× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

পাকবাহিনীর উপর যৌথ বাহিনীর আক্রমণ শুরু

০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০৮:৪১ এএম

রঞ্জন মল্লিক: ৩রা ডিসেম্বর শুক্রবার। মিসেস ইন্দিরাগান্ধী সেদিন কলকাতায় এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। জেনারেল অরোরা ইষ্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টারে আরও একটি কর্মব্যস্ত দিন অতিবাহিত করেন। ভারতীয় সময় বিকেল ৫টা ৪৭ মিনিট পাকিস্তান বিমান বাহিনী অতর্কিতে ভারতের সাতটি বিমান ঘাঁটিতে একযোগে হামলা চালায়। রাত সাড়ে আটটায় জম্মু এবং কাশ্মীরের দক্ষিণ পশ্চিমে ছাম্ব এবং পুঞ্চ সেক্টরে ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে। এ ধরনের পরি¯ি’তির জন্য ভারত পুরো প্র¯‘ত ছিল। মিসেস গান্ধী দ্রুত রাজধানী দিল্লীতে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং ওই রাতেই ১২টা ৩০ মিনিটে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত বেতার ভাষণে সকলকে চরম ত্যাগ স্বীকারের জন্য তৈরি হওয়ার আহ্বান জানালেন। ততোক্ষণে জেনারেল অরোরাও আক্রমণের নির্দেশ পেয়ে যান।

ভারতীয় বিমান বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় সবগুলো বিমান ঘাঁটি এবং রাডার কেন্দ্রের উপর আঘাত হেনে চলছিলো। একই সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখা অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করলো। ইষ্টার্ন ফ্রন্টও দ্রুত লক্ষ্যস্থল অভিমুখে অগ্রসর হলো, রাত ৩টায় ভারতীয় বিমানগুলো ঢাকা এবং কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটির উপর প্রথম হামলা শুরু করে। ইতিহাসের আর একটি মহান স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামের সূচনা হলো। ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রধান লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি জঙ্গি বিমানগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া, যাতে লড়াইয়ের শুরুতেই আকাশটা মিত্রপক্ষের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই ৩রা ডিসেম্বর মধ্যরাতে ভারতীয় বিমান বাহিনী তেজগাঁও বিমান বন্দর আক্রমণ করে। ওই বিমান বন্দরেই পাকিস্তানি স্যাবর জেটগুলো মজুত ছিল। কারণ গোটা বাংলাদেশে তখন মাত্র একটি বিমান বন্দর যেখান থেকে জেট বিমান উড়তে পারে। ভারতীয় মিগ সেই ঘাঁটিতে হানা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি স্যাবর জেটগুলিও বাধা  দিতে এগিয়ে এলো। প্রায় সারা রাত ধরে চলল ঢাকার বিমান যুদ্ধ। প্রথম রাত্রির আক্রমণেই পাকিস্তানি অর্ধেক বিমান ধ্বংস হয়ে গেল। বিমান বন্দর ও কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টও  নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো।

ভারতীয় বিমান ও নৌ-বাহিনীর বিমানগুলো সেদিন যে শুধু ঢাকা আক্রমণ করেছিল তাই নয়। আক্রমণ করেছিল কুমিল্লা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম,কক্সবাজার প্রভৃতি এলাকায়ও। চট্টগ্রাম, চালনা, কক্সবাজার এবং চাঁদপুরের অভিযান চালিয়েছিল প্রধানত নৌ-বাহিনীর বিমানগুলো। চট্টগ্রাম বন্দরের প্রায় অর্ধেকটা ধ্বংস হয়ে যায়। বন্দরের তেলের ডিপোগুলোও দাউ দাউ করে জ¦লে উঠলো। 

এর মধ্যে পাকিস্তানি জঙ্গি বিমানগুলো কলকাতা শহরে হানা দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিš‘ প্রতিবারেই তীব্র প্রতিরোধের মুখে পাক বাহিনীর বিমানগুলো  ফিরে যেতে বাধ্য হলো।

