গুলতি, মাটির বা মার্বেলের গুলি প্রভৃতি ছোড়ার প্রাচীন ও দেশি অস্ত্রবিশেষ। অঞ্চলভেদে একে গুলই, ছটকা, বাটুল প্রভৃতি নামেও ডাকা হয়। বাংলা সাহিত্যে অনেক জায়গায় গুলতির ব্যবহার লক্ষ করা যায়। আবহমান বাংলায় কিশোর জীবনের বিভিন্ন ক্রীড়াসামগ্রী যেমন-লাটিম-নাটাইয়ের পাশাপাশি গুলতির গুরুত্বও কম ছিল না।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি থেকে অনেক কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। পরিবর্তিত হচ্ছে অনেক বিষয়। শৈশব ও কৈশোরের খেলার অন্যতম অনুসঙ্গ ছিল গুলতি, লাটিম, ডাংগুলি, মার্বেল, ঘড়ি ওড়ানোর জন্য নাটাই ও সুতা মাঞ্জ দেয়া ইত্যাদি। এর মধ্যে ‘গুলতি’ ছিল প্রায় সবার হাতে হাতে। কয়েক বছর আগেও গ্রামাঞ্চলে ‘গুলতি’ ছাড়া শিশুদের ভাবাই যেতো না। পেয়ারা, বেল, জাম, কাঁঠালসহ নানা জাতের শক্ত গাছের সরু অনেকটা ইংরেজি ‘ওয়াই’ অক্ষরের ন্যায় ডাল কেটে, বাইসাইকেলের টিউব ও এক টুকরো চামড়া দিয়ে তৈরি করা হতো ‘গুলতি’। বস্তুটির পুস্তকি নাম ‘গুলতি’ হলেও দেশের কোন অঞ্চলে এটি গোলাইল, গুলই, বাটুল, ছটকা ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল। গ্রামের শিশু-কিশোররা অনেকটা সহজেই তৈরি করতে পারতো গাঁয়ের খেলার অন্যতম পণ্য ‘গুলতি’।
গুলতি তৈরির পর ছোট পাথর, ইটের টুকরো, মাটির তৈরি ছোট গোলাকার মার্বেল ইত্যাদি দিয়ে গুলতির গুলি ছোড়া হতো। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের অনেক কালজয়ী গল্প-উপন্যাসেও গুলতির কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু আজ আবহমান বাংলার ঐতিহ্য থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী গুলতিটি। বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশই গুলতি দেখেনি বা এর ব্যবহার সম্পর্কে জানে না।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, গুলতির প্রথম আবিস্কারক গ্রিকরা। প্রাচীনকালে এটি যুদ্ধের ময়দানেও শত্রু ঘায়েল করতে ব্যবহার হতো বলে জানা যায়। যুদ্ধের ময়দানে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই গুলতি। গুলতিতে ব্যবহার হতো পোড়া মাটির গোলাকার মার্বেল। প্রাচীনকালে মাটি কাদা করে মার্বেলের মতো গোলাকার করে রোদে শুকিয়ে বা আগুনে পুড়িয়ে তৈরি করা হতো গুলতির গুলি। পরবর্তীতে ছোট পাথর, মার্বেল, ইটের টুকরো ব্যবহার শুরু হয় গুলতিতে। ধীরে ধীরে যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে এই গুলতি হয়ে ওঠে গ্রামাঞ্চলের শিশু-কিশোরদের খেলার অনুসঙ্গ। গ্রামাঞ্চলের শিশু-কিশোরটা পাখি শিকার কাজে এবং খেলায় এটি ব্যবহার করা শুরু করে। বর্তমানে এটি হারিয়ে যেতে বসেছে।
বয়োবৃদ্ধ আব্দুর রহমান (৭৫)। বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলার শিমুল তলা গ্রামে। ৭ সদস্যের পরিবারের মধ্যে ৩ ছেলে ২ মেয়ে।ছেলেরা মা বাবাকে ছেড়ে স্ত্রী সন্তান নিয়ে অন্যেত্রে বসবাস করেন। মেয়ে দুজনের বিয়ে হয়েছে। ছেলে ও মেয়েরা আলাদা চলে যাওয়ায় পরিবারের হাল ধরেন আব্দুর রহমান নিজেই। বিভিন্ন স্থানে ফুটপাতে বসে গুলতি বিক্রি করেন তিনি। জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের আদমপুর বাজারে বসে গুলতি বিক্রি করতে দেখা যায় বয়োবৃদ্ধ আব্দুর রহমান (৭৫)-কে।
তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘এক সময় আমাদের দেশের গ্রাম-গঞ্জের শিশু-কিশোরদের হাতে হাতে ছিল গুলতি। বিকাল বেলা শিশু-কিশোররা গুলতি ও পকেটে মার্বেল জাতীয় বস্তু নিয়ে বেড়িয়ে পড়তো গ্রামের মেঠোপথে। সারা বিকেল চলতো গুলতি নিয়ে খেলা। এখন আর গুলতি দেখা যায় না। মোবাইল ফোনের যুগে গুলতি হারিয়ে যাচ্ছে। শিশু-কিশোররা এখন মোবাইলে গেইম খেলায় ব্যস্ত সময় পাড় করছে। আমি যেমন পরিবার চালাতে যেমন এই ব্যবসা করছি ঠিক তেমনি সে গুলতিকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে এবং বর্তমান প্রজন্মের কাছে এটিকে পরিচিত করে তুলতে বাড়িতে তৈরি করে ফুটপাতে বসে বিক্রি করি।’
তিনি বলেন, ‘প্রাচীনকালে গুলতির একটি বড় রূপ যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো। এই যন্ত্র প্রথম আবিষ্কার করে গ্রিকরা। পড়ে বিভিন্ন যুদ্ধে বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী কোনো দুর্গের মাঝে বড় বড় পাথর ও আগুনের গোলা ছুড়ে মারার জন্য এটি ব্যবহার করত। বর্তমানে যুদ্ধক্ষেত্রে এর ব্যবহার নেই বললেই চলে।’