রাজশাহী মহানগরীর সমন্বিত নগর অবকাঠামো প্রকল্পের আওতায় ৩০টি ওয়ার্ডে উন্নয়নকাজ চলমান রয়েছে। এরইমধ্যে অনেক রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। তিন বছর মেয়াদী এ উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ গত বছরের (২০২৩) জুনে শেষ হয়েছে। দেশের অস্থিতিশীল পরিবেশের কারণে প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বৃদ্ধির জন্য প্রস্তবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানায় সূত্র।
যেসব রাস্তার কাজ এরইমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অনেকস্থানের রাস্তার ওপরের অংশের পিচঢালা পাথর ও খোয়া উঠে যাচ্ছে। নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে এসকল উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে।
অভিযোগ আছে, প্রতিটি উন্নয়ন কাজে রাসিকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা আগে ২০-২৫ ভাগ পর্যন্ত কমিশন আদায় করতেন। এর বাইরে প্রকৌশলীরা নিতেন ৩-৫ পার্সেন্ট কমিশন। যার কারণে কাজের মান খারাপ হয়েছে বলে দাবি অনেকের। তবে বিভাগীয় কমিশনার রাসিকের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরে এখন অনেকটায় পরিস্থিতি ভালো হয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু প্রকৌশলী দপ্তরের কমিশন থামেনি এখনো।
স্থানীয়রা বলছেন, যেসব রাস্তা নিমার্ণ বা সংস্কার করা হয়েছে সেসব রাস্তায় অধিকাংশ ইটের খোয়া ব্যবহার করা হয়েছে বাড়ি ভাঙ্গা পুরনো ইটের। আবার ওপরের অংশে যে পরিমাণ বিটুমিন ও পাথর দিয়ে কার্পেটিং করার কথা ছিল, সেখানেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ফলে ছয় মাস না যেতেই ওয়ার্ড পর্যায়ের ওইসব রাস্তাগুলোর কার্পেটিং উঠে যাচ্ছে। সরেজমিন রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভও ছড়িয়ে পড়েছে স্থানীয় মানুষের মাঝে।
স্থানীয় এলাকাবাসীর দাবি, ড্রেন, ফুটপাত ও রাস্তা নির্মাণ বা সংস্কারের সময় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঠিকাদাররা ব্যাপক অনিয়ম করেছেন। এলাকাবাসীর পক্ষে নগর কর্তৃপক্ষ ও রাসিকের প্রকৌশলীদেরকে ফোন করে বার বার অভিযোগও করা হয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। উল্টো ঠিকাদাররা ইচ্ছামতো কাজ করে গেছেন দাপটের সঙ্গে। কারণ সমস্ত কাজেরই দেখভাল করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ফলে তাদের দাপটে ঠিকাদাররা দায়সারা গোছের কাজ করে সরকারি অর্থ লোপাটের মহোৎসবে নেমেছিলেন।
বিলসিমলা, তেরোখাদিয়া, শালবাগান (বিজিবি স্কুল রোড), কয়েরদাঁড়া, মহিষবাথান, হড়গ্রাম বাজার, কারিতাস মোড়, ও রাজপাড়া এলাকাসহ আরো বেশ কয়েকটি এলাকায় কয়েকমাস পূর্বে শেষ হওয়া রাস্তার অবস্থা ভাল না। অন্যদিকে, নগরীর ১৫ নং ওয়ার্ড অন্তর্গত সপুরা এলাকার অন্যতম দুটো সড়কজুড়ে রয়েছে অসংখ্য খানাখন্দ। বলতে গেলে রাস্তাটি চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। সরেজমিনে গিয়ে সেটির সত্যতাও মেলে। নগরীর শালবাগান (বিজিবি স্কুল রোড) এলাকার সড়টির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে মাস তিনেক আগে। নির্মাণকালীন সময়ে নিম্নমানের কাজ নিয়ে স্থানীয়রা রাসিক কর্তৃপক্ষকে জানালেও কোন ব্যবস্থাই নেয়নি কর্তৃপক্ষ। তিনমাস যেতে না যেতেই রাস্তাটির বেহাল দশা। ইটের খোয়া দিয়ে করা কার্পেটিং এরই মধ্যে উঠকে শুরু করেছে। বিজিবি (শহীদ কর্ণেল কাজী এমদাদুল হক পাবলিক স্কুল) স্কুলে আসা যাওয়া একমাত্র সদক এটি। রাস্তার কার্পেটিং উঠে যাবার কারণে যাতায়াতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়দের।
