স্টেশনগুলোতেও বাড়ছে যাত্রীর সংখ্যা। তবে ইঞ্জিন সংকটে নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিতে পারছে না রেলওয়ে। রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের লালমনিরহাট ডিভিশনের অধীনে ১৩টি আন্তঃনগর, চারটি কমিউটার ও ছয়টি লোকাল ট্রেন নিয়মিত চলাচল করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত ইঞ্জিন (লোকোমেটিভ) সংকট পুরনো এবং মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন দিয়ে অধিক ট্রেন চালানোর জন্য মাঝেমধ্যেই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। পণ্য পরিবহনেও অনেক সময় বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। মালবাহী বগি (বিসি ব্লক রেক) ইঞ্জিনের অভাবে স্টেশনে পড়ে থাকছে দিনের পর দিন। ডিভিশনে বর্তমানে রেলের ২২ ইঞ্জিনের মধ্যে ২০টি চালু রয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন রেলসেবা নিশ্চিত করতে আরো অন্তত ১৫টি ইঞ্জিন প্রয়োজন।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসে ৯ দিনের ব্যবধানে গাইবান্ধা এবং রংপুরে চলন্ত ট্রেন বিকল হওয়ায় বিপাকে পড়েন যাত্রীরা। দুই ট্রেনে থাকা একাধিক যাত্রী তাদের ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন। সপ্তাহখানেক আগে আন্তঃনগর দোলনচাঁপা সান্তাহার রেলস্টেশন থেকে পঞ্চগড়ের উদ্দেশে রওনা হয়। এদিন দুপুর ২টা ৪৫ মিনিটে গাইবান্ধায় পৌঁছলে ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দেয় এবং ট্রেনটি বিকল হয়ে রেললাইনে আটকে থাকে। পরে বোনারপাড়া থেকে রিলিফ ইঞ্জিন এনে ট্রেন চালু করতে দুই ঘণ্টা সময় লেগে যায়।
বিকল হওয়ায় ট্রেনে থাকা পঞ্চগড়ের ইসরাত জাহান তার ছোট ভাইকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না এখন তার কি করা উচিত। ট্রেন পুনরায় কখন ছাড়বে তা জানতে না পেরে এবং সঙ্গে অভিভাবক না থাকায় তাদের দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে যায়। একই ধরনের দুশ্চিন্তায় পড়ে যান গত ৯ দিন আগে দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলা থেকে রংপুরের উদ্দেশে ছেড়ে আসা ৬৪ ডাউন ট্রেনের যাত্রীরা। সকাল ৬টা ৪৫ মিনিটে যাত্রাপথে শ্যামপুর এলাকায় ট্রেনটি বন্ধ হয়ে যায়।
একই ট্রেনের যাত্রী শামসুল ইসলাম বলেন, ট্রেন কেন বন্ধ হয়ে গেল বিষয়টি বুঝতেই ১৫ মিনিট চলে গেল। পরে জানতে পারলাম ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দেয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে। এখন ভালো ইঞ্জিন আসবে তারপর ট্রেন ছাড়বে। তবে যাত্রীদের ভাগ্য ভালো গন্তব্যের খুব কাছে এসে ট্রেন থেমে যাওয়ায় অনেকে বিকল্প ব্যবস্থায় রওনা হন।
রেলযাত্রী ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইঞ্জিন সংকটে শুধু যাত্রীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তা নয়। এর প্রভাব পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্যেও। অন্য ব্যবসার পাশাপাশি সময়মতো জ্বালানি তেল রংপুরে আসতে না পারায় মাঝেমধ্যে বিড়ম্বনা পড়ছেন পেট্রল পাম্প মালিকরা। বিশেষ করে বোরো মৌসুমে সময়মতো জ্বালানি তেলের প্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার্স, ডিস্ট্রিবিউটর, এজেন্ট অ্যান্ড পেট্রল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন রংপুর জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক মো. রিয়াজ শহীদ শোভন বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনের ওয়াগানে করে কেরোসিন, ডিজেল, পেট্রল এবং অকটেন নিয়ে আসা হয়। ইঞ্জিন সংকটে সময়মতো জ্বালানি তেল না পেয়ে পেট্রল পাম্প মালিকরা নানা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। অনেক সময় দূর-দূরান্ত থেকে তেল সংগ্রহ করতে গিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছেন।
রংপুর রেলস্টেশন গিয়ে দেখা গেছে, ১৩ দিনেরও বেশি সময় আগে চট্টগ্রাম থেকে একটি মালগাড়ি (বিসি ব্লক রেক) রংপুর সরকারি খাদ্যগুদামের জন্য গম নিয়ে এসেছে। রেক (বগি) দ্রুত ফিরে যাওয়ার তাগদা থাকলেও শুধু ইঞ্জিনের অভাবে ছেড়ে যেতে পারছে না। ট্রেনটির সঙ্গে আসা এসকর্ট সদস্যদেরও বাধ্য হয়ে রংপুরে অবস্থান করতে হচ্ছে।
রংপুর রেলওয়ের সুপারিনটেনডেন্ট শংকর গাঙ্গুলী বলেন, রংপুরে রেলে যাত্রীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিন স্টেশন দিয়েই ২-৩ হাজার মানুষ চলাচল করে। ইঞ্জিন সংকটে ট্রেনের নিরবচ্ছিন্ন সেবা দেয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে এ সমস্যা আরো বেড়েছে। লালমনিরহাট রেল ডিভিশনের অধীন যত ট্রেন চলাচল করে সে তুলনায় রিলিফ ইঞ্জিন অনেক কম। ডিভিশনের যেকোনো প্রান্তে চলমান ট্রেন বিকল হলে লালমনিরহাট, গাইবান্ধার বোনারপাড়া এবং দিনাজপুরের পার্বতীপুরে রক্ষিত রিলিফ ইঞ্জিন গিয়ে সেটি সচল করার চেষ্টা করে। এতে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লাগছে।
চট্টগ্রাম থেকে আসা মালবাহী ট্রেনের বগি আটকে থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইঞ্জিন সংকটে মালবাহী ট্রেনের ৩০ বগির মধ্যে ১৯টি সাত দিন ধরে আটকে রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ইঞ্জিন পাওয়া যায়নি। বগিগুলো এখনো স্টেশনে রয়েছে।
লালমনিরহাট ডিভিশনাল রেল বিভাগের যন্ত্র প্রকৌশলী (লোকো) শাহিনুল হক অপু বলেন, ডিভিশনে বর্তমানে রেলের ২২ ইঞ্জিনের মধ্যে ২০টি চালু রয়েছে। আরো ১৫টি ইঞ্জিন প্রয়োজন। সারা দেশের রেলের জন্য ৩০টি ইঞ্জিন আনার কথা রয়েছে। যদি এগুলো সরকার আনে তাহলে এ ডিভিশনে ইঞ্জিন সংকট থাকবে না।
তবে কবে নাগাদ ইঞ্জিন পাওয়া যেতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, টেন্ডারের মাধ্যমে বিদেশ থেকে ইঞ্জিন আনতে হয়। সব প্রক্রিয়া শেষ হতে কমপক্ষে আড়াই বছরের মতো সময় লাগবে। টেন্ডার হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি অবগত না তাই কিছু বলতে পারছি না।