× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় দক্ষ প্রশাসন : চাঁদপুর

০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০৮:৩৫ এএম

রঞ্জন মল্লিক:  পাকিস্তানি-সেনাবাহিনীর শৌর্য-বীর্য ও সামরিক শক্তি নিয়ে বিশ্বে দম্ভ ছিল পাকিস্তানের। শক্তিশালী এই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ বাঙালিদের পক্ষে সম্ভব-পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তা কখনোই ভাবতে পারেনি। হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণ করে বাঙালিদের মনোভাব চিরদিনের জন্য দমিয়ে দিবে-এটাই ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মূল উদ্দেশ্য। 

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান-পূর্বাঞ্চলীয় সেনা প্রধান নিয়াজী এবং সামরিক প্রশাসক টিক্কাখান ২৫ মার্চ ১৯৭১ এর রাত থেকে শুরু করে কয়েকদিনের ঝটিকা আক্রমণে সফলতা পেয়ে খুবই উল্লসিত ছিলেন। ২৫ মার্চের ধ্বংসযজ্ঞ নিজ চোখে দেখে গিয়ে করাচিতে সংবাদ সম্মেলনে জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেছিলেন : ঈশ^রকে ধন্যবাদ, পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে।

পাকিস্তানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে খুব অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সংগঠিত হয়ে বাংলার দামাল ছেলেরা দাঁতভাঙা জবাব দিতে শুরু করে। চাঁদপুর অঞ্চল তার ব্যতিক্রম ছিল না। চাঁদপুর মহকুমার দামাল ছেলেরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট সহজভাবে মেনে নেয়নি। তারা অতি অল্প সময়ের মধ্যে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।

মূলত: ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর চাঁদপুর মহকুমার পাঁচটি থানাতেই সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়।

চাঁদপুর মহকুমা সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে চাঁদপুর শহরের আনসার ক্লাব, বালুর মাঠ, আক্কাস আলী বিদ্যালয়ের মাঠে অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণের নেতৃত্বে ছিলেন মতলবের ফ্লাইট লেফটেন্্যান্ট এ.বি.সিদ্দিকী। সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী।

১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়। সেখানে চাঁদপুরের মিজানুর রহমান চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন এবং তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করছেন এ ধরনের সংবাদ চাঁদপুরে আসতে থাকে। এবং চাঁদপুরে গেরিলা তৎপরতা চালাতে নেতাদের সাথে যোগাযোগ করেন।

এ সময় এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম পাটোয়ারী এম.এন.এ, আবদুল করিম পাটোয়ারী এম.এন.এ কে নিয়ে ফরিদগঞ্জে নিরাপদ স্থানে চলে আসেন। পরিস্থিতি এমন সংকটময় ছিল যে,  চাঁদপুর সদর আক্রমণ করা মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে তখন সম্ভব ছিল না। ফরিদগঞ্জে নেতারা মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে, ফরিদগঞ্জ থানার গাজীপুর থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ক্যাম্প করা হবে। এ সময় হাজিগঞ্জের বি.এম কলিমুল্লাহ, করিম পাটোয়ারী, আবদুর রব, এডভোকেট আবু জাফর মঈনউদ্দিন , জীবন কানাই চক্রবর্তী, তফাজ্জল হোসেন (নসু) চৌধুরী এদের  প্রচেষ্টায় অবসরপ্রাপ্ত ও ছুটিতে আসা সামিরক বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে একটি শক্তিশালী মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয়।

সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ছিলেন-জহিরুল হক পাঠান, সুবেদার আবদুর রব, আতিকুল হক বাচ্চু উল্লেখযোগ্য। দুই সপ্তাহের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ গ্রুপে ২০০ থেকে ২৫০ জন  ছাত্র-যুবক  যোগ দেয়। উল্লেখ্য যে, এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সামরিক বাহিনীর প্রাক্তন সদস্য, অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে পালিয়ে আসা বেঙল রেজিমেন্টের ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্য।  

পাকিস্তানি পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ ও পরিকল্পিত যুদ্ধ পরিচালনার জন্য এ সময় দক্ষ প্রশাসনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। দক্ষ প্রশাসন কাঠামো গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে চাঁদপুর মহকুমা সংগ্রাম কমিটিকে একটি আঞ্চলিক সরকারের রূপ দেওয়া হয়। তাৎক্ষণিকভাবে যা ছিল খুবই কার্যকর।