সূত্র থেকে জানা গেছে, নগরীর ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ৬ কোটি ৮০ লাখ টাকার উন্নয়ন প্যাকেজের আওতায় মহিষবাথান ঈদগাহ থেকে হড়গ্রাম বাজার ও কারিতাস মোড় থেকে রাজপাড়া মোড় পর্যন্ত ১ দশমিক ৩ কিলোমিটার গড়ে ৪
মিটার প্রশস্ত রাস্তাটি সংস্কার হয়। কিন্তু দুটি রাস্তারই এরইমধ্যে কার্পেটিং উঠতে শুরু করেছে।
নগরীর বিলসিমলা এলাকার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘রাজশাহী বিভাগীয় স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তাটি মাত্র মাস দুয়েক আগে নির্মাণকাজ শেষ করেছে ঠিকাদার। ওইসময় রাস্তায় যেসব খোয়া ফেলা হয়েছিল, তার অধিকাংশই ছিলো ভাঙ্গাবাড়ি ও রাস্তার পুরনো ইটের খোয়া। রাস্তা নির্মাণের সময় পাথরের ব্যবহার চোঁখেই পড়েনি। কার্পেটিংয়ের সময়ও পাথরের ব্যবহার চোখে পড়েনি। বিটুমিনের পরিমাণও ছিল নামেমাত্র। এরই মধ্যে কার্পেটিং উঠতে শুরু করেছে। হয়তো কয়েক মাসের মধ্যে আবারও পূর্বের ন্যায় খানা-খন্দে ভরে যাবে রাস্তাটি।’ তিনি আরো বলেন, রাস্তাটি নির্মাণের সময় রাসিকের প্রকৌশলীদের বার বার অভিযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তারা এসে উল্টো আরও টাকা-পয়সা খেয়ে চলে যায় মনে হয়েছে। না হলে এই কাজ এতো নিম্নমাণের হওয়ার কথা না।
একই অভিযোগ করেন নগরীর কয়েরদাঁড়া এলাকার আব্দুর ওয়াহব। তিনি বলেন, এই এলাকার ভিতর দিয়ে যাওয়া রাস্তাটির সংস্কারকাজ শেষ করা হয়েছে। কিন্তু এখনই কার্পেটিং উঠে যাচ্ছে। কাজ তো ভালোভাবে করিনি। সরকারি অর্থ লুট করেছে।’
নগরীর তেরোখাদিয়া এলাকার নাজিম উদ্দিন বলেন, এই এলাকায় বর্ষায় জলাবদ্ধতা লেগেই থাকে। যে ডেন নির্মাণ করা হয়েছে সেটি কোনোই কাজে আসছে না। আবার ড্রেন নির্মাণের সময় নিম্নমাণের সামগ্রি ব্যবহার করা হয়েছে। লোহার রডগুলোও ঠিকমতো ব্যবহার হয়নি।’
রাসিকের একটি সূত্র জানায়, প্রতিটি উন্নয়ন কাজে রাসিকের প্রকৌশলীরা অন্তত ৩-৫ পার্সেন্ট কমিশন আদায় করেন। সরকারি প্রকল্পে অলিখিত দুই ভাগ কমিশন আদায় করেন প্রকৌশলীরা। সেখানে রাসিকের প্রকৌশলীরা আদায় করেন তিন ভাগ। এতে কাজের মান আরও খারাপ হচ্ছে। এর বাইরে রাসিকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা আদায় করতেন ২৫-২৫ ভাগ। সবমিলিয়ে রাসিকের উন্নয়ন কাজে অন্তত ২৫ ভাগ টাকা হত টেবিলে টেবিলে ভাগ-বাটোয়ারা। তবে এখন অনেকটা কমে গেছে। তবে এখনো বেপরোয়া প্রকৌশলীরা। তারা কমিশন ছাড়া কোনো বিল ছাড় করেন না বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক ঠিকাদার।
রাসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড,এবিএম শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘কোনো কাজে অনিয়ম হয়ে থাকলে, সেগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে কাউকেই এখন আর নিম্নমাণের কাজ করতে দেওয়া হবে না।’