বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী বলেছেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও এদেশে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা হয়নি। বিগত সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার একক দাবিদার বলে চালিয়েছে দীর্ঘদিন। মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমান, এম এ জি ওসমানী, মাওলানা ভাসানী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনোরঞ্জন ধর, মনি সিংহসহ আরো যারা দেশের জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন তাদের মূল্যায়ন করা হয়নি। আওয়ামী লীগ শুধুমাত্র ভোটের জন্য হিন্দুদের ব্যবহার করে। অথচ হিন্দুদের সম্পত্তি দখল হয়েছে এবং তাদের বাড়ি ঘর করা হয়েছে দখল।
শুক্রবার (২২ নভেম্বর) বিকেলে রংপুর নগরীর মাহিগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ মাঠে বিভাগীয় সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি এসব কথা বলেন। সারাদেশে হিন্দু নির্যাতন, নিপীড়ন, মঠ-মন্দিরে হামলার প্রতিবাদ ও ৮ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রংপুরে এ সমাবেশর আয়োজন করে বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ।
সামবেশে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী বলেন, জুলাই বিপ্লবে শহীদ হয়েছেন আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ আরো অনেকে, তাদের রক্তের সাথে যেন বেঈমানী করা না হয়। আমদের প্রাণের ৮ দফা দাবি মানতে হবে। এটা কোন রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা নয়, এসব দাবি এ দেশের হিন্দু সমাজের প্রাণের দাবি। আমাদের সংগঠনকে জঙ্গি বলে ট্যাগ দিচ্ছে একটি মহল যা কাম্য নয়। এদেশ আমাদের, এখানে আমরা থাকব আর এখানেই মরবো।
তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের পর অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। আন্দোলনের কারণে পরীক্ষা ছাড়াই পাস মেলছে, আন্দোলনে অনেক বিষয়ে স্বীকৃতি মিললেও তিন মাস হয়ে গেলো আমাদের বিষয়ে কোন সমাধান হয়নি। বরং এখনও হিন্দুদের বাড়িঘর লুট করা হচ্ছে, হিন্দুদের চাকরি যাচ্ছে, যা কষ্টদায়ক। আমরা ই বলতে চাই, সনাতনীদের এ দেশ থেকে উৎখাতের চেষ্টা হলে পরিণতি ভালো হবে না। সনাতনী ধর্মের সকল সংগঠন আজ ঐক্যবদ্ধ, তাই দেখে অনেকে ঈর্ষান্বিত হয়ে সমাবেশে আসতে বাধা প্রদান করছেন। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, সাধুরা সমবেত হয়েছেন সনাতনীদের দাবি আদায়ে। সনাতনীদের ওপর যতই নিপীড়ন হবে, আমরা ততো বেশি ঐক্যবদ্ধ হবো।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী সকল সনাতনীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমরা যদি এসব প্রশ্রয় দেই, প্রশ্রয় দিলে এই বাংলাদেশ ইরাক হবে, লিবিয়া, সিরিয়ার মতো হবে। তাহলে কোন সরকার স্থায়ী ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। বিদেশি শক্তি এখনই থাবা দেয়ার প্রচেষ্টা করছে। তাই বলতে চাই, আমার মা আমাদের কাছে যেমন, এই মাতৃভূমিও আমার মায়ের মতো। আমরা এখানে জন্মেছি, এখানেই থাকবো। কোথায় যাবো না।
তিনি আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন এ দেশে কেউ সংখ্যালঘু না, সবাই বাংলাদেশী। সেই কথার প্রেক্ষিতে বলতে চাই, সনাতনীরা কোন নির্দিষ্ট দলের কিংবা রাজনৈতিক দলের সমর্থন করে না। আমাদের ন্যায় অধিকার যারা নিশ্চিত করবে আমরা তাদেরই ভোট দিবো। আমরা রাষ্ট্রবিনির্মাণে সহযোগিতা করতে চাই। আমরা উপদেষ্টা হতে চাই না। আমরা ক্ষমতা চাই না। রাষ্ট্রবিনির্মাণে সহযোগি হতে চাই।
সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন সনাতনী বিদ্যার্থী সংসদের প্রতিষ্ঠাতা বরণ কুশল চক্রবর্তী, চট্টগ্রামের গিরি আশ্রমের অধ্যক্ষ স্বামী ওমেশানন্দ গিরি মহারাজ, বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের স্বামী বিপ্রানন্দ জী, শ্রী শ্রী গোপীনাথ ব্রহ্মচারী, স্বামী বিরাজানন্দ মহারাজ, সন্ন্যাসী রননাথ মহারাজ, মনোরঞ্জন দাস ব্রহ্মচারী, সন্ন্যাসী শনিনন্দ মহারাজ, গোপিনাথ ব্রহ্মচারী, স্বামী পরিনন্দ মহারাজসহ বিভাগীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ।
এছাড়াও বক্তব্য রাখেন- হিন্দু ধর্মীয় নেতা কমল বরণ, দয়াল চন্দ্র বর্মন, পুতিসশীল, সুমন কুমার রায়, সুজিত সরকার, লিটন চন্দ্র, সরেন সাহা, সুজন দত্ত, অলোক গোস্বামী, প্রবীর কান্তি দেব, রুবেল দাস, নিহার হালদার, বীনা রানী বল, রাজেশ মহন্ত, দীপংকর ভট্টাচার্য, চন্দন সরকার, শিবু সরকার, পিযুস দাস প্রমুখ।
সমাবেশ থেকে ৮ দফা দাবি জানানো হয়। দাবি দাবিগুলো হলো-
১. সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচারের জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান, ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন।
২. অবিলম্বে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন।
৩. সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন।
৪. হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে ‘হিন্দু ফাউন্ডেশনে’ উন্নীত করাসহ বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মীয় ট্রাস্টকেও ফাউন্ডেশনে রূপান্তর।
৫. ‘দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ আইন’ প্রণয়ন এবং ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন আইন’র যথাযথ বাস্তবায়ন।
৬. সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোতে সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য উপাসনালয় নির্মাণ ও প্রতিটি হোস্টেলে প্রার্থনা কক্ষ বরাদ্দ করা।
৭. ‘সংস্কৃত ও পালি শিক্ষাবোর্ড’ আধুনিকায়ন।
৮. দুর্গাপূজায় ৫ দিন ছুটিসহ প্রতিটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবে প্রয়োজনীয় ছুটির ব্যবস্থা করা।
এর আগে হিন্দু জাগরণ মঞ্চের ব্যানারে রংপুর জিলা স্কুল মাঠে সমাবেশ করার কথা ছিলো। জেলা প্রশাসন অনুমতি দিলেও বৃহস্পতিবার রাতে সমাবেশের স্থান পরিবর্তন করা হয়। সেই পরিবর্তিত
স্থান হিসেবে মাহিগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ মাঠে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। দুপুর ২ সমাবেশ শুরু কথা থাকলেও বিকেল ৩ টায় সমাবেশ শুরু হয় এবং সন্ধ্যার আগেই শেষ হয়।
সমাবেশে রংপুর বিভাগের আট জেলার ৫৪টি উপজেলা থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ অংশ নেয়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মাহিগঞ্জ কলেজ এর মাঠ কানায় কনায় পূর্ণ হয়। সভাস্থল থেকে প্রায় ৩-৪ কিলোমিটার সড়ক জনসমাগমে পূর্ণ হয়ে যায়।