× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

মনোমুগ্ধকর প্রকৃতিকন্যা জাফলং

শাহনাজ পারভীন এলিস, সিলেট থেকে ঘুরে এসে

১৩ আগস্ট ২০২২, ০৭:১৯ এএম

পাহাড়ের পাদদেশ ছুঁয়ে বয়ে চলা নদী। পাহাড় থেকে অবিরাম ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে হিমালয়ের বরফের মতো নদীতে বয়ে চলেছে ঠান্ডা নীল জলরাশি। সীমান্তের ওপারে ভারতীয় পাহাড় টিলা, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ, উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে সবুজ গহিন অরণ্য আর শুনশান নীরবতা। সিলেটে জাফলং সীমান্তের এমন অপরূপ দৃশ্য পর্যটকদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। নদীর তীরে বিছানো বাহারি রঙের পাথরের স্তূপ জাফলংকে করেছে আরও দৃষ্টিনন্দন। এছাড়া পাহাড়ের মাথায় মেঘের ভেলা আর তাদের লুকোচুরির দৃশ্যও ভীষণ মনোমুগ্ধকর।


বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত সিলেটের গোয়াইনঘাটের জাফলং এমনই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি। পিয়াইন নদীর অববাহিকায় জাফলং অবস্থিত। জাফলং সীমান্তের অপর পাশে ভারতের ডাউকি অঞ্চল। ডাউকি নদী এই জাফলং দিয়েই বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বর্ষাকালে ভারতীয় সীমান্তবর্তী শিলং মালভূমির পাহাড়গুলোতে প্রবল বৃষ্টিপাত হলে ওইসব পাহাড় থেকে ডাউকি নদীর প্রবল স্রোত বয়ে আনে বড় বড় গণ্ডশিলাও। এ কারণে সিলেটে এলাকার জাফলং-এর নদীতে প্রচুর পরিমাণে পাথর পাওয়া যায়। তাই এ অঞ্চলের মানুষের বৃহৎ অংশের জীবিকা নির্ভর করে এই পাথর উত্তোলন এবং তা প্রক্রিয়াজাতকরণে।

সম্প্রতি জাফলংয়ে ঘুরতে গিয়ে দেখা যায়, এখন শরৎ মৌসুম নদীর পানি কমে যাওয়ায় পর্র্যটকের আনাগোনা কিছুটা কমলেও, জাফলং সৈকতে সৌন্দর্যে তেমন ভাটা পড়েনি। বরং গত মে-জুন মাসে পানি বেশি থাকায় পর্যটকরা পাথর দেখতে পেতেন না, শুধু নৌকা নিয়ে ঘুরে দেখতে পেরেছেন। এখন পানি কম থাকায় পাথরে হাঁটা, ছবি তোলা এবং নৌকা দিয়ে নদী পাড় হয়ে পায়ে হেঁটে ঝর্ণার কাছে যেতে পারছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, শীত মৌসুমে বিশেষ করে ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে মাসে জাফলং এ পর্যটকের বেশি আগমন হয়। 

জাফলংয়ে ঘুরতে গিয়ে ঢাকার বাসিন্দা জাহেদা পারভেজ ছন্দা জানান, ‘প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর জাফলং আমায় সবসময়ই টানে। এবার এলাম দ্বিতীয়বারের মতো বন্ধুদের সাথে। এর আগে ২০১৭ সালে পরিবারের সাথে এসেছিলাম। তখন বাঁধাই করা সিঁড়ি ছিলো না, পানি বেশি থাকায় পাথরগুলো ছুঁয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। এবার পানি কম থাকায় পাথর আর বালিয়ারি দিয়ে পায়ে হেঁটে নৌকায় চড়া, ঝর্ণার কাছে গিয়ে ছবি তুলতে পেরে ভীষণ ভালো লাগলো। পাহাড়-নদী আর পাথর-বালিয়ারিতে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে অনেক ছবি তুলতে পেরেছি।’ তবে জাফলং এলাকার ব্যবস্থাপনাকে ঢিলেঢালা মনে করছেন তিনি। পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দেবার কাউকে দেখা যায়নি। ফলে ঘুরতে গিয়ে অনেকেই ডাস্টবিনে ময়লা না ফেলে যত্রতত্র ফেলছে ময়লা আবর্জনা।

স্থানীয় পর্যটক মাইনুল ইসলাম পারভেজ জানান, নৌকার ভাড়া সরকারিভাবে ৬৫০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও তা মানা হচ্ছে না। পর্যটকের আগমন যখন বেশি থাকে তখন নৌকাপ্রতি আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার ভাড়া উঠনো হয়। আর প্রশাসনের নজরদারির অভাবে বাঁধাই করা সিঁড়িতে ৫০-৬০টি ডাস্টবিন থাকারও পরও অনেকেই যত্রতত্র ময়লা ফেলছেন, ফলে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। এছাড়া জাফলং এলাকায় নেটওয়ার্ক সমস্যার সমাধানে পর্যটকদের জন্য ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবস্থা চালু ছিলো। কিন্তু আড়াইামাস আগে থাকার ১০ টাকার টিকিট ব্যবস্থা বন্ধ হওয়ার পর সেটিও বন্ধ রয়েছে। ফলে ঘুরতে গিয়ে পর্যটকদের অনেকসময় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকতে হচ্ছে।

জাফলং এলাকায় পার্টটাইম ছবি তুলে জীবিকা নির্বাহ করেন ১৮ বছরের যুবক বিল্লাল আহমেদ আলআমিন। এই মৌসুমে ছবি তুলে তার আয় কেমন হচ্ছে জানতে চাই। সে জানায়, সে নিজের ক্যামেরায় ছবি তোলে। এই মৌসুমে ৫/৬শ’ টাকার বেশি উপার্জন করা সম্ভব হয় না। কারণ পানি কমে যাওয়ায় কমেছে পর্যটক। কিন্তু ভরা মৌসুমে দেড় থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব হয়। কিন্তু যারা ভাড়া নিয়ে ক্যামেরা চালায় তাদের মহাজনকে অর্ধেক টাকা দিয়ে দিতে হয়। 

সিলেটের সীমান্তবর্তী পর্যটনকেন্দ্র জাফলংয়ে অনেক বছর ধরে ঘুরতে যান দেশের নানা প্রান্তের মানুষ। তারা বিনা মূল্যেই উপভোগ করেছেন সেখানকার প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য, তবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন জিরো পয়েন্ট এলাকায় যাওয়ার জন্য প্রবেশ ফি চালু করে। এজন্য বসানো হয় একাধিক টিকিট কাউন্টার। অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পান কিছু কর্মী। তারা প্রত্যেক দর্শনার্থীর কাছ থেকে ১০ টাকা করে ফি নেন। 

গত মে মাসে কাউন্টারে টিকিট কেনা নিয়ে পর্যটকদের সঙ্গে কাউন্টারে থাকা উপজেলা প্রশাসনের কর্মীদের বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে ওই কর্মীরা লাঠি দিয়ে পর্যটকদের মারধর করেন। ওই সময় কয়েকজন নারীকেও লাঞ্ছিত করা হয়। সেসময়ের ওইসব ঘটনার কিছু ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনার মুখে বন্ধ রাখা হয়েছে দর্শনার্থীদের টিকিট সিস্টেম।

জাফলংয়ে প্রবেশে কেন টিকিট ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিলো এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রশাসনের এক কর্মচারী জানান, ‘আগে পর্যটকরা জাফলং জিরো পয়েন্টে যেতেন বল্লাঘাট এলাকা দিয়ে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন গুচ্ছগ্রাম এলাকা দিয়ে পর্যটক প্রবেশের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পর্যটকদের ওঠানামার সুবিধার জন্য বানানো হয়েছে সিঁড়ি। আর গুচ্ছগ্রামে বিজিবি ক্যাম্পের পাশেই বসানো হয় টিকিট কাউন্টার। কাউন্টারের পাশে টানানো সাইনবোর্ডে লেখা হয়- ‘জাফলং পর্যটন এলাকার উন্নয়ন ও পর্যটন সেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জেলা পর্যটন কমিটি ও উপজেলা পর্যটন কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পর্যটক প্রবেশে পর্যটকপ্রতি ১০ টাকা হারে ফি নির্ধারণ করা হলো।’ এটা ওপর মহলের সিদ্ধান্ত করা হয়েছিলো, তবে পর্যটকদের সঙ্গে সমস্যা হওয়ার পর থেকে প্রায় আড়াই মাস ধরে টিকিট সিস্টেম বন্ধ রয়েছে। 

প্রবেশ ফি প্রসঙ্গে গোয়াইনঘাটের ইউএনও তাহমিলুর রহমান সংবাদ সারাবেলাকে বলেছেন, ‘গত বছর জেলা পর্যটন কমিটির সভায় ফি চালুর সিদ্ধান্ত হয়। উপজেলা প্রশাসন এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে। এটি কাউকে ইজারা দেয়া ছিলো না। চুক্তিভিত্তিক কিছু কর্মী নিয়োগ করে উপজেলা প্রশাসন ফি আদায় করতো। এটাকে আমি অন্যায় মনে করি না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এই সিস্টেম আছে। তারপরও এ নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় আপাতত সেই কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে আলোচনা সাপেক্ষে  এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। 

ঐতিহাসিকদের মতে বহু হাজার বছর ধরে জাফলং ছিল খাসিয়া জৈন্তা-রাজার অধীনে থাকা এক নির্জন বনভূমি। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে জমিদারী প্রথার বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে খাসিয়া জৈন্তা রাজ্যের অবসান ঘটলেও বেশ কয়েক বছর জাফলংয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা পতিতও পড়েছিল। পরবর্তীতে ব্যবসায়ীরা পাথরের সন্ধানে বিভিন্ন এলাকা থেকে নৌপথে জাফলং আসতে শুরু করেন, আর পাথর ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকলে একসময় গড়ে ওঠে নতুন জনবসতি। জাফলং-এ পাথর ছাড়াও পাওয়া গেছে সাদামাটি বা চীনামাটি ও বালি ।

এই এলাকায় যেমন সাধারণ বাঙালিরা বসবাস করেন, তেমনি বাস করেন উপজাতিরাও। জাফলং-এর বল্লা, সংগ্রামপুঞ্জি, নকশিয়াপুঞ্জি, লামাপুঞ্জি ও প্রতাপপুর জুড়ে রয়েছে ৫টি খাসিয়াপুঞ্জী। আদমশুমারি অনুযায়ী জাফলং-এ ১ হাজার ৯৫৩ জন খাসিয়া উপজাতি বাস করেন। জাফলং অঞ্চলের উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে রয়েছে খাটো জাতের মধ্যে পাম গাছ। নারিকেল আর সুপারির গাছকে কেন্দ্র করে বাস করে প্রচুর বাদুড়। এছাড়া জাফলং বাজার কিংবা জাফলং জমিদার বাড়িতে আবাস করেছে বাদুড়। যদিও খাদ্য সংকট, আর মানুষের উৎপাতে, কিংবা অবাধ বৃক্ষ নিধনে অনেক বাদুড় জাফলং ছেড়ে চলে যাচ্ছে জৈয়ন্তিয়া আর গোয়াইনঘাটের বেঁচে থাকা বনাঞ্চলে, কিংবা প্রতিবেশী দেশ ভারতে।



Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.