চরফ্যাসন উপজেলায় বেশিরভাগ মানুষের জীবনের চাকা ঘোরে নদীতে মাছ শিকার করে। একমাত্র ইলিশের অভয়াশ্রম তেঁতুলিয়া ও মেঘনা নদীতে মাছ শিকার করে থাকেন এসব জেলেরা। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে আশানুরূপ ইলিশের দেখা পায়নি জেলেরা। আশঙ্কাজনক হারে কমেছে ইলিশ। চলতি মৌসুমে ইলিশ না পাওয়ার কারণে দুশ্চিন্তা আর হতাশা নিয়ে খালি হাতে ঘাটে ফিরেছেন জেলেরা। মহাজনদের দাদন ও এনজিওর ঋণ খেলাপিতে মুনাফা বেড়েছে।
তাই ঋণের টাকা পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় জেলেরা। এদিকে জাটকা সংরক্ষণ ও মা ইলিশের প্রজনন রক্ষায় তেঁতুলিয়া ও মেঘনা নদীর অভয়াশ্রম এলাকায় ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা। সুষ্ঠু, প্রজনন, উৎপাদন, সামুদ্রিক মৎস্য সংরক্ষণ এবং টেকসই মৎস্য আহরণের জন্য মাছ শিকারের ক্ষেত্রে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। ১৩ অক্টেবার থেকে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। আগামী ৩ নভেম্বর পর্যন্ত সাগরে জারি থাকবে এ নিষেধাজ্ঞা। ২২ নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় চরফ্যাসনের জেলে পল্লীতে চলছে নীরব কান্না।
উপজেলা মৎস্য অফিসের তথ্যমতে, চরফ্যাশন উপজেলায় প্রায় ৯০ হাজার জেলে রয়েছে। তবে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৪৪ হাজার ২৮১ জন। অনিবন্ধিত প্রায় ৪৬ হাজার জন। এ ছাড়াও বছরের অধিকাংশ সময়ই নদীতে ইলিশ ধরার ক্ষেত্রে সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকে। ডিম ছাড়ার সময় ২২ দিন, জাটকা বড় হওয়ার সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে ২৪০ দিন এবং সাগরে মৎস্য সম্পদ রক্ষা করতে ৬৫ দিন এই তিন দফায় মোট ৩২৮ দিন সাগর বা নদীতে ইলিশ মাছ ধরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকে সরকারের।
উপজেলার সামরাজ, খেজুর গাছিয়া ও মাইনুদ্দি মৎস্য ঘাটে গেলে জেলে মনির, খোরশেদ ও সামসুদ্দিন জানান, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ইলিশের ভড়া মৌসুম। জেলেরা সারা বছর ধরে এ মৌসুমের অপেক্ষায় থাকে। মৌসুম চলে আসলে পূর্ণ আশা নিয়ে জেলেরা ইলিশ আহরণের জন্য তেঁতুলিয়া ও মেঘনা নদীতে নেমে পড়েন। তবে কয়েক বছর আশঙ্কাজনক হারে ইলিশ কমে যাওয়ার কারণে জেলেরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। বছরে কয়েকটি নিষেধাজ্ঞা ও দুর্যোগের কবলে পড়তে হয় জেলেদের। তারপরও বারবার আশাহত হয়েও হাল ছাড়ছেন না তারা। নিষেধাজ্ঞা দেওয়াতে জেলেরা পড়ছেন অস্তিত্ব সংকটে। মহাজনদের দাদন এবং ধারদেনায় জর্জরিত হয়ে জেলেরা রয়েছে চরম বিপাকে।
তা ছাড়া ও সরকার এই ২২ দিনের অবরোধে ৪০ শতাংশ জেলেদের জন্য চাল বরাদ্দ করেছে। অনিবন্ধিত ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত কয়েকজন জেলে জানান, এখনো পর্যন্ত অনেক প্রকৃত জেলে নিবন্ধনের সুযোগ পায়নি। নামেমাত্র অনেক জেলে নিবন্ধনের সুযোগ পেয়ে সরকার বরাদ্দ চাল গ্রহণ করে থাকে। পাশাপাশি অনেক জেলে পেশা পরিবর্তনের পরেও এ সুবিধা গ্রহণ করে যাচ্ছে। এ ছাড়াও নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সামান্য চাল বরাদ্দে তাদের জীবন নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই সরকারি অনুদান বৃদ্ধির পাশাপাশি সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের অনুরোধ করেন তারা।
মৎস্য আড়ৎদার মহসিন খালাশি জানান, বিগত কয়েক বছর লোকসান গুনতে হয়েছে। ইলিশের মৌসুম আসলে আশানুরূপ ইলিশ পাবে জেলেরা এই চিন্তা মাথায় রেখে প্রতিবছরে ট্রলার মালিকদের দাদন দিচ্ছি। পর্যাপ্ত পরিমাণ ও সঠিক সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইলিশ সরবরাহ করার কারণে ট্রলার মালিকদের দাদন দেওয়া হয়। ট্রলার মালিকরা তাদের জেলেদের অগ্রিম দাদন দিয়ে রাখতে হয়।
ট্রলার মালিক মো. সালাউদ্দিন জানান, সরকার মাছের প্রজনন বৃদ্ধি ও জেলেদের স্বার্থে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। তবে সেটা যদি মৎস্য পেশাকে নিশ্চিহ্ন করে তাহলে অতি সম্প্রতি এই পেশায় সংকট দেখা দেবে। তাই নিষেধাজ্ঞার সময় জেলেদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা জরুরি। চরফ্যাসন উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার অপু জানান, বিগত কয়েক বছর ধরে জেলেরা কাঙ্ক্ষিত ইলিশের দেখা পাইনি। তাদের দৈনন্দিন আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। তাই বিভিন্ন এনজিও থেকে জেলেরা ঋণ নিয়ে থাকেন। এদিকে তাদের মহাজনদের কাছ থেকেও অগ্রিম টাকা নেন। জেলেরা যেন ঋণ নিয়ে না চলতে হয় সেইদিক বিবেচনায় সরকার তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা করে থাকেন।