× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

ভাষা সংগ্রামীদের কথা

গাজীউল হক এক অনন্য নাম

সাজেদা হক

২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯:৪৮ এএম

ভাষাসৈনিক পরিচয়ে বিখ্যাতদের মধ্যে অন্যতম একজন আবু নছর মোহাম্মদ গাজীউল হক। তিনি ছিলেন ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী, ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারীদের অন্যতম।  জন্ম ১৯২৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার নিচিন্তা গ্রামে। রাজনীতি সংগ্রাম ছিল তার রক্তে। বাবা মওলানা সিরাজুল হক ছিলেন সে সময়ের কংগ্রেস ও খেলাফত আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী, মা নূরজাহান বেগম।

গাজীউল হক ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক ও গীতিকার। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ভাষা দিবসের প্রভাতফেরি করা হতো তারই লেখা ‘ভুলব না ভুলব না ভুলব না এই একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’ গানটি গেয়ে।  পড়াশোনা ম্যাট্রিকুলেশন, আইএ বগুড়ায়।  বিএ অনার্স, এমএ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার এমএ ডিগ্রি কেড়ে নেয়।  পরবর্তীতে ছাত্রনেতাদের আন্দোলনে এমএ ডিগ্রি ফেরত দিতে বাধ্য হয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।  

তিনি বগুড়ায় অধ্যয়নকালে ভাষা বিজ্ঞানী মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সংস্পর্শে আসেন। এই সময় তিনি বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগ বগুড়া জেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেনের মত বিখ্যাত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহুবার কারাবরণ করেন।  ১৯৪৯ সালের দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় কাজ করেন। সেই সময় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যে ভুখা মিছিলটি বের হয়েছিল তাতেও অংশ নেন।

১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে আব্দুল মতিন এই কমিটির আহ্বায়ক হন। বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি ১৯৫০ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পল্টনের জনসভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দেন ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়।  ঘোষণা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার ছাত্রসভায়  গাজীউল হক সভাপতিত্ব করেন। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি একুশে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা ছিল উত্তাল।  সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম মাঠের পাশে ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেটের পাশে ছাত্র-ছাত্রীরা জমায়েত হয়। বেলা ১১ টায় কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক প্রমুখের উপিস্থতিতে সমাবেশ শুরু হয়।

এর আগে ২০ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার ভাষা আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে ঢাকার সমাবেশ, মিছিল-মিটিংয়ের ওপর ১৪৪ ধারা জারি করে। একুশে ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত উপস্থিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে আব্দুল মতিন এবং গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দিলেও সমাবেশ থেকে নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হন। এ অবস্থায় উপস্থিত সাধারণ ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অন্তর্গত) দিকে যাবার উদ্যোগ নেয়। এসময় পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়। পুলিশ লাঠিপেটা ও গুলিবর্ষণ শুরু করে। গুলিতে ঘটনা¯’লেই আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমদ ও আব্দুল জব্বার নামে তিন তরুণ মারা যান।  রফিক, জব্বার, বরকত, শফিকসহ নাম না জানা আরও অনেকের সঙ্গে সালামও সেদিন গুলিবিদ্ধ হন। ২৩ ফেব্রুয়ারি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে গাজীউল হক পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। বগুড়ায় এই খবর ছড়িয়ে পড়লে সেখানকার আলতাফুন্নেছা মাঠে তার গায়েবানা জানাজা পড়ানো হয়।  

কেবল ভাষা আন্দোলনই নয়, পরবর্তীতে সকল অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন, সাংস্কৃতিক ও জাতীয় সংগ্রামে গাজীউল হক অংশ নিয়েছেন। ১৯৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৪’র সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯’র গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথমে স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠক হিসেবে ও পরে জাতীয় পর্যায়ের লেখক এবং সংগঠকের ভূমিকায় তাকে পাওয়া গেছে। তাকে পাওয়া গেছে ১৯৮০-র দশক জুড়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ২৫ মার্চ রাতেই গাজীউল হক মাত্র ২৭জন যুবকসহ পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। গাজীউল হক অন্যান্য যুবকদের নিয়ে বগুড়া থানার পুলিশ এবং ৩৯জন ইপিআর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন। ২৭ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল ৬০ জন পুলিশের একটি দল পাকসেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। ১ এপ্রিল গাজীউল হকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আড়িয়া ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ চালিয়ে ৬৯ জন পাক সেনাকে বন্দি করে। মুক্তিযোদ্ধারা এই ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৫৮ ট্রাক গোলাবারুদ উদ্ধার করে। ১৬ এপ্রিল গাজীউল হক অস্ত্র সংগ্রহ এবং অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে উত্তরাঞ্চল যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে ভারত যান। হিলিতে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে একটি খণ্ড যুদ্ধে অংশগ্রহণের পর কলকাতায় ফিরে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের মুখপাত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার বিক্রয় বিভাগের দায়িত্বসহ আকাশবাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে রণাঙ্গনের সংবাদ প্রচারের দায়িত্ব পালন করেন।
গাজীউল হক লেখায়ও পারদর্শী ছিলেন। তার রচিত গ্রšে’র সংখ্যা ৯টি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রথম বই ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ লিখেন গাজীউল হক।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪তম সমাবর্তনে গাজীউল হকসহ আরেক ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লজ ডিগ্রি দেওয়া হয়। ২০০০ সালে  তিনি একুশে পদক পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০০১ সালে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে ‘জাহানারা ইমাম পদক’ পান তিনি। ২০০৪ সালে পান শের-ই-বাংলা জাতীয় পুরস্কার৷ গাজীউল হক প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) এর চেয়ারম্যান ছিলেন। মহান এই ভাষা সৈনিক ২০০৯ সালের ১৭ জুন বিকেলে রাজধানী ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.