প্রশাসনিক কাঠামোটি ছিল নিম্নরূপ:

চাঁদপুর মহকুমার পাঁচটি থানা ও পার্শ্ববর্তী বেগমগঞ্জ, রায়পুর ও লাকসামসহ মোট নয়টি থানা নিয়ে একটি জোন গঠন করে কমিটির আওতায় আনা হয়। এ জোনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয় এবং যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি দক্ষ সরকার ও প্রশাসন গঠন করা হয়।  মহকুমা সংগ্রাম কমিটিকেই  মূলত:  জোন সরকার নাম দিয়ে শক্তিশালী করা হয়।

প্রশাসনিক কাঠামো ছিল নিম্নরূপ

রাষ্ট্রপতি : আবদুর রব 

প্রধানমন্ত্রী : এডভোকেট সিরাজুল ইসাম এম.পি.এ

অর্থমন্ত্রী : এডভোকেট আবু জাফর মঈনুদ্দিন

আইনও বিচার মন্ত্রী : আবদুল করিম পাটোয়ারী এম.পি.এ

স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী : বি.এম কলিমুল্লাহ

বাণিজ্য মন্ত্রী : মিজানুর রহমান চৌধুরী

ক্যাবিনেট সচিব : জীবন কানাই চক্রবর্তী

এ রাষ্ট্রের আয়তন ছিল প্রায় বারোশত বর্গমাইল। ডাকাতিয়া নদীর দক্ষিণ পাড় ছিল উক্ত জোনের হেডকোয়ার্টার। মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস ডাকাতিয়া নদীর দক্ষিণ পাড় উক্ত জোনের হেডকোয়ার্টার স্বাধীন এলাকা হিসেবে গণ্য হতো। এ জন্য পাকিস্তানি সমর্থকরা উক্ত এলাকার নাম দিয়েছিল  ইন্ডিয়া। 

ডাকাতিয়া নদীর দক্ষিণ পাড় অর্থাৎ শাহরাস্তি থানার সূচিপাড়া থেকে শুরু করে ফরিদগঞ্জ থানার নিম্নাঞ্চল পুরোটাই গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে ছিল। প্রথমে এ স্থানীয় সরকার মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ইন চিফ নিয়োগ করে সুবেদার আলী আকবরকে। সেকেন্ড ইন চিফ নিযুক্ত হয় জহিরুল হক পাঠান।  সরকার গঠনের পর ফরিদগঞ্জ নওগাঁ বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের জড়ো হতে এ সরকার সহায়তা করে। সেখান থেকে যাঁরা ভারতে অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য যেতে আগ্রহী ছিলেন, তাদের ভারত প্রেরণ করতেন। সরকারের আইন মন্ত্রী করিম পাটোয়ারী ট্রেনিং এ আগ্রহী মুক্তিযোদ্ধাদের ভারত  যাবার  ছাড়পত্র  দিতেন।

জোন সরকারের সেকেন্ড ইন কমান্ড জহিরুল হক পাঠান, সুবেদার আব্দুর রব, আতিকুল হক বাচ্চু, সিপাহী আলী আকবর প্রমুখ সামরিক বাহিনীর সৈনিকরা মে মাস থেকে যুদ্ধ ও ট্রেনিং একই সাথে চালনা শুরু করেন। মুক্তিযোদ্ধারা যেখানে ক্যাম্প স্থাপন করতেন সেখানেই গ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যুবকদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতেন। অতি অল্প সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা  শাহরাস্তি, পানিওয়ালা ও সাচার প্রভৃতি স্থানে যুদ্ধের ট্রেনিং চালু করেন। 