৩রা ডিসেম্বর মধ্যরাত্রিতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম নারায়ণগঞ্জের গোদানাইলে পাকিস্তানি বিমান জ্বালানি ঘাঁটির উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম ও ক্যাপ্টেন আকরাম আহমদ একই সময়ে চট্টগ্রামে এক ব্যাপক আক্রমণ পরিচালনা করেন। উল্লেখ্য যে, ভারত থেকে প্রাপ্ত তিনটি পুরানো বিমান মেরামত করে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠন করেছিল। এই বিমানগুলো নিখুঁতভাবে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি ঘাঁটির উপর আক্রমণ অব্যাহত রাখে।

নৌ, বিমান ও স্থল পথে মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী একযোগে আক্রমণ করে পাক-বাহিনীকে ব্যাতিব্যস্ত করে তুলে। মিত্রবাহিনীর নবম ডিভিশন এগুতে থাকে গৌরিপুর, জগন্নাথপুর দিয়ে যশোহর-ঢাকা হাইওয়ের পথে। চতুর্থ ডিভিশন অগ্রসর হলো মেহেরপর পাশ কাটিয়ে কালীগঞ্জ-ঝিনাইদহর দিকে। বিংশতম ডিভিশন দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে  একটি অংশ হিলির দিকে পাক ঘাঁটির মোকাবিলা করার জন্য। আর একটা অংশ হিলিকে উত্তরে রেখে এগিয়ে চলল পূবের দিকে। ষষ্ঠ ডিভিশন তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হল, একটা তেতুলিয়া থেকে ঠাকুরগাঁও’র দিকে, আর একটা পাটগ্রাম থেকে কালিগঞ্জের দিকে এবং তৃতীয় গ্রুপ কোচবিহার থেকে নাগেশ^রী-কুড়িগ্রামের দিকে। উত্তরে মেঘালয়ের দিকে যে দুটি গ্রুপ তৈরি ছিল তারাও ওই রাত্রিতে এগিয়ে চলল। একটা অংশ ঢালু থেকে নেমে এগিয়ে গেল জামালপুরের দিকে। আর একটা একটু এগিয়ে দাঁড়িয়ে গেল হালুয়াঘাটের মুখোমুখি।

পূর্ব দিক থেকেও একই সঙ্গে ৮, ৫৭ এবং ২৩ নং ডিভিশন নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে ঢুকল। একটা বাহিনী এল সুনামগঞ্জ থেকে সিলেটের দিকে। ছোট ছোট তিনটা বাহিনী এগিয়ে চলল হবিগঞ্জ এবং মৌলভীবাজারের দিকে। আখাউড়াকে সোজাসোজি আঘাত করে একটা গোটা ব্রিগেডই এগিয়ে চলল ব্রাম্মণবাড়িয়ার দিকে।

ওদিকে কুমিল্লা-ময়নামতি কন্টনমেন্টে পাকিস্তানিদের বেশ শক্ত ঘাঁটি ছিল। কুমিল্লা সেক্টরের দায়িত্ব ছিল যৌথবাহিনীর ২৩ নং ডিভিশনের ওপর। কয়েক কম্পানী সৈন্যকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের কাছে রেখে ২৩নং ডিভিশন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল দাউদকান্দির দিকে। ২৩নং ডিভিশনের আর একটি ব্রিগেড চৌদ্দগ্রাম থেকে অগ্রসর হল লাকসামের দিকে। লক্ষ্য চাঁদপুর। লাকসামে ছিল পাকবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। লাকসামকে আটকিয়ে রাখার জন্য মিত্র বাহিনী এখানে একটি ছোট বাহিনীকে রেখে যায়। মূল কলামটা এগিয়ে চলল চাঁদপুরের দিকে। পূবে আর একটা বড় বাহিনী এগোল  বিলোনিয়া দিয়ে ফেনীর দিকে। লক্ষ্য চট্টগ্রামের যায়ায়াতের পথ বন্ধ করে দেওয়া। এভাবে চারিদিক থেকে মুক্তিবাহিনীকে সাথে নিয়ে ভারতীয় মিত্রবাহিনী বাংলাদেশে একযোগে আক্রমণ শুরু করে। এসময়  প্রতিটি পদক্ষেপে মুক্তিবাহিনী অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। মূলত: মুক্তিবাহিনী আক্রমণের অগ্রভাগে থেকে মিত্র বাহিনীকে সার্পোট দিত। ফলে খানসেনাদের  প্রতিটি শক্তিশালী ঘাঁটি আক্রমণ ও সম্মুখ লড়াইয়ে যৌথবাহিনী বিজয়ী হতে শুরু করে।

