× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

কুষ্ঠের ছায়ায় বেঁচে থাকা মানুষের ভয়, লজ্জা ও নীরবতা

মীর খায়রুল আলম, সাতক্ষীরা

২৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৩:৪২ পিএম

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল যেন সময়ের এক থেমে থাকা ফ্রেম, যেখানে লবণাক্ত জল, দারিদ্র্য আর সমাজের কঠিন দৃষ্টিতে মানুষ বেঁচে থাকে এক দীর্ঘ ভয়ভীতির ভেতর। সাতক্ষীরা থেকে বাগেরহাট পর্যন্ত বিস্তৃত এই জনপদে প্রকৃতি যেমন কঠোর, তেমনি নির্মম সমাজও। কুষ্ঠরোগ যা আজ সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। কিন্তু উপকূলীয় এই দুই জেলায় এটি অভিশাপের প্রতীক, এক অদৃশ্য নির্বাসনের নাম।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৩-৪ হাজার নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। ২০১৫ সালে যেখানে ৩,৯৭৬ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছিল, সেখানে ২০২৪ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৩,৫১৯ জনে। অর্থাৎ, জাতীয়ভাবে রোগীর সংখ্যা কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এর ঠিক উল্টো চিত্র দেখা সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে।

বেসরকারি সংস্থা সিএসএস (খ্রিষ্টান সার্ভিস সোসাইটি)-এর তথ্য অনুযায়ী, সাতক্ষীরায় ২০১৯ সালে রোগী ছিল মাত্র ২ জন, যা ২০২৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৬৮ জনে। এই সময়ে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩৪ গুণ। অন্যদিকে, বাগেরহাটেও পরিস্থিতি একই রকম; ২০১৯ সালে ৫ জন থেকে ২০২৪ সালে ১০১ জনে পৌঁছেছে। বৃদ্ধি প্রায় ২০ গুণ। ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্তও সাতক্ষীরায় ৩৫ জন এবং বাগেরহাটে ৭৪ জন রোগী চিকিৎসাধীন ছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপকূলীয় এই অঞ্চলে কুষ্ঠরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধির পেছনে কাজ করছে একাধিক কারণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ত পানির প্রভাব, দারিদ্র্য, অপুষ্টি এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এই রোগকে আরও ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করছে। তবে আসল বাধা রোগের নয়, সমাজের। স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য হলেও, কুষ্ঠরোগের সঙ্গে যুক্ত যুগ যুগ ধরে চলে আসা ভয়, লজ্জা এবং সামাজিক অবহেলা অনেককেই চিকিৎসা থেকে দূরে রাখছে। রোগীর নাম প্রকাশ না করার প্রবণতা, চিকিৎসা মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা এসব কারণে রোগটি ধীরে ধীরে সমাজে ছড়িয়ে যাচ্ছে। বাগেরহাট বা সাতক্ষীরার অনেক রোগী আজও কুষ্ঠকে অভিশাপ মনে করেন। চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়া সম্ভব জেনেও, সামাজিক অপমানের ভয়ে অনেকে রোগের প্রাথমিক লক্ষণ গোপন করে যান।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশজুড়ে যেখানে রোগ কমছে, এই দুই জেলায় তা বাড়ছে। কেন? কারণ কুষ্ঠ এখানে শুধুমাত্র চিকিৎসার বিষয় নয়, এটা এক সামাজিক ভয়, যা মানুষকে লুকিয়ে থাকতে বাধ্য করছে।

তাদের মতে, এই অঞ্চল দুটি এখন কুষ্ঠ শনাক্তের নতুন কেন্দ্র। স্যালাইন, ডায়রিয়া বা ম্যালেরিয়ার মতো আলোচিত না হলেও, কুষ্ঠ এখনো লেগে আছে উপকূলের দারিদ্র্য, অপুষ্টি আর লবণাক্ততার ভেতর যাদের অনেকে এখনো লুকিয়ে থাকেন, কারণ চিকিৎসা নিতে গেলেই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয় কাজ করে।

ভয়, লজ্জা আর অদৃশ্য দেয়ালের জীবন

সাতক্ষীরা শহরের কুখরালি গ্রামের রহিমা খাতুনের (ছন্দ নাম) হাতের দশ আঙুল ও পায়ের তিন আঙুল আজ আর নেই। রহিমা যেদিন প্রথম উপলব্ধি করেন যে কুষ্ঠরোগ ধীরে ধীরে তার দেহ থেকে স্বাভাবিকতা কেড়ে নিচ্ছে, তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দুর্বল হয়ে বিকৃত হতে শুরু করেছে, সেদিনের শারীরিক কষ্টের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে সমাজের দেওয়া অদৃশ্য বাধা। রোগটি তার শরীর থেকে কেড়ে নিয়েছে অঙ্গের গড়ন, শক্তি ও দৈহিক স্বাধীনতা। কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি হলো সমাজের চোখে ‘ছোঁয়াচে’ তকমা।

’ডাক্তার বলেছে আমি পুরোপুরি সুস্থ। তবুও লোকজন আমার ঘরে যেতে ভয় পায়, পুকুরে কেউ নামতে চায় না। মানুষ এখনো বলে, আমি ছোঁয়াচে,’ বেদনা নিয়ে বলেন রহিমা।

রহিমার এই গল্প শুধু তার নয়। বাগেরহাটের বিশ্বজিত রায়, যিনি দিনমুজুর, তিনি ডান হাতের তিনটি আঙুল হারিয়েছেন। চিকিৎসা শুরু হয়েছে, সংক্রমণ নেই, কিন্তু বাজারে কেউ তার পাশে দাঁড়ায় না, কাজও পান না। অন্যদিকে, সাতক্ষীরা শহরের মেহেরুন্নেসা (ছন্দনাম) কয়েক বছর দেরিতে কুষ্ঠ শনাক্ত করান। তার শরীরে চামড়ায় প্রথম দাগটা উঠেছিল তিন বছর আগে। গায়ে জ্বর, শরীর ব্যথা -তারপর ধীরে ধীরে হাতপায়ের অনুভূতি হারিয়ে ফেলেন তিনি। চিমটি কাটলেও বুঝতে পারতেন না কোনকিছু।

মেহেরুন্নেসা জানান, প্রথমে কেউই ধরতে পারেনি এটা কী ধরণের রোগ। স্থানীয় ডাক্তার বলেছিলেন চর্মরোগ। পরে ভারতের এক চিকিৎসকের কাছে গিয়ে জানতে পারি আমি কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত। রোগটি ধরতে দেরি হওয়ায় তার শরীরে গুটি গুটি দাগ ওঠে, একপর্যায়ে মাংস পঁচে যায়। তবুও চিকিৎসা নিতে লজ্জা পাননি, কিন্তু সমাজের অবহেলা তাকে কষ্ট দিয়েছে সবচেয়ে বেশি।

তিনি যোগ করেন, প্রতিবেশী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমার সঙ্গে খেতে চাইত না। আমি যে পুকুরে গোসল করতাম, সেখানে আর কেউ নামত না। তবে সময়ের সঙ্গে বদল এসেছে। এটা কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। ওষুধ খেলে ভালো হয়ে যায়। সঠিক সময়ে রোগ ধরা পড়লে অঙ্গহানি হয় না বলে দাবি মেহেরুন্নেসার।

চিকিৎসা আছে, কিন্তু ভয় বড়

কুষ্ঠরোগ মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রাই নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়। মুখ ও নাকের ড্রপলেটের মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে থাকলে এটি ছড়াতে পারে, তবে সাধারণ ছোঁয়া, একসঙ্গে খাওয়া বা হাত মেলানোর মাধ্যমে নয়। চিকিৎসা শুরু করলেই রোগীর মাধ্যমে সংক্রমণ বন্ধ হয়ে যায়। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কুষ্ঠ নির্মূলের সবচেয়ে বড় বাধা হলো সামাজিক বৈষম্য। বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে কুষ্ঠ নির্মূলের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, কিন্তু সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের মতো অঞ্চলে ভয়ভীতির এই প্রাচীর না ভাঙলে সে লক্ষ্য অধরাই থাকবে।

বর্তমানে সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে কুষ্ঠ নির্মূলে একযোগে কাজ করছে সিএসএস (খ্রিষ্টান সার্ভিস সোসাইটি), দ্য লেপ্রসি মিশন বাংলাদেশ ও জেলা সিভিল সার্জন অফিস।

এবিষয়ে সিএসএস-এর প্রজেক্ট অফিসার মো. খালেকুজ্জামান বলেন, কুষ্ঠ নির্মূলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ একসঙ্গে কাজ করছে। আমরা সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের প্রতিটি উপজেলায় সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করছি।

সংস্থাটির দাবি, মানুষ এখনো মনে করে কুষ্ঠ মানেই ছোঁয়াচে, ঈশ্বরের শাস্তি। এই ভয় তাদের চিকিৎসা থেকে দূরে রাখে। তাদের মতে, দারিদ্র্য, অপুষ্টি আর সামাজিক লজ্জা মিলে কুষ্ঠকে টিকিয়ে রেখেছে। ওষুধ আছে, কিন্তু ভয় দূর করার ওষুধ নেই।

সরকারি হিসাবে, বর্তমানে সাতক্ষীরায় ৫১ জন এবং বাগেরহাটে ৭৪ জন রোগী চিকিৎসাধীন। স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, বাস্তব সংখ্যা এর অন্তত দ্বিগুণ। অনেকে নাম গোপন রাখেন, আবার কেউ চিকিৎসা শুরু করেও মাঝপথে থেমে যান।

এরফলে সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের উপকূলীয় অঞ্চলে কুষ্ঠরোগ শুধু শারীরিক নয়, সামাজিক কষ্টও সৃষ্টি করছে।

সাতক্ষীরার নাগরিক নেতা ও উন্নয়ন কর্মী মাধব চন্দ্র দত্ত বলেন, ‘এই দুটি জেলা দরিদ্র, অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের ঘর, যেখানে দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে কুষ্ঠরোগ দ্রুত ছড়ায়। সমাজে এখনো কুষ্ঠকে অভিশাপ বা শাস্তি মনে করা হয়, ফলে রোগীরা চিকিৎসা গোপন রাখে এবং সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। আর্দ্রতা, উচ্চ তাপমাত্রা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও অস্বাস্থ্যকর আশ্রয় সংক্রমণ বাড়াচ্ছে। কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণে প্রাথমিক শনাক্তকরণ, বিনামূল্যে চিকিৎসা, সচেতনতা প্রচার ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি অপরিহার্য। কমিউনিটি ক্লিনিক, উপজেলা স্বাস্থ্যকর্মী ও স্থানীয় প্রশাসন একযোগে কাজ করলে এই রোগ নির্মূল সম্ভব।’

বাগেরহাটের সিভিল সার্জন ড. আ.স. ম. মো. মাহবুবুল আলমের ভাষায়, ‘এই অঞ্চলের মানুষ দরিদ্র। তারা দিনমজুর বা শ্রমিক। চিকিৎসা নিলে কাজ হারাবে! এই ভয়ে অনেকেই লুকিয়ে থাকে। ফলে রোগ ধীরে ধীরে ছড়ায়।’

কেন এই দুই জেলা এগিয়ে যাচ্ছে? সমাধান কী?

দেশের উপকূলীয় এলাকায় কুষ্ঠ সংক্রমণ বাড়ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। কুষ্ঠের জীবাণু তাপমাত্রা সংবেদনশীল; ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এটি সবচেয়ে সক্রিয় থাকে এবং উষ্ণ ও আর্দ্র পরিবেশে দীর্ঘ সময় বাঁচতে পারে, ফলে সংক্রমণ বাড়ে (সেন্ট্রাল জার্নাল অব গ্লোবাল হেলথ, ২০২১)। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও নদীভাঙনের কারণে মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে; অস্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিহীন পরিবেশ কুষ্ঠ ঝুঁকি ত্বরান্বিত করছে (দ্য লেপ্রসি মিশন, ২০২২)। বাংলাদেশে এই বিষয় নিয়ে গবেষণা সীমিত হলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন রোগের বিস্তারকে অনুকূল করে এবং স্বাস্থ্যসেবা ও নীতি পরিকল্পনায় সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

এবিষয়ে সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন মো. আব্দুস সালাম বলেন, যেসব এলাকায় পানির লবণাক্ততা বেশি, সেখানে ত্বকের রোগ ও স্নায়ু ক্ষয় বেশি হয়। শরীর দুর্বল থাকে। এটাই কুষ্ঠের জন্য সহায়ক পরিবেশ। এই রোগের চিকিৎসা থাকলেও সামাজিক কলঙ্ক, অজ্ঞতা আর ভয়-এই তিন বাঁধাই কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসায় সবচেয়ে বড় শত্রু।

তার মতে, কুষ্ঠ এখন আর ভয় পাওয়ার মতো রোগ নয় এটি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। সরকারিভাবে প্রতিটি উপজেলায় প্রশিক্ষিত জনবল ও পর্যাপ্ত ওষুধ রয়েছে। সিএসএস এনজিওর সহযোগিতায় রোগী শনাক্ত ও চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে।

কুষ্ঠ নিয়ে সমাজে কিছু কুসংস্কার এখনো আছে, এজন্য আমরা নিয়মিত সচেতনতা সেমিনার, উঠান বৈঠক ও প্রচারণা কার্যক্রম পরিচালনা করছি, যাতে কেউ আর ভয় বা লজ্জার কারণে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হয়। চিকিৎসা নিলে কুষ্ঠে অঙ্গহানি হয় না। আগে মানুষ লজ্জা ও ভয়ের কারণে চিকিৎসা নিতে চাইত না, কিন্তু এখন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে মাঠপর্যায়ে অনেক কাজ হচ্ছে। পর্যাপ্ত ওষুধ মজুদ আছে এবং প্রতিটি রোগী নিয়মিত নজরদারিতে রয়েছে। আমাদের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে কুষ্ঠরোগীর সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনা।


Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.