এ সময় পরিকল্পনা করা হয় রামগঞ্জ থানার সোনাপুর বাজারস্থ ন্যাশনাল ব্যাংক লুট করা হবে। বি.এম. কলিমুল্লাহর নেতৃত্বে কিছু ধুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা এই অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। পরিকল্পনা মতো বি.এম. কলিমুল্লাহ ও তাঁর সহযোদ্ধারা  ক্ষিপ্ততার সাথে ম্যানেজারের কক্ষে প্রবেশ করে তার মাথায় পিস্তল ধরেন। ম্যানেজার সাথে সাথে স্টোর রুম থেকে টাকা দিতে নির্দেশ দেন। একজন ব্যাংক কর্মচারী একটি থলিতে করে ৬৮ হাজার টাকা বি.এম কলিমুল্লার হাতে তুলে দেয়। কলিমুল্লাহ দুই রাউন্ড গুলি ছুড়ে ব্যাংক থেকে দ্রুত নেমে পড়েন এবং উক্ত¯স্থান ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে চলে  যেতে সক্ষম হন। এই ব্যাংক ডাকাতি নিয়ে স্থানীয় জনগণ ও গ্রামবাসীদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে  যেন কোন প্রকার সন্দেহ দেখা না দেয়, সেজন্য বি.এম কলিমুল্লাহ ব্যাংক ম্যানেজারকে সাদা কাগজে লিখিত দিয়েছিলেন, পাকিস্তানি ব্যাংক থেকে লুটকৃত এই মসুদয় অর্থ স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্যয় করা হবে। সমুদয় অর্থ তিনি চাঁদপুর জোন সরকারের প্রধানমন্ত্রী এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম পাটোয়ারীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম পাটোয়ারী এই অর্থ ভারতে নিয়ে যান এবং বাংলাদেশ সরকারের তহবিলে জমা দেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ভারত থেকে গেরিলারা প্রশিক্ষণ নিয়ে আসার পূর্বে চাঁদপুর জোন সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত এফ.এফ বাহিনীর সদস্যরাই পাকিস্তানি আর্মির মোকাবিলা শুরু করে।

চাঁদপুর সদরের মুক্তিযোদ্ধা অজিত কুমার সাহা স্মৃতিচারণায় বলেন, আনুমানিক জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ফরিদগঞ্জ থানার খাজুরিয়ায় দূত মারফত খবর আসে বলাখাল দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ফরিদগঞ্জের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। খবর পেয়ে খাজুরিয়াতে অবস্থানরত গেরিলারা বলা খালের দিকে ছুটে আসে। বলাখালের কাছাকাছি এসে পৌঁছালে গেরিলারা দেখতে পায় সামরিক কনভয় নিয়ে খানসেনারা হাজিগঞ্জের দিকে ছুটছে। উত্তেজিত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় আধা কিলোমিটার দূর থেকে ফায়ার ওপেন করে। খানসেনারা তখন ধরা ছোঁয়ার বাহিরে চলে গেছে। সাধারণ গ্রামবাসীরা তখন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধদের দেখেনি। কিন্তু অস্ত্রচালনা, প্রশিক্ষণ ও   গেরিলাদের কথা লোকমুখে শুনেছিল মাত্র। উম্মুক্ত মাঠে রাইফেল, স্টেনগান হাতে গেরিলা যোদ্ধাদের দেখে সাধারণ জনগণ খুবই আনন্দিত ও উল্লসিত হয়। তারা গেরিলা যোদ্ধাদের সাথে দেশীয় টেডা, বর্ষা, কোচ, শাবল, খন্তা, কুড়াল নিয়ে খানসেনাদের খতম করতে এগিয়ে আসে। ওই দিন উম্মুক্ত মাঠে জনতা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে অবরুদ্ধ বাংলায় স্বাধীনতার স্বাদ পেতে চেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ সত্যিকার অর্থে জনযুদ্ধে পরিণত হতে শুরু করে।

 বাংলার মুক্তিকামী দামাল ছেলেদের আশ্রয়, খাদ্যসহায়তা ও তথ্যদিয়ে এ সময় থেকে  সাধারণ গ্রামবাসীরা এগিয়ে আসতে শুরু করে। সাধারণ গ্রামবাসীদের সহায়তা বাংলার স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছিল। চাঁদপুরের গেরিলা যুদ্ধে গ্রামবাসীদের অবদান সর্বজন বিদিত। পাশাপাশি সুষ্ঠুভাবে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনায় চাঁদপুরে এ ধরনের স্থানীয় প্রশাসন সেই মুহূর্তে ছিল অপরিহার্য। 


Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.