থাকি। এ ছাড়া বিভিন্ন হাতের কাজ শেখাসহ মার্কেটিংয়ের উপরও প্রশিক্ষণ নিয়েছি।'
স্বামী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের উৎসাহে এগিয়ে যাওয়া এই নারী উদ্যোক্তা মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে 'সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী' ক্যাটাগরী তে ২০২৪ সালে অর্জন করেন শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার।
শারমিন বলেন, 'সবসময় চেয়েছি নিজের একটি পরিচয় গড়ে তোলার। স্বামীর কাছ থেকে নেওয়া ৫০ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসায় শারমিনের এখন পুঁজি প্রায় ২০ লাখ টাকা। সাংবাদিক স্বামীর উৎসাহে তিন সন্তান ও সংসার সামলে সফল এই নারী উদ্যোক্তার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসাগুলোতে এখন কাজ করছেন ১০ জন তরুণ-যুবক। বেকার না থেকে তারাও এখন নিজের পরিচয়ে জীবিকা নির্বাহ করে চলছেন স্বাচ্ছন্দ্যে। ইতোমধ্যে ৭০ জন নারী আমার কাছ থেকে হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন।
শারমিন বলেন, স্বামী ব্যতীত তেমন কারো কোনো সাপোর্ট না পেয়ে এতটুকু এসেছি। তবে বাহিরের কিছু মানুষ আমাকে ব্যাপক অপমান করার চেষ্টা চালিয়েছে। তাদের বিষয়ে কর্ণপাত না করে আমি আমার জায়গায় অটুট ছিলাম। সে থেকেই আমি নিজে সফল হয়েছি, তেমনি অন্য নারীদেরও সফলতার দ্বারপ্রান্তে নিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এমনকি আমার অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী কাজ খুঁজছেন আমার কাছে। এর চেয়ে আর সফলতা কী হতে পারে। সবই সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমত বলে মনে করি আমি।
এই নারী উদ্যোক্তা চকরিয়া হস্তশিল্প সংগঠনের সভাপতির দায়িত্বের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সেচ্ছাসেবী সংগঠন এপেক্স ক্লাব চকরিয়া সিটির ২০২৫ বর্ষের প্রেসিডেন্ট এর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন সফলতার সহিত।
বেকারত্ব দূরীকরণে আগামীতে আরও শাখা-প্রশাখা চালু করার চিন্তা নিয়েই শারমিন জন্নাত ফেন্সির পথচলা।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh
