× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

ঢাকায় অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক স্থাপত্য ও ভাস্কর্য

২৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০৬:১৬ এএম

যুদ্ধের প্রেক্ষাপট পালটে দিতে যেমন অনেক কৃতি সন্তানের বিচরণ ঘটেছে এর পিচঢালা পথে, তেমনি বিস্ফোরণের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানীর বুক। স্বাধীনতা যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর কাল সাক্ষী হয়ে আছে অতি প্রাচীন এই নগরী ঢাকা। যুদ্ধের প্রেক্ষাপট পালটে দিতে যেমন অনেক কৃতি সন্তানের বিচরণ ঘটেছে এর পিচঢালা পথে, তেমনি বিস্ফোরণের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানীর বুক। সেই সব চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলোকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে এখানে তৈরি করা হয়েছে অনেক স্মৃতিস্তম্ভ যেগুলো আজও মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা। বিমূর্ত ভাস্করগুলো যেন এখনও প্রচার করে যায় মুক্তিযুদ্ধের বাণী। চলুন, এই বিজয়ের মাসে ঢাকায় অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-স্মারকগুলোর ব্যাপারে কিছু জেনে নেয়া যাক।

ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ভিত্তিক স্থাপত্য ও ভাস্কর্য

স্বাধীনতা স্তম্ভ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান

“এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।” ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই জ্বালাময়ী ভাষণের জন্য বিখ্যাত এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এটি সেই ময়দান যেখানে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করেছিল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এই তাৎপর্য চিহ্নিত করতে সেখানে “স্বাধীনতা সৌধ” নামে একটি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। স্তম্ভটির নকশা করেছেন কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ও মেরিনা তাবাসসুম। ১৫০ ফুট লম্বা এবং ১৬ ফুট প্রশস্ত কাঠামোটি মূলত একটি কাচের টাওয়ার। পশ্চিম দিকে একটি ছোট্ট লেক এবং পূর্ব দিকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উপর বানানো একটি পোড়ামাটির ম্যুরাল রয়েছে। এই স্মৃতিস্তম্ভের নীচে স্বাধীনতা জাদুঘর।

শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, রায়ের বাজার বধ্যভূমি

ঢাকার পশ্চিমে মিরপুর বেড়ি বাধেঁর পাশে অবস্থিত এই “শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ”। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন যুদ্ধে আসন্ন পরাজয় টের পেল, তখন তারা ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গকে হত্যা করে এখানকার পরিত্যক্ত ইটের ভাটার পেছনের জলাশয়ে ফেলে রেখেছিলো। এর মধ্যে ছিলেন শিক্ষক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিল্পী, এবং আইনজীবী, যারা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের রূপকার হতেন।

স্মৃতিস্তম্ভটি মূলত একটি বাঁকা ইটের প্রাচীর, যার মাঝখানে একটি বর্গাকার জানালা রয়েছে। সামনে একটি গ্রানাইট স্তম্ভ রয়েছে, যা শোকের প্রতিনিধিত্ব করে। দূর থেকে পুরো স্তম্ভটাকে খোলা আকাশের নিচে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা নির্ভীক প্রহরীর মত মনে হয়। সিমেন্টের গাঁথুনি ও লাল ইটের এই স্থাপত্যের নকশাকার ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ও জামি-আল-শাফি।

শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, মিরপুর

মিরপুর মাজার রোড ধরে একটু ভেতরে ঢুকলেই দেখা যাবে নান্দনিক উদ্যান ঘেরা “শহীদ বুদ্ধিজীবীদের গোরস্থান ও স্মৃতিসৌধ”। ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় বাংলাদেশের প্রখ্যাত কৃতি সন্তানদের নির্বিচারে হত্যা করে। তাদেরই স্মরণে দেশ জয়ের ছয় দিন পরেই ২২ ডিসেম্বর মিরপুরে নির্মাণ করা হয় এ স্মৃতিসৌধ। এর নকশাকার স্থপতি মোস্তফা হারুন কুদ্দুস হিলি। এটি উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