যৌথ বাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে পাকসেনারা যুদ্ধের ফ্রন্ট থেকে পিছু হঠতে বাধ্য হন। ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রবল আক্রমণে চাঁদপুরে খানসেনারা কোথাও মুভ করতে পারছিল না। এ সময় চাঁদপুরের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা কচুয়া, মতলব, হাজিগঞ্জ ও ফরিদগঞ্জ থেকে চাঁদপুর সদর থানা দখলের জন্য এগিয়ে আসতে থাকেন। উল্লেখ্য যে, পাক আর্মি কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও পার্বত্যচট্টগ্রাম নিয়ে চাঁদপুর সেক্টর গঠন করেছিল। এর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো ইয়াহিয়া সরকারের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ কমান্ডার ও উপ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ রহিম খান। ঢাকার প্রতিরক্ষার প্রতি লক্ষ্য রেখে ৩৯ ডিভিশনের হেড কোয়ার্টার স্থাপিত হয়েছিল চাঁদপুরের উপকণ্ঠে। এর অধীন ছিল ৪৩ ব্রিগেড।

৩রা ডিসেম্বর রাতে যৌথ বাহিনীর ৩০১ মাউটেন্ট ব্রিগেড এবং মুক্তিবাহিনীর ইষ্টার্ন সেক্টরের দক্ষিণে লালমাই পাহাড় এবং লাকসাম, পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা বুহ্য ভেঙে ফেলে। অগ্রসরমান যৌথ বাহিনী মুদাফফরগঞ্জের নিকট শত্রুুর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এই সংঘর্ষে পাকিস্তানি ২৫ তম এন্টিয়ার ফোর্সের কমান্ডি অফিসার এবং তার অধিকাংশ সৈন্য আত্মসমর্পণ করে।

৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতের প্রতিটি শহরে রেড এলার্ট ছিল। পাকিস্তান ৩রা ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিম সীমান্ত আক্রমণ করে বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ বলে চালিয়ে দিতে চাইছিল। অন্যদিকে ভারত বরাবরই বলে এসেছে এ যুদ্ধ সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তির লড়াই। বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে তাদের সরাসরি কোন সম্পৃক্ততা নেই। এবং এর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির বাঁচা মরার লড়াইয়ে ভারত শুধু সমর্থন দি”েছ। ভারত মানবতার প্রশ্নে নীরিহ প্রায় এককোটি প্রতিবেশী  বাঙালিকে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দিয়েছে মাত্র। উল্লেখ্য যে, অক্টোবর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিমা দেশগুলো সফর করে এ কথাগুলোই তাদের বুঝাতে চেষ্টা করেন এবং সেসব দেশের সহানুভূতি নিতে সমর্থন হন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের এই কূটনৈতিক সফর ভারতকে যৌথ বাহিনী গঠনে সমর্থন যোগায়। ৩রা ডিসেম্বর  মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী একসঙ্গে যৌথবাহিনীর নেতৃত্বে  পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মধ্যরাত থেকে সাড়াশি আক্রমণ পরিচালনা করতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে বিদেশি রাষ্ট্র সমূহের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধিপায় এবং স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের পক্ষে বিশ^জনমত গড়ে ওঠে।। জানোয়ার ও বেয়াকুব আর্মি শাসিত পাকিস্তানের সৈন্যরা সর্বত্র  যৌথবাহিনীর হাতে মার খেতে শুরু করে। ৩রা ডিসেম্বরের পর থেকে অবরুদ্ধ বাংলার বিভিন্ন স্থান হানাদার মুক্ত হতে শুরু হয়। জয় বাংলার স্লোগানে মুখরিত হতে থাকে অবরুদ্ধ বাংলা।

 লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক




Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.