রাজশাহী উপকন্ঠ মাহিন্দ্রা এলাকায় কয়েক বিঘা সরকারি জমি দখল ও অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে নাবিল গ্রুপের বিরুদ্ধে। গত ১-১০-২৪ তারিখে রাজশাহী সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ-বিভাগ-২ এর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রেজওয়ানা কবির স্বাক্ষরীত দুটো নোটিশ নাবিল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান নাবিল ফার্ম লিমিটেড ও নাবা ডেইরী এ্যান্ড ক্যাটল ফার্মের অনুকূলে পাঠানো হয়েছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র। যার স্মারক নাম্বার যথাক্রমে ৩৫.০১.৮১৮৫.৮২৯.৩৪.০০১.২৪-৩২৪ ও ৩৫.০১.৮১৮৫.৮২৯.৩৪.০০১.২৪-৩২৪। সওজ’র অধিগ্রহণকৃত জায়গা থেকে অবৈধ স্থাপনা অপসারণের আদেশ দিয়ে চিঠিটি পাঠানো হয়েছে বলেও জানায় সূত্র। বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করেছে সওজ’র ভূমি শাখার সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।
অবৈধ স্থাপনা অপসারণের নিমিত্তে প্রেরিত আদেশে মোট সাতদিন সময় বেঁধে দেয় সওজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু, দুই সপ্তাহ অতিক্রম হলেও সেই আদেশের বিপরীতে নাবিল কর্তৃপক্ষ সরকারি জমি থেকে নিজেদের অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করার জন্য কোন প্রকার প্রস্তুতিই নেয়নি বলে জানান পবা উপজেলাধীন মাহিন্দ্রা গ্রামের স্থানীয়রা। সরেজমিনে গিয়ে সেটির সত্যতাও মেলে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজশাহী সড়ক বিভাগে কর্মরত একজন কর্মকর্তা জানান, অবৈধ স্থাপনা অপসারণ ও দখলমুক্ত করার জন্য নোটিশ প্রদানের কয়েকদিন পরেই ঢাকার বিভিন্ন দপ্তর থেকে উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদ ফোন করে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। তাঁরা পরোক্ষভাবে বিষয়টি ধাঁমাচাপা দেবার জন্যও বলেন। কোন দপ্তর ও রাজনীতিবিদ ফোন করেছিলেন জানতে চাইলে সেটি জানাতে অস্বীকৃতি জানান কর্মকর্তা। উল্লেখ্য যে, গত ৩০-৯-২০২৪ ইং তারিখে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ -এর ২৩ (১) (গ) ধারা অনুযায়ী রাজশাহীর নাবিল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের এমডি আমিনুল ইসলামের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে তার বাবা-মা, স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ের ব্যাংক হিসাবও জব্দ করা হয়েছে। গত ৩০-৯-২০২৪ ইং তারিখে কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০২০ সালে পবা উপজেলার মাহিন্দ্রা এলাকায় ক্রয়কৃত প্রায় ২১ বিঘা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় নাবা ডেইরী এন্ড ক্যাটল ফার্ম নামের এই প্রতিষ্ঠানটি। পবা উপজেলার হরিয়ান মৌজার ৭১৫ দাগের উপর প্রতিষ্ঠিত নাবা ডেইরী এন্ড ক্যাটল ফার্ম। যার জেএল নং ১৮৭। যাত্রাকালে ৩০০টি গবাদি পশু নিয়ে শুরু হয় ব্যবসা। দুই বছর পর ২০২২ সালে সেটির সংখ্যা গিয়ে দাড়ায় ৫৭০টিতে। আর ২০২৪ সালে সেই সংখ্যা পৌছে প্রায় হাজারের মতো। কুরবানী ঈদে ওজন করে গরু বিক্রির সুবাদে বেশ নামডাক আছে এই ফার্মের। ক্রমান্বয়ে ব্যবসার পরিধি প্রসারিত হবার কারণে একের পর এক নির্মিত হয় নতুন নতুন স্থাপনা ও ভবন। নিজেদের ক্রয়কৃত নির্ধারিত জমিতে নতুন স্থাপনা নির্মাণের পরিবর্তে; ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি জায়গাতে নির্মাণ করে নতুন একাধিক স্থাপনা। নিজেদের চলাচলের সুবিধার্থে বিশালার নালা ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে রাস্তা। নালা বন্ধ করে দেয়ার কারণে আশেপাশের আবাদী জমিগুলো জলাবদ্ধতার হুমকিতে পড়েছে। সবকিছু জেনেও মালিকপক্ষ অর্থশালী ও ক্ষমতাধর হবার কারণে কেউ অভিযোগ করার সাহস পায়নি বলে জানান হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের একাধিক মেম্বার ও কর্মরতরা।