জল্লাদখানা বধ্যভূমি জাদুঘর, মিরপুর

মিরপুর বেনারসি পল্লীর সড়ক থেকে একদম পূর্ব কোণে অবস্থিত “জল্লাদখানা বধ্যভূমি”। মুক্তিযুদ্ধকালীন এ এলাকাটি ছিলো প্রায় জনমানবহীন ও অন্ধকার। পাকিস্তানি হানাদারের দোসররা মুক্তিযোদ্ধাদের উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে একটি কূপে ফেলতো খণ্ডিত মাথা আর অন্যটিতে দেহের বাকি অংশ। ১৯৯৯ সালে এলাকাটিতে খননের কাজ শুরু হলে সেই কূপ থেকে পাওয়া যায় ৭০টি মাথার খুলি এবং ৫ হাজার ৩৯২টি হাড়।

স্থপতি রবিউল হুসাইন ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর-এর যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয় “জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ”। এর পূর্বপাশে লোহা ও টেরাকোটা ইটের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে ভাস্কর্য “জীবন অবিনশ্বর”, যার নকশাকার শিল্পী রফিকুন নবী ও মুনিরুজ্জামান। ২০০৭ এর ২১ জুন স্থাপনাটির উদ্বোধন করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, আগারগাঁও

এই সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত মুক্তিযুদ্ধ ও সামগ্রিক স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে জানিয়ে দেয় যে, কতটা কষ্টসাধ্য ছিলো স্বাধীনতা অর্জন। প্রথমে জাদুঘরটি সেগুনবাগিচার একটি ভাড়া বাড়িতে ছিল। ২০০৯ সালে জাদুঘরের নতুন ডিজাইনের জন্য একটি স্থাপত্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেখানে স্থপতি তানজিম হাসান সেলিম ও নাহিদ ফারজানা তাদের নকশার জন্য প্রথম পুরস্কার জিতেছিলেন। ২০১৩ সালে আগারগাঁওয়ে নতুন ভবনের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয় এবং নির্মাণকাজ শুরু হয়। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের এই নতুন প্রাঙ্গণটি আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৭ এর ১৬ এপ্রিল উদ্বোধন করা হয়। জাদুঘরের সামগ্রিক সংগ্রহ ২১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সামনে অবস্থিত বিখ্যাত ভাস্কর্যটিতে দুইজন পুরুষ এবং একজন নারী একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। এটি প্রতীকী অর্থে তুলে ধরে, কীভাবে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের নকশার উপর ভিত্তি করে ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে ভাস্কর্যের কাজ শুরু হয়।

ভাস্কর্য পরিদর্শনে এসে এ নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন দৈনিক বাংলার প্রতিবেদক সালেহ চৌধুরী। প্রবন্ধটি বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের কোটি মানুষের হৃদয়স্পর্শ করে। ফলশ্রুতিতে, ভাস্কর্যটি ব্যাপক ভাবে পরিচিতি পায়। ওই প্রবন্ধে সালেহ চৌধুরী এটির নামকরণ করেছিলেন “অপরাজেয় বাংলা”। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও স্বয়ং ভাস্করের মাধ্যমে এই নামটি স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাস্কর্যটির কাজ শেষ হয়েছিল ১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর।

অপরাজেয় বাংলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনে অবস্থিত এই ভাস্কর্যটির স্থপতি শামীম শিকদার। সমগ্র ভাস্কর্য জুড়ে রয়েছে একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের নির্যাতনের চিত্র। চারকোণা বেদির ওপর মূল ভাস্কর্যে স্থান পেয়েছে অস্ত্র ও বিজয় নিশান হাতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা, যাদের মধ্যে আছে পুরুষের পাশাপাশি নারী এমনকি কৃষকও। আর পুরো বেদিতে খোঁচিত দীর্ঘ নয় মাস ধরে বাঙালির রক্ত ঝরার কাহিনী। ১৯৮৮ সালের ২৫ মার্চ শেষ হয় স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্য নির্মাণ কাজ।

