ভাষা আন্দোলনের সময় রানী ভট্টাচার্য বরিশালের জগদীশ সরস্বতী বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হওয়ার কথা ছড়িয়ে পড়ে বরিশালে। পরের দিন বরিশাল হয়ে ওঠে প্রতিবাদের আর মিছিলের শহর। সারস্বত স্কুল থেকে শুরু হওয়া সবচেয়ে বড় মিছিলটির নেতৃত্ব দেন রানী ভট্টাচার্য। এই মিছিলকে অনেকেই পাকিস্তান আমলে বরিশালে নারীদের সবচেয়ে বড় মিছিল বলে মনে করেন।
রানী ভট্টাচার্য ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, ‘আসলে মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিলো বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা যে ভাষায় কথা বলতে পারছি সেই ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষা রাষ্ট্রভাষা হবে তা মেনে নিতে পারছিলাম না। তাই নিজর বিবেকের তাড়নায় সেদিন আমি আর এক শিক্ষিকা মঞ্জুশ্রী মিছিলে গিয়েছিলাম। সকলের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও।’
রানী ভট্টাচার্য বাংলা ভাষা আদায়ের দাবিতে বরিশালের প্রায় সব মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশে ছিলেন সো”চার। বাংলাভাষী সব মানুষের একাত্মতায় ছিনিয়ে এনেছেন বাংলা ভাষা। অর্জন করেছেন মায়ের ভাষা। আর এই সফলতার পথ ধরেই একদিন এসেছিল স্বাধীনতার লড়াই। সেই লড়াইয়েও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন রানী ভট্টাচার্য।
তিনি নতুন প্রজন্ম সম্পর্কে বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রীরাই নয়, অভিভাবকদেরও দোষ রয়েছে। তারা ছেলেমেয়েদের বই পড়তে দেয় না, বাংলাতো পড়ে না। কিন্তু ইংরেজি পড়ে কিনা জানি না। শুধু টিভি দেখে। ভালো জিনিস দেখে না। যে খারাপ দিকগুলো আছে সেগুলো দেখে। সেজন্য সমাজে খারাপ ঘটনাগুলো ঘটছে। যদি তারা সঠিক শিক্ষা পেত, তাহলে সমাজে এত সন্ত্রস, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ঘটত না। যথার্থ শিক্ষা দরকার এখনকার নতুন প্রজন্মের।’
রানী ভট্টাচার্য ভাষাসৈনিকদের কথা বলতে গিয়ে আবেগে ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের আসলেই ভাষাসৈনিকদের নাম জানা উচিত। আসলে আমরা যে ভাষাসৈনিক ছিলাম তা কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েরা জানে না এবং চেনে না। সেজন্য সমাজের কিছু সুধীজনের উচিত এগিয়ে আসা। পুরোনো যারা এখনো বেঁচে আছে এদের কাছ থেকে সকলের নাম জেনে একটি তালিকা তৈরি করা দরকার। যাতে আমাদের মৃত্যুর পরেও নামগুলো থাকে এবং সবাই জানতে পারে।’
রানী ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯২৭ সালে বরিশালের রাজপুরে। ব্রজমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং বিএ পাস করেন তিনি। কমিউনিস্ট নেতা স্বামী হিরণলাল ভট্টাচার্যের যোগ্য উত্তরসূরি রানী। পাকিস্তানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামেও তিনি ছিলেন ভয়হীন। নারী সংগ্রামের অধিকার রক্ষায় তিনি কাজ করেছেন সব সময়। মহিলা পরিষদ ছিল তার প্রাণ। নিঃসন্তান এই মানুষটি একাকী অসহায়ের মতো দীর্ঘ জীবপযাপন করে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ২০০৭ সালে।