রাজশাহী জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর এই নাবিল গ্রুপের মালিক পক্ষের সাথে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক (পলাতক) মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনসহ জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের ক্ষমতাধর নেতাদের সাথে বেশ দহরম মহরম সম্পর্ক থাকার কারণে ঐসময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি জমি দখলপূর্বক অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করেছিল নাবিল গ্রুপের এদুটো অঙ্গ প্রতিষ্ঠান।
সওজ’র উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রেজওয়ানা কবির স্বাক্ষরীত সেই চিঠিতে বলা হয়, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীনস্ত রাজশাহী শহর বাইপাস সড়কের ১০ম কিলোমিটারে সরকারি জায়গা আপনার প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে দখল করেছে। নিরাপদ সড়ক পরিবহন নিশ্চিতকরণে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের ২৫ দফা নির্দেশনায় ৩, ৪ ও ৫ নং দফা লঙ্ঘন হয়েছে। এছাড়াও বালি দিয়ে রাস্তার জায়গা (নালা) ভরাট করায় পানি প্রবাহ বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। এতে করে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। এমতাবস্থায় মহাসড়ক সংলগ্ন সরকারি জমিতে অবৈধভাবে নির্মিত স্থাপনা সম্পূর্ণ নিজ খরচে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদানের কথা উল্ল্যেখ্য করেছে সওজ কর্তৃপক্ষ। অন্যথায় সরকারি বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে উক্ত চিঠিতে।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সড়ক ও জনপথ বিভাগের একজন প্রকৌশলী ও ভুমি শাখার (ভুমি সেকশন- সার্ভে) কর্মকর্তারা জানান, ২৪ ফিট রাস্তা নির্মাণের জন্য ১৯৯৫ সালে ঐ এলাকায় সরকার ভুমি অধিগ্রহণ করে। পরবর্তীতে কাশিয়াডাঙ্গা থেকে আমচত্বর-খড়খড়ি-মাহিন্দ্রা হয়ে বেলপুকুরগামী ২৪ ফিটের রাস্তাটির কাজ সম্পন্ন হয় ২০০৯ সালে। রাস্তার উভয় পাশের্^ ৯০ ফিট করে মোট ১৮০ ফিট পর্যন্ত জায়গা সড়ক ও জনপথের (সওজ)।
সরকারি জায়গা দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে নাবা ডেইরী এন্ড ক্যাটল ফার্মের একজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা সদুত্তর না দিয়ে অপ্রাসঙ্গিক কথা বার্তায় লিপ্ত হন এবং এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, আপনি প্রশাসনের লোক নাকি! আমরা দখল করে থাকলে সেটি এসিল্যান্ড ও জেলা প্রশাসক দেখবে। তাদের কাছে গিয়ে খোজ নেন! মন্তব্যগুলো তিনি সেলফোনের মাধ্যমে বলেন। পরবর্তীতে প্রশ্নের টু দ্যা পয়েন্ট জানতে চাইলেও ওই কর্মকর্তা উত্তর না দিয়ে ফোনের সংযোগ কেটে দেন।
নাবা ডেইরী এন্ড ক্যাটল ফার্মের ইনচার্জ মোঃ শাকিলের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সওজ দপ্তর থেকে কোন নোটিশ এসেছে কিনা সেটা প্রধান কার্যালয়ের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে জেনে আপনাকে জানাবো। আমি এবিষয়ে কিছুই বলতে পারবোনা। কিন্তু সওজ কর্তৃপক্ষ বলছে গত ০১-১০-২৪ ইং তারিখে আপনার কর্মরত প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে তাঁরা নোটিশ প্রেরণ করেছেন। কোন উত্তর না দিয়েই তিনি ফোন কেঁটে দেন।
জানতে চাইলে নাবিল গ্রুপ ইন্ড্রাষ্ট্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আমিনুল ইসলাম স্বপন বলেন, যদি সরকারি জায়গাতে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়ে থাকে তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চিঠি দিলে আমরা সেটি অপসারণ করে ফেলেবো। নোটিশ সম্পর্কে তিনিও কোন উত্তর দেননি। তিনি এই প্রতিবেদককে আরো বলেন, আমরা সওজ কর্তৃপক্ষের কাছে উক্ত জমি লীজ নেবার জন্য আবেদন করেছি। কিন্তু সড়ক ও জনপথের ভূমি শাখার একজন কর্মকর্তা প্রতিবেদককে নিশ্চিত করে বলেন, নাবিল গ্রুপ থেকে লীজ সংক্রান্ত বিষয়ে কখনোই কোন আবেদন করা হয়নি।
জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও রাজশাহী সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আব্দুল হাকিম জানান, বিষয়টি সরেজমিনে তদন্ত করে আমরা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নোটিশ দিয়েছি।