স্বাধীনতা সংগ্রাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মহিমান্বিত এ ভাস্কর্যের অবস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে সলিমুল্লাহ হল, জগন্নাথ হল ও বুয়েট সংলগ্ন সড়ক দ্বীপে। এই স্থাপনায় এক নজরে দেখে নেয়া যাবে বাংলা ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবির আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ এ ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, অপারেশন সার্চলাইট, ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং অবশেষে বাংলাদেশের বিজয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের ধারক এই ভাস্কর্যটির স্থপতি ভাস্কর শামীম শিকদার। ১৯৯৯ এর ৭ মার্চ ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আপাদমস্তক সাদা বর্ণের ৭০ ফুট উচ্চতা এবং ৮৫.৭৫ ফুট পরিসীমার ভাস্কর্যটি একটি গোলাকার ফোয়ারার মাঝখানে অবস্থিত।

বিজয় কেতন জাদুঘর, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট

ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত এই জাদুঘরটি বীরত্বসূচক খেতাবপ্রাপ্তদের স্মরণে নির্মিত। এর মূল প্রদর্শনীতে রয়েছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বন্দিশালা, যার নামকরণ হয়েছে “হল অফ ফেম”।আরেক অংশে আছে বাংলাদেশের বাংলাদেশের মানচিত্র, জাতীয় পতাকা, ধাতুপাতে খোচিত জাতীয় সঙ্গীত এবং সংবিধানের মূলকপি।

“হল অফ ফেম” থেকে কয়েক গজ উত্তরে জাদুঘরের মূল ফটকে আছে বাংলাদেশের পতাকাবাহী এক নারী সহ সাত মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য। এর নাম “বিজয় কেতন”।২০০০ সালের ২১ নভেম্বর জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

বীরের প্রত্যাবর্তন, ভাটারা

ঢাকার আমেরিকান দূতাবাসের ঠিক বিপরীতে ভাটারার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের একদম উত্তর-পূর্ব দিকে ফাজিলারটেক শাওড়াতলা। সেখানে ছোলমাইদ তিন রাস্তার সংযোগে দেখা মিলবে “বীরের প্রত্যাবর্তন” ভাস্কর্যটির। ৪১ ফুট বেদি নিয়ে মোট ৫৯ ফুট ৬ ইঞ্চি উঁচু এই ভাস্কর্যটি ঢাকা শহরের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উঁচু। বেদির উপর ২৮ ফুট লম্বা মুক্তিযোদ্ধা দেশ জয় করে অস্ত্র কাঁধে ফিরছেন বিজয়ীর বেশে।


শুধু ৫২’এর ভাষা আন্দোলন আর ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি এই বেদির পোড়ামাটির ফলকে উঠে এসেছে ১৯৪৮ সালের দেশ বিভাগ ও ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ। ভাস্কর্যটির নিচে আছে মুক্তিযুদ্ধের বই দিয়ে সাজানো একটি পাঠাগার। দেয়াল জুড়ে শোভা পাচ্ছে যুদ্ধকালীন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা। পোড়ামাটির কাজ করেছেন ধামরাইয়ের গোবিন্দ পাল, মুক্তিযোদ্ধার ডামিটি করেছেন নারায়ণ পাল। অতঃপর সুদীপ্ত মল্লিক সুইডেন পুরো ভাস্কর্যটির সমাপ্তি টানেন। প্রায় আড়াই বছর নির্মাণ কাজের পর অবশেষে ২০০৮ এর ২৯ মার্চ জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরী এটি উদ্বোধন করেন। ঢাকায় অবস্থিত এই মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক স্থাপত্য ও ভাস্কর্যগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকদের হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করে। সেই সাথে দাবি রেখে যায়, অনেক রক্তে পাওয়া এই অমূল্য সম্পদ প্রাণ দিয়ে হলেও রক্ষা করার।

Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.