লক্ষ্মীপুর জেলার কৃষিপণ্যভিত্তিক শিল্পে গত কয়েক বছরে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে হাতে ভাজা ঐতিহ্যবাহী ‘গিগজ মুড়ি’ উৎপাদনে। জেলার বিভিন্ন গ্রামে গড়ে ওঠা ছোট-বড় অসংখ্য কারখানা ও ঘরোয়া ইউনিটে এখন বছরে প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ টনের বেশি গিগজ মুড়ি উৎপাদন হচ্ছে। স্থানীয় চাহিদা পূরণ করেই থেমে নেই - মান, গন্ধ ও খাস্তা স্বাদের জন্য এ মুড়ির কদর এখন দেশের বাইরে বিদেশি বাজারেও বাড়ছে দ্রুত।
ঐতিহ্য থেকে শিল্পে রূপ
গিগজ মুড়ি লক্ষ্মীপুরের বহু বছরের পুরোনো একটি ঐতিহ্যবাহী খাদ্যপণ্য। আগে শুধুমাত্র গ্রামীণ বাড়িঘরেই সীমিত ছিল এর উৎপাদন। সময়ের সঙ্গে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এটি এখন শিল্প আকারে বিস্তৃত হয়েছে। বর্তমানে লক্ষ্মীপুর সদর, রামগঞ্জ, রায়পুর ও কমলনগর উপজেলায় শতাধিক পরিবার সরাসরি মুড়ি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। প্রতিটি পরিবারে ভোর সকাল থেকেই শুরু হয় ধান পরিষ্কার, ভাজা, শুকানো, ঠান্ডা করা, বাছাই, মিশ্রণ ও প্যাকেটজাত করার কাজ। সব মিলিয়ে গড়ে দিনে কয়েক টন করে উৎপাদন হয়, যা মিলিয়ে বছরে দাঁড়ায় ৩০০থেকে ৩৫০ টনেরও বেশি।
নারীদের কর্মসংস্থানে বড় ভূমিকা
গিগজ মুড়ি শিল্প নারীদের আয়–বর্ধন ও আর্থিক স্বাবলম্বিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রতিদিন অনেক নারী ঘরে বসেই মুড়ি ভাজা, বাছাই ও প্যাকেজিংয়ের কাজ করছেন। অল্প মূলধন ও কম ঝুঁকিতে আয় করার সুযোগ থাকায় অনেক নারীই এখন এই শিল্পের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন।
দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে রপ্তানি স্থানীয় উৎপাদকরা জানান, আগের তুলনায় এখন মুড়ির রপ্তানি কয়েকগুণ বেড়েছে। বিশেষ করে সৌদি আরব, কাতার, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এবং ইউরোপ-আমেরিকায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝে গিগজ মুড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রবাসী বাঙালিদের কাছে স্বদেশের স্বাদ পৌঁছে দিতে নিয়মিত কুরিয়ার বা বাণিজ্যিক কনটেইনারের মাধ্যমে মুড়ি পাঠানো হচ্ছে।
রপ্তানিকারকদের দাবি- মান নিয়ন্ত্রণ, উন্নত প্যাকেজিং ও সরকারি সহায়তা আরও বৃদ্ধি পেলে লক্ষ্মীপুরের গিগজ মুড়ি আন্তর্জাতিক বাজারে একটি ‘ব্র্যান্ডেড প্রোডাক্ট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
চ্যালেঞ্জও আছে উৎপাদকরা জানান, গিগজ মুড়ি উৎপাদনে এখনো বেশ কয়েকটি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে- মানসম্মত ধানের সংকট, জ্বালানি খরচ বৃদ্ধি, প্যাকেজিং উপকরণের দাম বৃদ্ধি, রপ্তানি প্রক্রিয়ায় জটিলতা ও ব্যাংক লোন পাওয়ার ঝামেলা। এসব সমস্যা সমাধান হলে উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব হবে বলে তারা মনে করেন।
লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডের সমসারাবাদ এলাকায় প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে তৈরি হয়ে আসছে ঐতিহ্যবাহী হাতে ভাজা গিগজ চাউলের মুড়ি। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়—বলাই দাশের বাড়িসহ পুরো এলাকায় ঘরে ঘরে চলছে মুড়ি ভাজার প্রস্তুতি, উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ।
স্থানীয় মুড়ি ব্যবসায়ী বিশু দাস একান্ত সাক্ষাৎকারে জানান, এই গ্রামে কমপক্ষে ৫০ বছর ধরে পরিবারভিত্তিকভাবে হাতে ভাজা মুড়ির ব্যবসা চলছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই পেশায় জড়িয়ে আছে বহু পরিবার।
তিনি বলেন, “আমরা নিজ হাতে শুধু গিগজ চাউলের মুড়ি ভাজি। বাজারে পাঠানোর পর আড়ৎতদাররা মুড়ির সাথে অন্য কোনো জিনিস মেশায় কিনা—এটা তাদের বিষয়। আমরা এসব জানি না।”
উৎপাদন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি আরও জানান, “লক্ষ্মীপুরে জেলা প্রতিবছর ৩০০ থেকে ৩৫০ টন মুড়ি আমরা বাজারজাত করি। চাহিদাও বেশ ভালো।”
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সমসারাবাদে মুড়ি উৎপাদন শুধু একটি ব্যবসা নয়; এটি এলাকার একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত। দীর্ঘদিন ধরে এখানকার পরিবারগুলো এ পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকায় স্থানীয় অর্থনীতিতেও এর ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে।
তবে ক্রেতাদের অভিযোগ-অনেক সময় আড়ৎতদার পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের মুড়ি একসঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়, যা হাতে ভাজা গিগজ মুড়ির গুণগত মান ও স্বকীয়তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ বিষয়ে আড়ৎতদারদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লক্ষ্মীপুরে গিগজ মুড়ি শুধু একটি খাদ্যপণ্য নয়; এটি একটি সম্ভাবনাময় স্থানীয় শিল্প। বছরে ৩০০ থেকে ৩৫০ টনের বেশি উৎপাদন জেলার অর্থনীতিতে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে বড় অবদান রাখছে। কৃষক, শ্রমিক, নারী উদ্যোক্তা, পরিবেশক ও রপ্তানিকারক— সবাই এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে লাভবান হচ্ছেন।
সরকারি উদ্যোগ বাড়লে এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা মিললে আগামী কয়েক বছরে উৎপাদন দ্বিগুণ হওয়া সম্ভব, যা লক্ষ্মীপুরকে মুড়ি শিল্পের একটি প্রধান কেন্দ্র হিসেবে জাতীয় মানচিত্রে তুলে ধরবে।
গিগজ মুড়ি এখন শুধু খাবার নয় - লক্ষ্মীপুরের মানুষের স্বপ্ন, পরিশ্রম ও উন্নয়নের প্রতীক।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh
