× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

নাট্যমঞ্চ ভেঙে গড়ে উঠছে জাদুঘর

বিপ্লব শেখ, কবি নজরুল কলেজ

১৫ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৪৫ পিএম

কয়েক শতাব্দী পূর্বে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল রাজধানী ঢাকা। মোগল আমল থেকে শুরু হয়ে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল অতিক্রম করে নগরীর অলিগলিতে গড়ে উঠেছে বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা। হাজারো ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে সেসব অনেক স্থাপনায় আজ নীরবে, নিভৃতে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। তেমনি এক ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হলো নর্থব্রুক হল যা লালকুঠি নামেই অধিক পরিচিত।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে মুঘল এবং ইউরোপীয় রেনেসাঁর স্থাপত্যশৈলীর কারুকার্যের সংমিশ্রণে নির্মিত পুরান ঢাকার এই নান্দনিক ভবন নর্থব্রুক হল। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক ভবনটি দীর্ঘদিন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে ছিল। সম্প্রতি পুরনো কারুকার্য বজায় রেখে সংস্কার কাজ শুরু হলে ধীরে ধীরে স্বরূপ ফিরে পাচ্ছে নর্থব্রুক হল।

নর্থব্রুক হল একসময় ছিল ঢাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের আড্ডাঘর, বিনোদন ও সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র। ভবনটির অভ্যন্তরে ছিল একটি বিশাল নাট্যমঞ্চ, যেখানে নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ হতো এবং দেশবরেণ্য শিল্পীরা অংশ নিতেন। এছাড়াও সেই মঞ্চে অনুষ্ঠিত হতো সভা-সেমিনার ও নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এসব আয়োজনের উচ্ছ্বাসে মুখরিত হয়ে থাকতো পুরো লালকুঠির পরিবেশ।

তবে সংস্কারকাজ শুরু হলে নর্থব্রুক হলের ঐতিহ্যবাহী নাট্যমঞ্চটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সংস্কার শেষে ভবনের অভ্যন্তরে নর্থব্রুক হলের ইতিহাস, নির্মাণে সহযোগী ব্যক্তিবর্গ এবং তৎকালীন ঢাকার বিশিষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গের ছবি সংরক্ষণ করে ভবনটিকে জাদুঘরে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে এই সিদ্ধান্তে অনেকেই বিস্মিত, কারণ নাট্যমঞ্চটি শুধু স্থাপনার অংশই ছিল না, বরং এটি ছিল ঢাকার সাংস্কৃতিক জীবনের এক ঐতিহাসিক নিদর্শন। কেন এটি সংরক্ষণ করা হলো না? কেন ভেঙে ফেলা হলো? অনেকের মনে এমন প্রশ্ন।

নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর ঐতিহাসিক ভবন নর্থব্রুক হলের ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৮৭৪ সালে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় ও গভর্নর-জেনারেল জর্জ ব্যরিং নর্থব্রুক ঢাকায় সফরে এলে, তার এ সফরকে স্মরণীয় করে রাখতে ঢাকার ধনাঢ্য ব্যক্তি ও জমিদাররা একটি টাউন হল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ভবন নির্মাণে তৎকালীন প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। ভাওয়াল রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী একাই ভবন নির্মাণে ১০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। 

ইউরোপীয় রেনেসাঁর নকশা ও কারুকাজ ব্যবহার করে সৌন্দর্যমণ্ডিত ভবনটির নির্মাণকাজ ১৮৭৯ সালের শেষের দিকে সম্পন্ন হয়। ১৮৮০ সালের ২৫ মে গভর্নর জর্জ ব্যরিং নর্থব্রুক ভবনটি উদ্বোধন করেন। পরবর্তীতে তার নামানুসারেই ভবনটির নামকরণ করা হয় ‘নর্থব্রুক হল’। ভবনটি লাল রঙে রঙিন ছিল বলে স্থানীয়রা একে ‘লালকুঠি’ নামে ডাকতে শুরু করে। ধীরে ধীরে এ নামেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন নর্থব্রুক হল বা লালকুঠি।

১৮৮২ সালে নর্থব্রুক হলকে গ্রন্থাগার হিসেবে রূপান্তরিত করে এর সাথে  ‘জনসন হল’ নামে একটি ক্লাবঘর সংযুক্ত করা হয়। জানা যায়, ১৮৮৭ সালে এই গ্রন্থাগারের জন্য বিলেত থেকেও বই আনা হয়েছিল । তৎকালীন ঢাকার বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গের আড্ডা, বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের আনাগোনায় লালকুঠি ধীরে ধীরে সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা সফরে এলে তিনি স্বেচ্ছায় নর্থব্রুক হলে উঠেন। সেদিন ঢাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ব্যাপক আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সংবর্ধনা জানিয়েছিল। 

তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রন্থাগারের বহু মূল্যবান বই নষ্ট হয়ে যায়। পাকিস্তান আমল থেকেই নর্থব্রুক হল তার ঐতিহ্য হারাতে শুরু করে। দীর্ঘদিন অবহেলিত ও জরাজীর্ণ অবস্থায় থাকার পর ২০১৬ সালে ভবনটির ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পুরনো সাজ ও কারুকাজ অক্ষুণ্ন রেখে চলছে সংস্কার কাজ। সকাল থেকেই শ্রমিকরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সংস্কার কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে, বর্তমানে চলছে রঙের কাজ। সাদা ও সুরকি রঙ ব্যবহার করে নর্থব্রুক হল বা লালকুঠিকে আদি রূপে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। সংস্কারের ফলে নর্থব্রুক হল ধীরে ধীরে তার স্বরূপ ফিরে পাচ্ছে। কিন্তু নর্থব্রুক  হলের নাট্যমঞ্চটি ভেঙে ফেলা হয়েছে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ডালি কনস্ট্রাকশন এর দায়িত্বরত প্রকৌশলী বিপ্লব কুমার বলেন, পুরোনো ভবনের কাজ হওয়ায় কিছুটা দেরি হচ্ছে। নতুন কাজ হলে এতদিনে শেষ হয়ে যেত। পূর্বে যেমন ছিল তেমন রূপ দিতেই শ্রমিকরা সে অনুযায়ী কাজ করছে। কাজ প্রায় শেষের পথে রঙের কাজ ও অল্প কিছু হালকা কাজ বাকি আছে। আশা করছি, মাসখানেকের মধ্যেই সম্পূর্ণ কাজ শেষ হবে। 

নর্থব্রুক হলে ঘুরতে আসা শিক্ষার্থী দীপ্ত দাস জানান, একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি চাই নর্থব্রুক হল আবারও পুরোনো জ্ঞান ও শিল্পচর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠুক। কাজ শেষ হয়ে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত হলে টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করা হোক এবং এতে যা আয় হবে তা ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা রক্ষার্থে ব্যবহৃত হতে পারে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা যদি বৈধ আইডি কার্ড প্রদর্শন করে তাহলে তারা যেন বিনামূল্যে প্রবেশাধিকার পায়। এতে শিক্ষার্থীদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে, যা নাগরিক জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

মোহাম্মদ হারুন নামের এক স্থানীয় ব্যক্তি বলেন, পুরোনো কারুকাজ  রেখেই কাজ চলছে, তবে ইটগুলো আধুনিকায়ন করার পরিকল্পনা করছিল। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যেভাবে রয়েছে, সেভাবেই কাজ করতে হবে। তবে এখন নর্থব্রুক হলের ভেতরের মঞ্চটি ভেঙে ফেলেছে। সেখানে নর্থব্রুক হলের ইতিহাস ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের ছবি রেখে জাদুঘরের মতো করবে । আগে এই মঞ্চে সেমিনার, নাটকসহ নানা আয়োজন হতো আমরাও অংশ নিতাম। কিন্তু এখন কর্তৃপক্ষ সেটি আর রাখছে না।

ভবনটি সবার জন্য উন্মুক্ত হলে বিনামূল্যে প্রবেশের ব্যবস্থা রাখা হবে নাকি টিকিট সিস্টেম চালু করা হবে এমন প্রশ্ন উত্তরে তিনি বলেন, বিনামূল্যে প্রবেশের অনুমতি দিলে অনেক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে । তাই আমার মনে হয় স্বল্পমূল্যের টিকিট সিস্টেম চালু করাই যুক্তিযুক্ত হবে।

নর্থব্রুক হলের ঐতিহ্যবাহী নাট্যমঞ্চটি কেন ভেঙে ফেলা হয়েছে এবং কেন সেটি সংরক্ষণ করা হয়নি-এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ( ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগ) আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা বলেন, এটি আমাদের সংরক্ষিত পুরাকীর্তি, তবে এর দায়িত্বভার দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের। তারা প্রাচীন স্থাপত্যবিষয়ক পরামর্শকের সহায়তায় কাজটি সম্পন্ন করেছে। এখন কেন তারা এটি ভেঙে ফেলেছে, সে বিষয়ে তারাই ভালো বলতে পারবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, মঞ্চটি কি খুলে ফেলা হয়েছে? খুলে ফেললে তো অবশ্যই সংরক্ষণ করা হবে।

তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে আমার জানা নেই, আমাকে একটু দেখতে হবে। আপনি মেসেজ দিয়ে রাখেন, আমি কয়েক দিনের মধ্যে পরিদর্শনে আসব।


Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.